আফসার নিজামকে খোলা চিঠিঃ আসাদ বিন হাফিজ



প্রিয় আফসার নিজাম

ছোট ভাইটি আমার!

সালাম ও শুভেচ্ছা নিও।

কাল রাতে তোমার মোলাকাতে বাংলা কাব্যে শ্বাশ্বত সুর প্রবন্ধটি পড়লাম। সম্ভবত এটি লিখেছিলাম আশির দশকে এবং তা দৈনিক সংগ্রামে ছাপা হয়েছিল। রাতে মল্লিক ভাইকে স্বপ্নে দেখলাম। সকালে উঠে সবার আগে কেন জানি তোমার কথাই মনে পড়লো। মনে হলো কিছু কথা তোমার সাথে শেয়ার করা যায়।

তুমিতো জানো, যেদিন ওরা প্রীতি থেকে আমাকে ধরে নিয়ে গেল, আমার সারা জীবনের প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত লেখা সংরক্ষিত ছিল যে কম্পিউটারে তাও সঙ্গে নিয়ে গেল, আলমারী খুলে আমার সব পান্ডুলিপি নিয়ে নিল, সেদিনই একজন লেখককে ওরা কবর দিতে চেয়েছিল।

নাসিম হিজাযীর উপন্যাসগুলো, ভগওয়ান এস গিদওয়ানির সোর্ড অব টিপু সুলতান, হাদিসগ্রন্থ যাদেরাহ ও অনুবাদগ্রন্থগুলো এরই মধ্যে বেরিয়ে গিয়েছিল, সেগুলো টিকে গেলেও যেগুলো তখনো ছাপা হয়নি তা চিরতরে হারিয়ে গেল।
মৌলিক গ্রন্থের মধ্যে গবেষণাগ্রন্থ আল কোরআনের বিষয় অভিধান, ইসলামী সংস্কৃতি, ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস, নাম তার ফররুখ, ছন্দের আসর, আপোষহীন এক সংগ্রামী নেতা, শিশু সাহিত্য কুক কুরু কু, আলোর হাসি ফুলের গান, নতুন পৃথিবীর স্বপ্ন, আল্লাহ মহান, ইয়াগো মিয়াগো, জ্বিনের সঙ্গে বসবাস, ছোটদের মজার গল্প, ইত্যাদি প্রকাশ পেলেও অনেক পান্ডুলিপি তখনো আলোর মুখ দেখেনি, আর কোনদিন দেখবেও না।

তাই বলে একজন লেখক কি বসে বসে শুধু আফসোস করবে? ফলবতী বৃক্ষ কি কোন ফল নষ্ট হয়ে গেল বলে আর ফল দেবে না? না, তা হয় না।

যৌবনের সময়গুলো ব্যয় করেছি অনুবাদ সম্পাদনা ও গদ্য রচনায়, গবেষণায়। প্রকাশ করেছি মাত্র দুটো কাব্যগ্রন্থ অনিবার্য বিপ্লবের ইশতেহার ও কি দেখো দাঁড়িয়ে একা সুহাসিনী ভোর। একটি ছড়াগ্রন্থ হীরালালের ছড়া ও একটি গানের বই জ্যোতির পরাগ। এবার এদিকে মনযোগ দিলাম।

জেলখানা থেকে বেরোনোর পর প্রথম হার্টে সমস্যা দেখা দেয়। এনজিওগ্রাম করে দেখা গেল, বেশ কয়েকটি ব্লক, ওপেনহার্ট সার্জারী ছাড়া গতি নেই। অগত্যা ওপেনহার্ট সার্জারীই করা হলো।  না, হলো না। সমস্যার পর সমস্যা এলো। এবার স্ট্রোক করলাম। নতুন অভিজ্ঞতা অর্জিত হলো। বড় বেদনাদায়ক ও বিড়ম্বনার অভিজ্ঞতা। আল্লাহ সবাইকে এর থেকে মুক্ত রাখুন। স্ট্রোকে শুধু মানুষ মারা যায় তাই নয়, যারা বেঁচে যায় তাদের অনেকেই সারা জীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে যায়। চেহারা বিকৃত হয়ে যায়। স্মৃতি হারিয়ে ফেলে ইত্যাদি।

