সাইমুমের জন্ম ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনরোধে তার ভূমিকাঃ আসাদ বিন হাফিজ

 


কিভাবে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন হয় এটা বুঝানো খুব কঠিন। মানুষ তার আচরণ প্রকাশ করে দেহের মাধ্যমে বা দেহের কোন অঙ্গের মাধ্যমে। কিন্তু আচরণটা হয় মনের নির্দেশে। এই পুরো প্রক্রিয়াটিই সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের ফসল। মানুষের মননের ভূমিকা ছাড়া কিছুই হয় না। আর মনন গড়ে তোলে সংস্কৃতি। অবশেষে মননের নির্দেশটিই পালিত হয় বিভিন্নভাবে।

যেমন পর্দা ইসলামে ফরজ। এই ফরজ পালনে বাঁধা দান আগ্রাসনের কাজ। খৃস্টান নানরা যে পোষাক পড়ে তা নিয়ে কোন আপত্তি হয় না কিন্তু মুসলমান মেয়েরা হিজাব পড়লেই যত আপত্তি। মানুষ উলঙ্গ হয়ে সূর্যস্নান করলে আপত্তি হয় না। 

এভাবে কৌশলে প্রতিদিন কী পরিমান মানুষকে পাপসাগরে ভাসিয়ে দেয়া হয়, ভাবতে পারেন? সাংস্কৃতিক আগ্রাসন এভাবেই সারাক্ষণ আমাদের ঈমান ও আমলকে ধ্বংসের দিকে টেনে নিচ্ছে। যদি সাংস্কৃতিক কর্মীরা সময়মত বাঁধের এ ফাটলগুলো ভরতে না পারে তবে জাতি পাপের বন্যায় ভেসে যাবে। যদি সময়মত বালির বস্তা ও পাথর সরবরাহ করতে জাতি ব্যর্থ হয় তবে এ জন্য কেবল সাংস্কৃতিক কর্মীদের দায়ী করা ঠিক হবে না। এ ব্যর্থতা পুরো জাতির। এ ব্যর্থতা থেকে জাতিকে রক্ষার জন্যই সুস্থ সাংস্কৃতিক আন্দোলন অপরিহার্য।

এ দেশে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন যেমন চলছে তেমনি তা প্রতিরোধ করার কাজও চলছে। বিগত শতাব্দীর আশির দশকে শুদ্ধ সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক বলয় নির্মানের জন্য গড়ে তোলা হয় বিপরীত উচ্চারণ সাহিত্য সংস্কৃতি সংসদ ও সাইমুম শিল্পীগোষ্ঠী নামে দুটি প্রতিষ্ঠান।

এর মধ্যমনি ছিলেন কবি মতিউর রহমান মল্লিক। তিনি খুলনার বাগেরহাটের সন্তান।জনাব মীর কাসেম আলী খুলনা সফর করতে গিয়ে আবিষ্কার করেন এই রত্ন। তাঁর স্বরচিত ও সুরারোপিত গান শুনে মুগ্ধ হয়ে তিনি তরুণ মল্লিককে ঢাকায় নিয়ে আসার ব্যবস্থা করেন। তিনিই ছিলেন মল্লিকের আমৃত্যু পৃষ্ঠপোষক।

তাঁকে কেন্দ্র করেই গড়ে ওঠে বিপরীত উচ্চারণ সাহিত্য সংস্কৃতি সংসদ ও সাইমুম শিল্পীগোষ্ঠী। সহযোগিতায় ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল তরুণ ছাত্র। তাদের মধ্যে জনাব মিয়া মুহাম্মদ আইউব ও মাসুদ মজুমদার ছিলেন অগ্রগন্য। সাহিত্য ও সংস্কৃতি দুটো ক্ষেত্রে কাজের জন্য যে দুটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়, সে দুটি প্রতিষ্ঠানেরই মধ্যমনি ছিলেন কবি মতিউর রহমান মল্লিক।

এ দুটি প্রতিষ্ঠান এবং এদের অনুপ্রেরণায গড়ে উঠা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রচেষ্ঠায় যে সাফল্য অর্জিত হয় তার দুএকটা নমুনা তুলে না ধরলে তাদের প্রতি অবিচার করা হবে।


