আমার শৈশব ও লেখাপড়া : আসাদ বিন হাফিজ

আমার শৈশব ও লেখাপড়া ঃ আসাদ বিন হাফিজ

আমার বাড়ি অজপাড়াগাঁয়ে। আপনারা এখন গাজীপুরে গজারীর বন দেখতে যে ধনপুর গ্রামে যান, আমার গ্রাম থেকে এক কদম পা ফেললেই সে গ্রামে যাওয়া য়ায়। গ্রামটার নাম বড়গাঁও। আগে আমরা ঢাকা জেলার বাসিন্দা ছিলাম। বৃহত্তর ঢাকা জেলা এখন কয়েকভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। আমরা পড়েছি গাজীপুরে।

এই গাজীপুরেরই একটি থানার নাম কালীগঞ্জ। ভাওয়াল গড়ের উপাখ্যান, পদ্মা মেঘনা যমুনার মত বিখ্যাত উপন্যাসের রচয়িতা আবুজাফর শামসুদ্দিন এ কালীগঞ্জেরই সন্তান। এ কালীগঞ্জেই ঈশা খাঁ মসনদে আলার সমাধি পেয়েছেন আমাদের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ। এ কালীগঞ্জেরই একটি ইউনিয়নের নাম মোক্তারপুর। আমাদের গ্রামটি পড়েছে এ ইউনিয়নে।

এখনো আমাদের গ্রামে গজারী বন আছে। আগে বন এমন গভীর ছিল, মা বলতেন, দুয়ার খোলা রাখলে শেয়াল এসে ভাতের হাঁড়ি নিয়ে যেতো। আমাদের বাড়ির দুপাশেই ছিল গজারীবন। বনের ভেতর ছিল খরগোশ, শিযাল, হেজা ও নানা জীবজন্তু। ছিল বিচিত্রসব ফলবৃক্ষ।

বাজান আমাদের জমিতে বাড়ির পাশেই মক্তব খুলেছিলেন। পাড়ার ছেলেমেয়েদের সাথে ওখানেই আমার শিক্ষাজীবন শুরু। 

গ্রামেই সবচেয়ে বড় বকুল গাছটার তলায় যে প্রাইমারী স্কুল,  যেটা আজও টিকে আছে বড়গাঁও প্রাইমারী স্কুল নামে, সেখানে সীম পাতার কালি দিয়ে কলাপাতায় লিখে বড় হয়েছি আমি।

ফোর ফাইভে পড়েছি নদী পাড়ে। শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়ে সাওরাইদ হাইস্কুলের প্রাইমারী সেকশনে অলি পন্ডিতের বেতের বাড়ি খেয়ে মানুষ হয়েছি আমরা। চাচাতো ভাই কাদির, রৌশন, আমি একসাথেই স্কুলে যেতাম। ক্লাসের সহপাঠী ছিল হাছেন আলী, ফখরুল, বাতেন, নয়ন, সঞ্জিত, ভূষণ, মনা, সোহরাবসহ অনেকে। আজ কে কোথায় আছে কে জানে? মনে আছে, এ স্কুল থেকে কালীগঞ্জ পাইলট হাইস্কুলে গিয়ে যারা ফাইভে বৃত্তি পরীক্ষা দিয়েছিল আমিও ছিলাম তাদের একজন। এরপর এলো উড়াল দেয়ার পালা।

তালতলার ইছাপুরা বাজারের পাশে মোস্তফাগঞ্জ মাদ্রাসায় হাফেজি পড়তেন ইমিডিয়েট বড়ভাই মুহাম্মদ ইউনুস আলী। প্রচন্ড ভালবাসতাম তাকে। তার সাথে সে মাদ্রাসায় গিয়ে পড়লাম আল্লাহর কালাম।

বড়ভাই প্রফেসর ইউসুফ আলী অধ্যাপনা করতেন নরসিংদী কলেজে। পাশেই কলেজিয়েট স্কুল। ব্রাহ্মনদী স্কুল নামে পরিচিত। এবার এসে ভর্তি হলাম সে স্কুলে। দুবছর ওখানেই কাটলো। হবি, ইকবাল, নজরুল এরা ছিল সহপাঠী। ওখানেই জড়িয়ে পড়ি ছাত্র সংঘের সাথে।

একাত্তুরের গন্ডগোলের সময় ভাই ভাবীর সাথে চলে এলাম ঢাকায়। বড় ভাইয়ের শ্বশুরবাড়ি মীরহাজীর বাগ, কাজীপাড়া। আজকের বিখ্যাত তামিরুল মিল্লাত মাদ্রাসা গড়ে ওঠার পেছনে ভাই ও তার বন্ধুদের অবদান ছিল সবচে বেশী।