আলহামদুলিল্লাহ, আমার অবস্থা ততোটা খারাপ হয়নি। চেহারা সামান্য বেঁকেছিল, ঠিক হয়ে গেছে। পঙ্গু হইনি, কিন্তু স্লো হয়ে গেছি। ডাক্তার বললো, দীর্ঘদিন অষুধ খেতে হবে, ভাল হয়ে যাবেন। আপনার সমস্যা হলো, আবার এ্যাটাকের আশংকা আছে। বাসায় একা থাকবেন না। কোথাও একা যাবেন না। যাতে এ্যাটাক হলেই ডাক্তার দেখানো যায়। কয়েকমাস হাসপাতালে থেকে সেই যে বাসায় এলাম আর পুরোপুরি সুস্থ হতে পারলাম না।

এবার লাভের কথা বলি। ওরা যখন দোকানে তালা মেরে দিল, আর আমি জেলখানা ও হাসপাতালে ঘুরছি, তখন বুঝলাম, আল্লাহ যা করেন মানুষের ভালোর জন্যই করেন। মানুষ যত গরীব বা বড়লোক হউক না কেন, মানুষ কিন্তু এক পেটের বেশী খেতে পারে না। তার প্রয়োজন এক পেট খাবার ও একটু শোয়ার জায়গা। বাকি সময় সে এবাদতে কাটাবে এ জন্যই আল্লাহ মানুষ সৃষ্টি করেছেন। এবাদত মানে মসজিদে পড়ে থাকা নয়, প্রতিটি মানুষের মধ্যে আল্লাহ যে মেধা ও যোগ্যতা দিয়েছেন, তাকে পুরোপুরি কাজে লাগানোর নাম এবাদত। প্রতিটি মানুষেরই কোন না কোন যোগ্যতা ও প্রতিভা আছে। সেটা তাকে দেয়া হয়েছে আল্লাহর পক্ষ থেকে। সেই নেয়ামতের শোকর করাই তার এবাদত। এটা তার বেসিক ডিউটি। সেই ডিউটির সার্থেই তাকে অন্যান্য কাজও করতে হয়। যেমন দিনের বেলা অফিস করতে হবে, সে জন্য রাতে ঘুমোতে হয়। ইমাম সাহেবকে ইমামতি

করতে হবে সে জন্য কো্রান পড়তে হয়। দুনিয়ার সব কাজই এবাদত হতে পারে যদি বেসিক ঠিক থাকে।
মানুষের বেসিক কাজ আল্লাহর এবাদত করা। এখন তার মৌলিক এবাদত কোনটি এটি আগে তালাশ করতে হবে। মানুষের নিয়তই ঠিক করে দেয় সে কাজের ফলাফল কি হবে।

ছোট্ট একটা উদাহরণ দেই। ধরো, একটা মিছিল যাচ্ছে। যারা মিছিল করছে তাদের কোন দাবী আছে, ওই দাবী আদায় করা তাদের উদ্দেশ্য। মিছিলের সাথে পুলিশ যাচ্ছে। তাদের উদ্দেশ্য মিছিলে কোন বিশৃঙ্খলা হলে লাঠিপেটা করা। কিছু সাংবাদিক যাচ্ছে। তাদের উদ্দেশ্য ঘটনার বিবরণ সংগ্রহ করে মিডিয়ায় রিপোর্ট করা। কিছু গোয়েন্দা যাচ্ছে। উদ্দেশ্য, সঠিক তথ্য সরকারকে অবহিত করা। কিছু ফটোগ্রাফার যাচ্ছে। উদ্দেশ্য, এ মিছিলের চিত্র ধারণ করা। মিছিলের পেছনে এম্বুলেন্স মিছিলকে ফলো করছে। উদ্দেশ্য, মিছিলে কোন দুর্ঘটনা ঘটলে আহতদের সেবা দান। কিছু উৎসাহী লোক সঙ্গে যাচ্ছে। উদ্দেশ্য, মজা দেখা। সাধারণ জনগণ নির্বিকার হেঁটে যাচ্ছে, এ মিছিল নিয়ে তাদের কোন প্রতিক্রিয়া নেই।