আজ থেকে পনেরো বিশ বছর আগের কথা। পহেলা এপ্রিল সারাদেশে খুবই উৎসাহ উদ্দীপনার সাথে এপ্রিলফুল পালন করা হতো। আমরাও করতাম। কে কাকে ঠকিয়ে বোকা বানাতে পারে তার মহড়া চলতো। স্যার ক্লাশে এসেছেন। বই চাইলেন। আপনি অংক স্যারকে ইংরেজি বই এগিয়ে দিলেন। তিনি রাগ করতে পারবেন না, বোকার মত হেসে দেবেন। এভাবে একজন আরেকজনকে বোকা বানানোর খেলা চলতো সারাদিন। ছেলে বুড়ো সবাই খেলতো। 

এই উৎসবটা পালন করে খৃস্টানরা। এদিন স্পেনে এক মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে। মুসলমান ও খৃস্টানদের মধ্যে তুমুল লড়াই চলছে। ফার্ডিনেন্ড ও রানী ইসাবেলা খৃস্টানদের নেতা। তারা ঘোষণা করলো, মুসলমানরা যদি হাতিয়ার ফেলে মসজিদে আশ্রয় নেয় তবে তাদের কিছু বলা হবে না। মুসলিমরা তাই করলো। খৃস্টানরা এবার মসজিদে তালা লাগিয়ে বাইরে থেকে আগুন দিয়ে মেরে ফেললো মুসলমানদের। বললো, দেখলে মুসলিমরা কেমন বোকা। শত্রুর ওয়াদা কেউ বিশ্বাস করে! সেই আনন্দে শত শত বছর ধরে তারা এপ্রিলফুল, মানে এপ্রিলের বোকা উৎসব পালন করে। সারাদিন চলে মিথ্যা কথা বলার উৎসব। প্রতারণার এ উৎসব একসময় ছড়িয়ে পড়ে মুসলিম সমাজেও। আজ কিন্তু সে উৎসব নেই। কোথায় গেল সে উৎসব? কেমন করে উধাও হলো? সুস্থ সংস্কৃতি দিয়ে তাকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে, তাই, আজ কেউ তা পালন করে না।

আরেকটি ঘটনা। বাংলার ঘরে ঘরে ছিল একসময় নায়িকাদের ছবি। এসব ছবি দিয়ে বানানো হতো ক্যালেন্ডার। যাদের ঘরে সেই ক্যালেন্ডার থাকতো না, তাদের বলা হতো গেঁয়ো, বর্বর, অশিক্ষিত। সংস্কৃতি মানুষের রুচিকে উন্নত করে দিল। মানুষ এখন ঘরে রাখে মসজিদের ছবি, প্রাকৃতিক দৃশ্য, ক্যালিগ্রাফি ইত্যাদি। এখন আর কোন ভদ্রলোক ঘরে নায়িকাদের ছবি টানায় না। এই যে রুচির উন্নয়ন এটাই সুস্থ ধারার সংস্কৃতির ফসল। এভাবেই অপসংস্কৃতি প্রতিরোধে শুদ্ধ সংস্কৃতি ভূমিকা রাখে।


সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের ফলে মানুষের বোধ ও বিশ্বাসে আঘাত লাগে। চেতনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আজ যেটাকে আপনার মনে হয় অন্যায়, দিনে দিনে তা আর অন্যায় থাকে না, হয়ে যায় সহনীয়। পাপকে পাপ মনে হয় না, মনে হয় এটাই স্বাভাবিক। এই যে তিলে তিলে হৃদয়ের আলো কমে যায়, সেই বৃক্ষে পানি দেয় সংস্কৃতি। ফিরিয়ে দেয় উদ্যম, ফিরিয়ে দেয় সাহস। সতেজ করে মন। শানিত করে চেতনা। মানুষকে বলে, যাও, সেবা করো মানুষের। তোমার পরশে আবার লোহা সোনা হোক। যে মানুষ পরের সম্পদ লুটে তৃপ্তি পেতো, তাকে বলো মুহাজির ভাইকে দান করে দিতে নিজের অতিরিক্ত স্ত্রী। সংস্কৃতির পরশে খুনী হয় প্রেমিক। আইয়ামে জাহেলিয়াতের অমানুষগুলোও মানুষ হয়ে যায়।

