রাসূলের সা. যুগে কাব্যচর্চাঃ আসাদ বিন হাফিজ
প্রারম্ভ কথাঃ
রাসূলের সা. যুগে কাব্যচর্চা বিষয়ে কথা বলতে
আমি রীতিমতো ভয় পাই। কারণ কুরআন-হাদীস পড়ে আমার যে বুঝ এসেছে আর আমাদের দেশে
কাব্যচর্চা বিষয়ে যে ধারণা প্রচলিত,
তা
রীতিমতো বিপরীতমুখী। কাব্যচর্চা সম্পর্কে সমাজে প্রচলিত ধারণা হচ্ছে, কবিরা
পাগল। ইসলাম মনের ভেতর যত ভুল ধারণা আছে,
আগে
তা পরিষ্কার করে, তারপর সঠিক বুঝ সেখানে
বসিয়ে দেয়। আপনি যেমন আগাছা পরিষ্কার করে মাটিকে আগে চাষ দিয়ে ফসল বোনার উপযোগী
করেন, তারপর সেখানে ফসল বোনেন।
খেয়াল করুন, যে কালেমা পড়ে একজন মানুষ মুসলমান হয়, সে কালেমার গঠন স্টাইল। বলতে হয় “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, কোনো প্রভু নেই, আল্লাহ ছাড়া।” এটাই ইসলামী রীতি। আগে নেগেটিভ ও পরে পজেটিভ এপ্রোচ। বাংলাভাষার রীতি অনুযায়ী বলতে হতো, আল্লাহ ছাড়া আর কোনো প্রভু নেই। অথচ ইসলাম শেখায়, বলো, কোনো প্রভু নেই, আল্লাহ ছাড়া।
সূরা আশ শু’আরা (কবি) :
এবার সূরা আশ শু’আরার (কবি) বক্তব্য লক্ষ
করুন। আল্লাহ এ সূরায় স্পষ্ট করেছেন,
কবি
হচ্ছে দু’ধরনের। একদল শয়তান ভক্ত, একদল আল্লাহ ভক্ত। এটা যে
সময়ে বলা হচ্ছে, তখন মুসলমানরা ছিল সংখ্যায়
অল্প, মুসলিম কবির সংখ্যাও ছিল কম। অমুসলিম লোকের সংখ্যা যেমন
বেশি ছিল, অমুসলিম কবিও বেশি ছিল।
কবি বললে সাধারণভাবে অমুসলিম কবিদেরই বোঝাতো। আল্লাহ বলেন, ‘আর বিভ্রান্তরাই কবিদের অনুসরণ করে।’ এখানে কবিরা বিভ্রান্ত
বলা হয়নি, বলা হয়েছে, যারা
বিভ্রান্ত তারাই কবিদের অনুসরণ করে। আল্লাহ বলেন, ‘তুমি কি লক্ষ করোনি যে,
তারা
প্রত্যেক উপত্যকায় উদ্ভ্রান্ত
হয়ে ঘুরে বেড়ায়?’ কারা ঘুরে বেড়ায়? যারা
বিভ্রান্ত তারাই উদ্ভ্রান্ত হয়ে ঘুরে বেড়ায়।
এখানেও কবিরা উদ্ভ্রান্ত হয়ে ঘুরে বেড়ায় বলা
হয়নি। আরো বলা হয়েছে, ‘তারা এমন কথা বলে, যা
তারা করে না।’ এখানেও বলা হয়নি, কবিরা এমন কথা বলে যা তারা করে না। বরং তারা বলতে বোঝানো হয়েছে সেই জনগোষ্ঠীকে
যারা বিভ্রান্ত।
এরপর আল্লাহ আসল কথাটি তুলে ধরেছেন, বলেছেন, ‘তবে তাদের কথা ভিন্ন,
যারা
বিশ্বাস স্থাপন করে ও সৎকর্ম করে এবং আল্লাহকে খুব স্মরণ করে এবং নিপীড়িত হওয়ার পর
প্রতিশোধ গ্রহণ করে।’
এগুলোই হলো মুসলমানের কমন গুণ। এই গুণগুলোর
বিস্তার ঘটানোর জন্যই কুরআন নাজিল হয়েছে। অতএব মানুষ অনুসরণ করবে কুরআন। কুরআনকে