যুদ্ধের ডামাডোলে সেশনের মাঝামাঝি ঢাকায় এসে  কোথাও ভর্তি হতে পারছিলাম না। অবশেষে তেজগাঁও পলিটেকনিক হাইস্কুলের  হেডমাস্টার নূর মোহাম্মদ সাহেব দয়াপরবশ হয়ে রাজি হলেন। অস্টম শ্রেণীতে ভর্তি হয়ে গেলাম। কিন্তু থাকি কই? যাত্রাবাড়ির মীরহাজিরবাগ থেকে ফার্মগেট অনেক দূর। এই দুঃসময়ে এগিয়ে এলেন প্রখ্যাত আলেমেদ্বীন মাওলানা মাসুম সাহেব। রাজাবাজার মসজিদের পশ্চিম পাশে তাঁর বাসা। কোন সন্তানাদি নেই। ইকবাল নামে একটা পালকপুত্র ছিল মাসুম সাবের। তারজন্য একজন প্রাইভেট টিউটর দরকার। তাকে পড়ানোর দায়িত্ব নিয়ে শুরু হলো লজিং জীবন। 

যুদ্ধের মাঝামাঝি কিছুদিন ওখানেই কাটলো। এয়ারপোর্টের কাছে হওয়ায় অক্টোবর বা নভেম্বরে যখন মুহুর্মুহু বোমা পড়ছিল তখন সে আস্থানা ছাড়লাম। বড়ভাইসহ নতুন ভাড়া বাসায় এসে উঠলাম মগবাজারে।

এর কিছুদিন পর ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলে আবার ফিরে এলাম মীরহাজির বাগ। এবার ফরিদাবাদ হাইস্কুলে ভর্তি হলাম। নাইন টেন ওখানেই কাটলো। নতুন ঠিকানা হলো ছুক্কু কাজীর বাড়ি। আবারো লজিং। একগাদা ছেলেমেয়ে পড়াই। 

একদিন শেখ কামাল স্কুলে এলেন। আমি তখন টেনে পড়ি। কোথা দিয়ে কি হলো কিছুই বুঝলাম না। তিনি আমাকে স্কুল ছাত্রলীগের সভাপতি ঘোষণা করে চলে গেলেন। সেই সুবাদেই একদিন গণভবনে গেলাম বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করতে। এসবই আজ ইতিহাস।

১৯৭৪ সালে এসএসসি পাশ করলাম সে স্কুল থেকে। এবার কলেজে ভর্তি হওয়ার পালা। বড় ভাইয়ের বন্ধু অধ্যাপক নাজির আহমদ টাঙ্গাইলের এক কলেজের ইংরেজীর শিক্ষক। বড়ভাই তার কাছে পাঠিয়ে দিলেন আমাকে। ভর্তি হয়ে গেলাম কালিহাতির আলাউদ্দিন সিদ্দিকী কলেজে।  এ কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন কাদের সিদ্দিকীর বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকী। 

আমি তখন সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র। একদিন লতিফ সিদ্দিকী এসে আমাকে কলেজের ভিপি ঘোষণা করলেন। আবারো ছাত্ররাজনীতি পেয়ে বসলো আমাকে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শেখ মুজির মারা গেলে কাদের সিদ্দিকী ভারতে পালিয়ে গেলেন। লতিফ সিদ্দিকী লাপাত্তা। শিক্ষকরা কলেজ বন্ধ ঘোষণা করে যে যার মত পালিয়ে যায়। 

আবারো ঠিকানা বদল। অধ্যাপক ইউসুফ আলীর ছোট ভাই অধ্যাপক ইদ্রিস আলী। ঢাকা কলেজের পাশে শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট নিয়েয়ার। চাকরীর সুবাদে সেখানে নিয়েয়ারের নিজস্ব কোয়াটারে স্বপরিবারে থাকেন তিনি। আমি ঢাকা এসে উঠলাম ইদ্রিস ভাইয়ের বাসায়। ভর্তি হয়ে গেলাম ঢাকা কলেজে। 

আমাদের বাংলা পড়ান আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার। অনার্সে এসে পেলাম কবি মোহন রায়হানকে। আমরা দুজন একই ক্লাসে পড়ি তবে রাজনীতি করি দুই ভিন্ন মেরুতে বসে। এর কিছুদিন পর ছড়াকার লুৎফর রহমান রিটন ও আমিরুল ইসলাম এসে কলেজে ভর্তি হয়। আমাদেরকে তারা পায় বড়ভাই হিসেবে। 

এইচ এসসি ও অনার্স ঢাকা কলেজেই কেটে গেল। ছাত্র রাজনীতির সুবাদেই কলেজে ভিপি পদে ইলেকশন করি দুই কবি, আমি ও মোহন রায়হান।

অনার্স পাশ করার পর এলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম এ করার সময় আবারও নির্বাচনে জড়িয়ে পড়লাম। ডাকসুর নির্বাচন। সাহিত্য সম্পাদক পদে একদিকে আমি। আর আমার প্রতিপক্ষে আবারো মোহন রায়হান ও রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ। মনে পড়ে, কবি হাসান আলীম তখন ঝাকড়াচুলো এক নজরুল। হল সংসদে সেও ভিপি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল। শ্বাপদ অরণ্যে অগ্নিশিশুর কভারে তারই ছবির প্রতিবিম্ব ছাপা হয়েছিল। আমার অনুরোধে কভারটি করে দিয়েছিলেন শিল্পী নূরুল ইসলাম।

সেসব দিনের কথা স্মরণ হলে মনে হয়, এইতো সেদিনের কথা। 

১৮/৬/২১। ১ঃ০০ টা।

No comments

Powered by Blogger.