সবাই জানেন,স্বাধীনতা উত্তর সমাজ জীবনে নেমে এসেছিল ধ্বস। মানুষের জীবন থেকে খুলে পড়েছিল মানবতার পোশাক। হারিয়ে গিয়েছিল সততা ও মূল্যবোধ। সেই সমাজে প্রেম ও পূণ্যের বাঁশি বাজালেন যে রাজপুত্র তার নাম মতিউর রহমান মল্লিক। তার গান, কবিতা, ছড়া সকল সৃষ্টিতে মানুষকে জাগানোর যে বানী তা তুলনাহীন। 

তার এমন কোন গান নেই যে গানে ফুলের সৌরভ নেই। এমন কোন কবিতা নেই যে কবিতায় সাহসের মন্ত্র উচ্চারিত হয়নি। এমন কোন ছড়া নেই যাতে নেই নৈতিকতার আলোকরশ্মি। তিনি বলেছেন, সাহসের সাথে কিছু স্বপ্ন জড়াও, তারপর পথ চলো নির্ভীক। সাহসের সাথে স্বপ্ন জড়ানোর যে আহবান তিনি দিয়েছেন তা শুনে জেগে উঠলো বাংলার তরুন কিশোর।

তিনি সংস্কৃতির দুটো অঙ্গনেই সমানতালে প্রেমের পুষ্প ফুটিয়ে ছিলেন। 

এক. সাহিত্য দুই. সংস্কৃতি। 

তার সাহিত্য মেলে দেখুন, প্রতিটি লেখায় আছে জীবনের গান। আছে প্রেরণার বাণী। তার লেখা পড়লে আপনার মনে জাগবে স্রষ্টাপ্রেম, জাগবে মানুষের প্রতি মমত্ববোধ, সৃষ্টির প্রতি ভালবাসা। ঘৃণা, ক্রোধ, লোভ

হিংসা, মিথ্যা এসবের প্রতি আপনার মনে জন্ম নেবে বিতৃষ্ণা। এভাবেই পরিশুদ্ধ হবে আপনার ফুল্ল হৃদয়।

একই কথা গানের ব্যাপারেও। তার প্রতিটি গান হৃদয়ের গভীরে আঘাত হানে। তিনি যখন বলেন, আম্মা বলেন ঘর ছেড়ে তুই যাসনে ছেলে আর-- তখন অনেকেই চোখের অশ্রু ধরে রাখতে পারেন না।


এবার সাইমুমের কথা বলি। সাইমুমের সূচনালগ্নে আমি ছিলাম না। আগেই বলেছি, জন্মের কাহিনী বলতে পারবেন মিয়া মুহাম্মদ আইয়ুব ও মাসুদ মজুমদার। আমি যেটুক জানি, সাইমুমের প্রথম সভাপতি বা পরিচালক ছিলেন মল্লিক ভাই। এরপর দায়িত্বে আসেন ড. সৈয়দ মুহাম্মদ রফিক।  তারপর দায়িত্ব আসে এই অধমের ওপর।

কোথা দিয়ে কি হলো এখন সেসব মনে নেই। 

রফিক ভাই ডাক্তারী পড়া নিয়ে ব্যস্ত। থাকেন চিটাগাং। সেশনের মাঝামাঝি মল্লিক হঠাৎ করেই আমাকে সাইমুমের দায়িত্ব নিতে অনুরোধ করেন। 

আমি তো হতভম্ব। আমি না জানি গান, না জানি অভিনয়, না জানি আবৃত্তি করতে, না জানি সুর করতে। তরুণ কবি। দুএকটা ছড়া কবিতা লিখি। 