বাদ দিয়ে যারা কবিদের অনুসরণ করে, তারা বিভ্রান্ত জনগোষ্ঠী।
তারা মুসলমান নয়, মুসলমান তো অনুসরণ করবে
একমাত্র কুরআন এবং কুরআনের জীবন্ত দৃষ্টান্ত প্রিয়নবীর জীবন। এই সহজ কথাটা যারা
বুঝে না, তারা আলেম হতে পারে না, তারা
নিরেট মূর্খ ও বোকা।
আল্লাহ কখনো বলেননি, কবিরা
বিভ্রান্ত, বলেননি কবিরা বিভ্রান্তির
উপত্যকায় ঘুরে বেড়ায়, বরং কবিদের মহাজ্ঞানী ভেবে
যারা তাদের অনুসরণ করে সেই মুর্খদের বলেছেন,
কবিরা
যত মহৎই হোক, তারা কখনো অনুসরণযোগ্য হতে
পারে না, যেমন অনুসরণযোগ্য নয় কোনো
পীর, দরবেশ, পণ্ডিত বা অন্য কোনো মানুষ, যেমন
অনুসরণযোগ্য নয় কোনো প্রাণী বা বস্তু।
অনুসরণ করতে হবে আল্লাহ ও রাসূলের, কুরআন
ও হাদীসের, সত্য ও সুন্দরের, কল্যাণ
ও মঙ্গলের।
আল্লাহর দৃষ্টিতে কবি ও কবিতা : যে আল্লাহ
কবিদের ভালোবেসে কালামেপাকে একটি পূর্ণাঙ্গ সূরা নাজিল করলেন, সেখানে
ঈমানদার ও ঈমানহীন কবিদের পার্থক্য তুলে ধরলেন,
ঈমানদার
কবিদের ন্যূনতম যোগ্যতা তুলে ধরলেন,
সেই
কবিদের যখন আল্লাহর গোলামরা নগণ্য ও পাগলভাবে,
তখনই
বোঝা যায় তাদের জ্ঞানের দৌড় কতদূর।
নবীদের কাছে আল্লাহ অহি পাঠাতেন। কবিদের জ্ঞান ও প্রজ্ঞা দান করার সাথে সাথে জানিয়ে দিলেন, কবিদের তিনি ইলহাম পাঠিয়ে ধন্য করবেন। তাঁরই গোলাম হয়ে আপনারা কবিদের পাগল ভাবলে আমি কী করতে পারি? শুধু এটুকু দোয়া করতে পারিÑ আল্লাহ আমাদের সবাইকে দীনের সঠিক বুঝ দান করুন। কবিতা লেখার বিনিময়ে কবি আল্লাহর পক্ষ থেকে বেহেশতের খোশ খবর পেয়েছেন, আপনার চোখে সেই কবি উন্মাদ। আল্লাহর দৃষ্টিভঙ্গি ও আপনার দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য কি এবার আপনি বুঝতে পেরেছেন।
“রাসূলের সা. যুগে
কাব্যচর্চা” প্রসঙ্গঃ
এবার
“রাসূলের সা. যুগে কাব্যচর্চা” প্রসঙ্গে আসি। রাসূল সা. কবিদের কতটা ভালোবাসতেন তা
মনে পড়লে অবাক না হয়ে পারা যায় না। আল্লাহর রাসূল সা. মসজিদে নববীতে শুধু কবিতা
পড়ার জন্য একটি আলাদা মঞ্চ বানিয়েছিলেন,
এ
কথা কে না জানে। দৃশ্যটা একবার কল্পনা করুন। মিম্বারে বসে আছেন আল্লাহর নবী।
ডাকলেন কবি হাসসান বিন সাবিত রা.-কে। বললেন,
উঠে
আসুন কবি। কবি উঠে দাঁড়ালেন। রাসূলের ইশারা পেয়ে নবীর মিম্বারের পাশে কবির জন্য
নির্ধারিত মঞ্চে গিয়ে বসলেন। নবী বললেন,
পড়ুন।
কবি কবিতা পড়া শুরু করলেন। তন্ময় হয়ে শুনছেন নবী। মুসল্লিদের সারিতে বসে কবিতা
শুনছেন হজরত আবু বকর, ওসমান, ওমর, আলীসহ