তুমি একজন কবি। মিছিলটি দেখে তোমার দু’ধরনের প্রতিক্রিয়া হতে পারে। এক, সাধারণ জনগণের মত এড়িয়ে যেতে পারো। দুই, মিছিলে ঢুকে যেতে পারো। কারণ, তুমি জানতে চাও, মিছিলের ফল কি হয়। শ্লোগানের ভাষা এতো উত্তপ্ত কেনো? কোন সে আবেগে দুলছে তারা? মিছিল একটা, কিন্তু তার সাথে যারা জড়িয়ে পড়েছে তাদের উদ্দেশ্য এক নয়। এর থেকে সে সেই ফলই পাবে যেটা তার উদ্দেশ্য বা নিয়ত।

এ জন্যই ইসলাম নিয়তের এতো গুরুত্ব দিয়েছে। একটা মোরগ আল্লাহর নাম নিয়ে জবাই করলে হালাল, শুধু তা না করলেই হারাম। মোরগ কিন্তু একইভাবে রান্না হয়েছে, শুধু নিয়তেের কারণে কি পার্থক্য হয়েছে দেখো। ছোটভাই হিসাবে তোমাকে বলতে চাই, কাজের আগে নিয়ত ঠিক করো। তোমার সব কাজই এবাদত হবে। তোমার মধ্যে আল্লাহ যে যোগ্যতা দিয়েছেন তা কাজে লাগাও।

লাভের কথা বলছিলাম। দোকানে তালা মেরে দেয়া ও অসুখের ফলে হাতে পেলাম অঢেল সময়, যা এখন লেখার কাজে ব্যয় করতে পারছি। শুয়ে শুয়ে এর মধ্যে লিখে ফেলেছি ২১০০ এর বেশী ছড়া।

যে কথা বলার জন্য এ লেখা, ক্রুসেড সমগ্রসহ আমার অধিকাংশ লেখা বই আকারে এরই মধ্যে প্রকাশিত হওয়ায় সেগুলো হয়তো হারিয়ে যাওয়ার হাত থেকে বেঁচে যাবে। কিন্তু বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পত্রিকা, সংকলন, ম্যাগাজিনে নানা রকম প্রবন্ধ, কবিতা, ছড়া ইত্যাদি প্রকাশিত হয়েছিল, যা কোন বইতে সংকলিত হয়নি। কম্পিউটার ও পান্ডুলিপি নিয়ে যাওয়ার পর তার কোন কপিও আমার হাতে নেই।

বিশেষ করে, অসুস্থ হওযার আগের লেখা। মোলাকাতে প্রবন্ধটি পড়ার পর মনে হলো, ইচ্ছে করলে পুরনো লেখাগুলো আবারওতো সংগ্রহ করা যায়। আমি না হয় অসুস্থ, বিছনায়। একটু যদি নজর রাখো তাহলেতো তোমাদের হাতেও তা পড়ে যেত পারে। কিশোরকন্ঠ, কলম, সোনার বাংলা, সংগ্রাম, মাসিক ফুলকুঁড়ি, ফুলকুঁড়ি আসরের বিভিন্ন বার্ষিকী, পালাবদল, সাইমুমের সংকলন এসব জায়গায় পুরনো লেখা পাওয়া যেতে পারে। একটি হারানো প্রবন্ধ তোমার মাধ্যমে পেলাম এ জন্য তোমাকে ধন্যবাদ।
তোমাকে অনেক কথা বলার ছিল। কিন্তু আজ আর নয়। অন্য কোন দিন,অন্য কোন সময়। ভাল থেকো।

ইতি

তোমার ভাই

আসাদ বিন হাফিজ

ঢাকা, ২৬/৯/১৯।

বিঃদ্রঃ বইগুলোর নাম উল্লেখ করলাম, যেনো জানতে পারো আমার সংগ্রহে এখন কি কি বই আছে। 

No comments

Powered by Blogger.