প্রখ্যাত সাহাবীগণ। নবী এভাবেই কবিকে সম্মানিত করতেন।
নবী বলতেন, কবিকে সাহায্য করে জিব্রিল। আল্লাহ কবিকে ইলহাম করেন। আর সেই নবীর উম্মত হয়ে আপনারা ভাবেন কবিরা পাগল। কী অদ্ভুত কথা। আপনারা কি জানেন না, নবীর একজন খেতাবধারী কবি ছিলেন। তাঁকে বলা হতো, শায়েরুন্নবী। কবিকে সম্মানসূচক উপাধি বিতরণের সূচনাই তো করলেন নবী। আপনি এখন সেই কবিকে পাগল ভেবে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেন? বিষয়টা খুবই অবাক করা নয়?
কাব্যচর্চা ও সুন্নতে রাসূল সাঃ
আপনারাই বলেন, নবী
সা. যা করেছেন, যা করতে বলেছেন, তাই
সুন্নত। কেউ যদি জেনে-বুঝে সুন্নতকে অমান্য করে, অবজ্ঞা
করে, সুন্নত পরিপন্থী কাজ করে, তবে
নিশ্চিত তিনি পাপের মধ্যে ডুবে যান। আপনাদের এ বক্তব্য যদি সঠিক হয়, তবে
কবিদের সাথে আপনারা যে আচরণ করছেন তার হাকীকত কী হতে পারে? যে
সম্মান নবীর কাছ থেকে কবিরা পেয়েছেন,
এর
আগে পৃথিবীতে কেউ সে সম্মান কবিকে দিতে পাবেনি,
আর
কোনোদিন কেউ পারবেও না।
নবীর সুন্নত হচ্ছে, কবিদের
সম্মান করা। কবিদের ভালোবাসা। মসজিদে কবিতার আসর বসানো।
নবী কবিতার আবৃত্তি শ্রবণ করতেন। কোনো শব্দ
পাল্টানো দরকার মনে করলে সংশোধন করে দিতেন। কবিদের গাইড করতেন। কোনো কবি কোনো
ধরনের কবিতা ভালো লিখতে পারবেন, তাকে সে ধরনের কবিতা লেখার
নির্দেশ দিতেন।
কবিতা পছন্দ হলে নিজের গায়ের চাদর খুলে কবিকে
দিয়ে ধন্য করতেন। এটা তো সবাই জানেন,
বিদেশ
থেকে তিন পরমা সুন্দরীকে নবীর কাছে উপঢৌকন পাঠানো হলে, তিনি
তাদের একজনকে কবি হাসসান বিন সাবিতের কাছে দান করে দিয়েছিলেন। কারণ তিনি জানতেন, কবিরা
সুন্দর ভালোবাসে, সুন্দরের মর্যাদা শুধু
কবিরাই দিতে পারে।
নবীর কবিপ্রীতির অবাক করা ঘটনা শুনুনঃ
আপনারা কি জানেন, এই
হাসসাত বিন সাবিত কে? তিনি ছিলেন আরবের এক
বিখ্যাত কবি।
এ ইতিহাস আপনাদের সবারই জানা। একবার মা আয়েশা
রা.-কে চরিত্র নিয়ে এক মিথ্যা অপবাদ আরবের ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়েছিল। চিরকালই মানুষের
স্বভাব এমন তারা খারাপ কথা নিয়ে কানাঘুষা করতে মজা পায়। কেউ বলছিল, ছিঃ
ছিঃ এটা কি শুনলাম, নবীর স্ত্রী হয়েও মানুষ
এমন কাজ করে? একান ওকান হয়ে এ কথা নবীর কানেও
গেল, গেল মা আয়েশা রা.-এর কানেও। একজন নারীর জীবনে এমন কলঙ্কের
কালি লাগা এবং তা যদি হয় মিথ্যা অপবাদ,
তবে
এর চেয়ে দুঃসংবাদ তার জন্য আর কিছুই হতে পারে না। বললেন, তুমি
বাপের বাড়ি চলে যাও। চিন্তা করুন সে দুঃসহ দিনের কথা। মা আয়েশা রা. বার বার মূর্ছা
যেতে লাগলেন। স্বামীর ঘর ছেড়ে তিনি চলে গেলেন বাপের বাড়ি। নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে দিলেন।
বুক চাপড়ান আর বলেন, একী হলো?
এদিকে নবীজীর বুকও বেদনায় ভেঙে চুরমার। তিনিও
ভাবেন, হায়! একী হলো?
মক্কার মুসলিম ঘরে ঘরে শোকের মাতম। যিনি এ
কথা ছড়িয়েছেন, তিনি কোনো সাধারণ লোক নন।
তিনি সকলের প্রিয় কবি হাসান বিন সাবিত রা.। ঘটনার বর্ণনা তিনি নিজে দিয়েছেন। এমন
জীবন্ত বর্ণনার পর কবিকেও অবিশ্বাস করা যায় না।
এভাবে দিন কাটে, রাত
কাটে। দিন গিয়ে সপ্তাহ গড়ায়, সপ্তাহ গিয়ে মাস। না, এ
কঠিন অবস্থার কোনো সুরাহা হয় না।
হাবীবের এ অবস্থা দেখে মহান আল্লাহ ঘটনার
চল্লিশ দিন পর আয়াত নাজিল করেন। আয়াতের মর্মবাণী হচ্ছে, আল্লাহ
তার হাবীবকে সান্ত্বনা দিয়ে বলছেন,
হে
নবী! আপনি অস্থির হবেন না। আপনি যা শুনেছেন,
সব
ভুল, সব মিথ্যা। এ ছিল এক কবির দৃষ্টিবিভ্রম। এরকম কোনো ঘটনাই
ঘটেনি। আয়েশা নির্দোষ। আপনি তাকে জানান,
আপনার
প্রভু আপনাকে সব সত্য বলে দিয়েছেন।
মেঘ কেটে আবার যেন সূর্য উঠলো। ঝলমল করে উঠলো
সমস্ত প্রকৃতি। নবী ছুটে গেলেন মা আয়েশার রা. কাছে। সব ঘটনা খুলে বললেন। শুনলেন মা
আয়েশা রা.।
যে এমন জঘন্য মিথ্যা রটিয়েছে, এবার
তার বিচারের পালা এলো। আপনারা বলুন তো এমন জঘন্য অপরাধের কী শাস্তি হতে পারে? কী
হতে পারে সে বিবেচনা আপনার। কী ঘটেছিল শুনুন সে অবিশ্বাস্য ইতিহাস।
মা আয়েশা রা.কে জিজ্ঞেস করা হলো। তিনি বললেন, হে
আল্লাহর নবী! আপনি জানেন, তিনি একজন বড় কবি। তাঁর
কবিতা পড়ে আমরা আপ্লুত হই। বেঁচে থাকলে তিনি এমন আরো অনেক কবিতা লিখতে পারবেন, যা
আমাদের অন্তরকে প্রশান্তি দান করবে। তার কবিত্বকে সম্মান জানিয়ে তাকে কি ক্ষমা করে
দেয়া যায় না।
আমি জানি না, এমন
ক্ষমার দৃষ্টান্ত আপনারা আর কোথাও দেখেছেন কিনা? তিনি
এমন ক্ষমার দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন,
যা
নবী সা. ও সাহাবীগণকেই অবাক করেননি,
আল্লাহ
নিজেও খুশি হয়ে গেলেন। নবী বলছেন, তুমি বলছো, তাকে
তুমি ক্ষমা করে দিয়েছো? সুবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ।
একজন পাপী যত বড় পাপই করুক না কেন,
মুমিনের
অন্তর তার চেয়েও বিশাল। তারাই এমন অনন্য ক্ষমার দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারে। তুমি
তাকে ক্ষমা করে দিয়েছো। যাও, আমিও তাকে ক্ষমা করে
দিলাম। মহান আল্লাহ সঙ্গে সঙ্গে আয়াত নাজিল করে জানিয়ে দিলেন, আমিও
তাকে ক্ষমা করে দিলাম, তাকে বেহেশতের সুসংবাদ
দাও।
এই তো কবিদের সাথে ইসলামের আচরণ। কবিরা কবিতা লিখে আল্লাহর ভালোবাসা কুড়িয়েছেন। নবীর ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছেন। নবীর আহলে বাইতের ভালোবাসায় ধন্য হয়েছেন। সাহাবীদের অন্তরে জায়গা করে নিয়েছেন। মুসলিম নারীদের অন্তরেও শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার আসন নিয়ে বসেছেন।
রাসূলের সা. যুগে সাহাবীদের কাব্যচর্চাঃ
রাসূলের সা. যুগে কাব্যচর্চার আরেকটি
গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো সাহাবীদের কাব্যচর্চা। এমনিতেই সে যুগটা ছিল কাব্যচর্চার যুগ।
কাবার দেয়ালে কবিতা ঝুলিয়ে দেয়ার উৎসব হতো আইয়্যামে জাহেলিয়াতের আমলেও। সাবাআ
মোয়াল্লাকার কাহিনী আপনাদের অজানা নয়। কাব্যচর্চার সে স্বর্ণযুগে এলেন বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ
মহামানব প্রিয় নবীজী। তিনি কবিতাকে নিয়ে গেলেন মসজিদের ভেতরে। মসজিদে নববীতে কবিতা
পাঠের জন্য বানালেন আলাদা মঞ্চ। মসজিদে শুরু হয়ে গেল কবিতার আসর বসা। কবিতা শোনেন
নবী, শোনেন তাঁর শ্রেষ্ঠ সাহাবীগণ। মুসলমানদের মাঝে এর প্রভাব
পড়লো ব্যাপক। কাব্যচর্চার হিড়িক পড়ে গেল মক্কায়। শুধু পুরুষ নয়, মহিলা
সাহাবীরাও পিছিয়ে ছিলেন না কাব্যচর্চায়। কাব্যচর্চা হয়ে গেল আভিজাত্যের প্রতীক।
কবিতা লেখা থেকে বাদ গেলেন না নবীও। খোলাফায়ে রাশেদীনের চার খলিফার সবাই ছিলেন
মশহুর কবি। সেসব কবিতার নমুনা এখনো আপনি মক্কার লাইব্রেরিতে খুঁজে পাবেন। কবি
মতিউর রহমান মল্লিক আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ের এক হাদীস গবেষকের বরাত দিয়ে মাসিক
কলম পত্রিকায় সাহিত্য বিষয়ক চল্লিশটি বিখ্যাত হাদীস
ছেপেছিলেন। সেসব হাদীস সাহিত্য বিষয়ক অনেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিশ্লেষণ ও উক্তিতে ভরা
ছিল। আসাদ বিন হাফিজ ও মুকুল চৌধুরী সম্পাদিত ‘রাসূলের শানে কবিতা’ গ্রন্থে সেসব
হাদীস নিয়ে ষাট পৃষ্ঠার একটি দীর্ঘ ভূমিকা ছিল। আরো ছিল সাহাবীদের কবিতা, রাসূলকে
নিয়ে পৃথিবী বিখ্যাত কবিদের কবিতা,
বিশ্বের
বিভিন্ন মুসলিম মনীষী ও পণ্ডিতদের কবিতার এক বিশাল ভাণ্ডার। ওটা পড়লে বোঝা যায়, সাহাবী
ও মুসলিম পণ্ডিতরা কতটা অভিনিবেশ সহকারে কাব্যচর্চা করতেন। ইসলামিক ফাউন্ডেশন
থেকেও বেশকিছু বই বেরিয়েছে, যাতে সাহাবীদের কাব্যচর্চা
সম্পর্কে বিস্তর আলোচনা এসেছে।
রাসূল সা. বলেছেন, তোমরা
তোমাদের সন্তানদের কবিতা শেখাও, তাতে তাদের কণ্ঠ সুরেলা ও
মধুর হবে। ফলে রাসূলের জামানা ছিল কবি ও কবিতার জন্য স্বর্ণযুগ।
কবি ও কবিতা সে যুগে অনেক অবিশ্বাস্য ঘটনার
জন্ম দিয়েছে। কবিতা লিখে আল্লাহর পক্ষ থেকে বেহেশতের সুসংবাদ পেয়েছেন শায়েরুন্নবী
হজরত হাসসান বিন সাবিত রা.।
এরকম অসংখ্য ঘটনা আছে, যা
শুনলে বিস্মিত হতে হয়। একবার এক কবি রাসূলের দরবারে আসেন কবিতা শোনাতে। নবী কবিতা
শুনে এতই খুশি হন যে, তিনি নিজের গায়ের চাদর
খুলে কবিকে পরিয়ে দেন। আজকাল তথাকথিত প্রগতিশীলরা কবিকে উত্তরীয় পরিয়ে দিয়ে নিজেরা
ধন্য হয়। তারা হয়তো জানেই না, নবীর চাদর প্রদানের ঘটনাকে
স্মরণ করাতেই এই উত্তরীয় সংস্কৃতির সূচনা হয়েছে।
কবিদের খেতাব দিতে হয়, পুরস্কৃত
করতে হয় এটাও মানুষের জানা ছিল না। ‘শায়েরুন্নবী’ খেতাব বিতরণের মাধ্যমে নবীই এর
সূচনা করেন। ফলে আজকে যে কবিদের খেতাব ও পুরস্কার বিতরণ করা হয়, এটাও
মানুষ জেনেছে নবীর সুন্নত থেকে।
কবিরা বৈষয়িক হয় না। এটা তাদের স্বভাবগত
বৈশিষ্ট্য। এজন্য নবী যখন বলেন, ‘কবিদের আর্থিক সহায়তা করা
পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার করার সমতুল্য’,
তখন
অনেকেই বিস্মিত হন। আপনি বিস্মিত হবেন বলে নবী কি সত্য প্রকাশ থেকে বিরত থাকবেন?
নবীর যুগে কাব্যচর্চা ও কবিপ্রেম নিয়ে ঘটনার
অভাব নেই। একটা প্রবন্ধে সব ঘটনা তুলে ধরা সম্ভব নয়। দু-একটি ঘটনা উল্লেখ করে এ
প্রসঙ্গের ইতি টানবো।
আপনারা জানেন, যুদ্ধলব্ধ
গণিমতের মালের একটা অংশ পায় ইসলামী রাষ্ট্র,
বাকিটা
বণ্টিত হয় যুদ্ধরত মুজাহিদদের মাঝে। গণিমতের মাল বণ্টন চলছে, এসময়
সেখানে গিয়ে হাজির মিরদাস নামক এক সাহাবী কবি। রাসূল সা. তাকেও গণিমতের ভাগ দিলেন।
কবি বললো, এতো কম? রাসূল
সা. হজরত আবু বকরকে ডেকে বললেন, একে বাইরে নিয়ে যাও। কবির
যা পছন্দ, দিয়ে দাও। অবশেষে একশো উট
দিয়ে কবিকে বিদায় করা হয়।
এ ঘটনা মুজাহিদদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়ার
সৃষ্টি করলো।
মুজাহিদরা
বললো, সে কেন গণিমতের ভাগ পাবে? সে
কি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে?
হাসলেন নবী। বললেন, যুদ্ধ
করতে করতে তোমরা যখন ক্লান্ত-শ্রান্ত,
হাতিয়ার
ছেড়ে দিয়ে পরাজয় মেনে নেবে কিনা ভাবছিলে,
তখন
কেউ একজন তার কবিতা আবৃত্তি করল। সাথে সাথে তোমাদের মনের সব হতাশা ভয় দূর হয়ে গেল।
তোমরা আবার নবউদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়লে এবং বিজয় ছিনিয়ে আনলে। তারপরও তোমরা মনে করছো
কবি যুদ্ধে অংশ নেয়নি?
এটাই ছিল কবির ব্যাপারে নবীর বিবেচনা। আমরা এখন কবিতা লেখাকে কোনো কাজ মনে করি না। যে মিছিলে যায় না সে কীভাবে কর্মী হবে?
রাসূলের সা. যুগে কাব্যচর্চা ও আজকের মুসলিম
উম্মাহঃ
আমি প্রবন্ধ শেষ করবো আরেকটি ঘটনার উল্লেখ
করে। ২০০৯ সালের ঘটনা। অযাচিতভাবেই আমি সৌদি বাদশাহর আমন্ত্রণে হজে যাই। আমি আরবীর
মানে বুঝি না, আর সৌদি বাদশাহও বাংলা
বুঝেন না, তিনি কি করে আমার খবর
পেলেন আর কেনইবা আমাকে এক মাসের আতিথ্য গ্রহণের আমন্ত্রণ জানালেন? আমি
বিস্মিত ও হতবাক। অবশেষে জানতে পারি,
রেডিও
জেদ্দায় কর্মরত এক বাঙালি ভাই আমার একটি কবিতা আরবীতে অনুবাদ করে সেদেশের জার্নালে
ছাপে। সেই কবিতা বাদশাহর হাতে পড়ায় এই হাকীকত। আত্মীয়স্বজন আমাকে প্লেনে তুলে দিয়ে
গেল। আমি চরম উৎকণ্ঠা নিয়ে আল্লাহ আল্লাহ করছি। হায়! আমি তো একবাক্য আরবীও বলতে
পারবো না। কী করবো আমি? দুরু দুরু বুকে প্লেন থেকে
নামছি। দেখি এক লোকের হাতে আমার ছবিযুক্ত প্ল্যাকার্ড। আমি এগিয়ে গেলাম সেদিকে।
তারাও এগিযে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। মনে হলো,
কতদিনের
পরিচিত, যেন খালাতো ভাই। ওরা তিনজন। সবাই আরবী পোশাকে সজ্জিত। যিনি
বাঙালি, তিনিও। কুশলবিনিময়ের পর জানলাম, বাকি
দুজন সৌদি ধর্ম মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা। আমার সঙ্গী ছিলেন প্রেক্ষণ সম্পাদক
খন্দকার আবদুল মোমেন।
আমরা দুজনই সৌদির রাজকীয় মেহমানখানায় ঠাঁই
পেলাম। রাজদরবারে দাওয়াত পেলাম, কিন্তু রাজার সাথে হাত
মেলানো ছাড়া একান্তে কথা বলার সুযোগ পেলাম না। আমি কথা বলার অনুমতি চাইলাম, আমাকে
বাদশাহর ধর্মবিষয়ক উপদেষ্টা ড. আবদুল্লাহ ওমর নাফিস সাহেবের সাথে কথা বলতে বলা
হলো।
দেখা করলাম এ বিশ্ববরেণ্য ইসলামিক স্কলারের
সাথে। ভেবেছিলাম, ওখানে কোনো দুভাষী থাকবে, কিন্তু
দেখলাম আমার সামনে একটা যন্ত্র এগিয়ে দেয়া হলো,
উনি
আরবীতে বললেও আমি বাংলায় শুনি আর আমি বাংলায় বললেও
উনি আরবীতে শোনেন। বেশ মজা পেলাম। কুশলবিনিময়ের পর আমরা মূল আলোচনায় এলাম। আমি
ওনাকে বললাম, দেখুন, আমরা
জেনেছি রাসূল সা. মসজিদে নববীতে কবিতা পাঠের জন্য আলাদা মঞ্চ বানিয়েছিলেন এবং সেই
মসজিদে কবিতার আসর বসাতেন। এখনো কি সে আসর বসানোর রেওয়াজ চালু আছে? তিনি
না-সূচক জবাব দিলেন। আমি বললাম, এই আসর বসানোটা তো রাসূলের
সুন্নত। এই সুন্নত কি আবার চালু করা যায় না? ভাষা
হয়তো হুবহু এটা ছিল না, কিন্তু মূল বক্তব্য এটাই
ছিল।
তিনি বললেন, আপনার
প্রস্তাব জেনুইন। কিন্তু এই এখতিয়ার আমার নেই। আমি আপনার প্রস্তাব বাদশাহকে
জানাবো। তিনি চাইলে হবে, নইলে আমার আর কিছু করার
নেই। আপনাকে ধন্যবাদ এমন একটি প্রস্তাব দেয়ার জন্য।
জানি,
সে
প্রস্তাব গৃহীত হয়নি। হলে ইতিবাচক রেজাল্ট পৃথিবী দেখতে পেতো।
আমরা কি পারি না আমাদের মহল্লার মসজিদে এই
সুন্নত চালু করার উদ্যোগ নিতে। আপনাদের মনে থাকার কথা, স্পেনে
মুসলিম হত্যা দিবসকে স্মরণ রাখার জন্য খ্রিস্টানরা পহেলা এপ্রিলকে ‘এপ্রিল ফুল’
দিবস হিসেবে পালন করতো। অসচেতন মুসলিম সমাজকে সচেতন করার জন্য ‘সাহিত্য সংস্কৃতি
কেন্দ্র’ পরপর কয়েক বছর কীভাবে প্রতারণার মাধ্যমে সাত লাখ মুসলমানকে একদিনে হত্যা
করেছিল, তার উল্লেখ করে একটা লিফলেট লিখে সব মসজিদের ইমামদের কাছে
বিতরণ করে আবেদন জানায়, সম্মানিত ইমামগণ যেন এ
বিষয়ে এদেশের মুসলমানদের সচেতন করে। আলহামদুলিল্লাহ, এখন
আর আগের মতো এদেশের মুসলমানরা ‘এপ্রিল ফুল’ নিয়ে উৎসব করে না।
এখন মানুষ যেমন সচেতন, তেমনি শয়তানও সক্রিয়। কিন্তু মসজিদের ইমাম, মাদরাসার ওস্তাদ, আলেমগণ ও সাধারণ শিক্ষিত মুসলমানরা যদি সমাজে ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নতগুলো চালু করার কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ করেন, তবে সমাজে ইসলাম নিয়ে যে বিভ্রান্তি রয়েছে, তা দূর হতে পারে। আসুন, শুধু মুমিন নয়, মুসলিম হয়ে যেন সবাই মরতে পারি, আল্লাহর কাছে সে সাহায্য চাই।
অনেক অনেক ধন্যবাদ
ReplyDelete