সবই বললাম মল্লিক ভাইকে। মল্লিক ভাই বললেন, আমি নরোম মানুষ, আপনি সংগঠন দেখেন, গানের দিকটা আমিই দেখবো। মল্লিক ভাইয়ের অনুরোধ ও কেন্দ্রের সিদ্ধান্তে আমাকে সাইমুমের দায়িত্ব নিতেই হলো। আমার সুবিধা হলো, বিপরীত উচ্চারণের সভাপতি মল্লিক ভাই, আমি সেক্রেটারী। সাইমুমের আমি সভাপতি, মল্লিক ভাই উপদেষ্টা। আর কেন্দ্রের সাহিত্য সংস্কৃতি সম্পাদক মল্লিক ভাই,  আমি অবিভক্ত ঢাকা মহানগরীর। তার মানে সাহিত্য সংস্কৃতি কেন্দ্রের মূলে মল্লিক ভাই আমি তার সহযোগী। এভাবে আমি অপ্রত্যাশিতভাবেই তারার মেলার সাথে জড়িয়ে গেলাম।

আমি উপলব্ধি করলাম, আমার চারপাশেই  তারার মেলা। জমিদার বাড়িতে যেমন প্রতিদিনই ভাল ভাল রান্না হয়। সে খাবার জমিদার খায়, সাথে কাজের লোকেরাও খায় অনেকটা সেরকম।

আমার সৌভাগ্য, আমি এক মহা তারকার সেক্রেটারী হিসাবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেছি। আমার যোগ্যতা না থাকলেও তার যোগ্যতার কোন অভাব ছিল না। তিনি গান লিখতে পারতেন, সুর করতে পারতেন, গাইতে পারতেন, কবিতা লিখতে পারতেন, আবৃত্তি করতে পারতেন, কী পারতেন না তিনি? কবি মতিউর  রহমান মল্লিক আমার কাছে এমন এক সমুদ্র, যার কোন তল নেই। 

সবাই ভাবে তাঁর স্নেহ সেই বেশী পেয়েছে, যেমনটি আমিও ভাবি। কারণ, আমি তার শুধু স্নেহই পাইনি, বন্ধুত্বও পেয়েছিলাম।

আমাকে তিনি কতটা ভালবাসতেন চিন্তা করুন, কোন গায়ক না হওয়ার পরও তিনি আমাকে সাইমুম শিল্পীগোষ্ঠীর দায়িত্বশীল বানিয়েছিলেন। সাইমুমের দায়িত্বশীলকে এখনো পরিচালকই বলা হয়। তিনি সেই ব্যক্তি, যিনি আমার সময় পরিচালককে অফিসিয়ালি সভাপতি করে সাইমুমের ইতিহাসে ব্যতিক্রম সৃষ্টি করেছিলেন। কী অদ্ভুত কথা। সাইমুমের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ও পরে সভাপতি মল্লিক ভাই ছাড়া সাইমুমের একমাত্র সভাপতির নাম আসাদ বিন হাফিজ। তাও সেই  সময়, যখন সারাদেশে সাইমুমই একমাত্র সাংস্কৃতিক সংগঠন ছিল। কথাটা ইতিহাসের অংশ বলেই বললাম, নইলে আমি এমন কেউ নই, যার বিষয় এত গুরুত্ব দিয়ে উল্লেখ করতে হবে।

আসলে কিছু কিছু মানুষ থাকে না, যারা ভাগ্যবান, যোগ্যতা নয় ভাগ্যগুণে যারা ইতিহাসের অংশ হয়, আমার ভাগ্যটাই ছিল ওরকম। যার জীবনটা কেটেছে তারকা মেলায়,  তারকাদের সান্বিধ্যে।

আমি যখন সাইমুমের সভাপতি সে সময়ের শিল্পীদের নাম শুনলেই আপনারা বুঝতে পারবেন আমি কেমন তারকা পরিবেষ্টিত ছিলাম।

আমাদের তখন শিল্পীদের দুইটা গ্রুপ ছিল। একটা বড়দের একটা ছোটদের। বড়দের গ্রুপটায় কারা কারা ছিল সবার নাম এখন মনে নেই। এক ভাই ছিলেন আবদুল হালিম, যিনি থাকতেন নারায়ণগঞ্জ, ছাত্রজীবন শেষ করে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ডাইরেক্টর হয়েছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র লোকমান হোসেন, শিল্পী তোফাজ্জল হোসেন খান, পুরাণ ঢাকার হাসান আকতার, কমলাপুরের জাহিদ হোসেন এবং আরো কয়েকজন। অবশ্য সবাই ছাত্রজীবন শেষ করে বিদায়ের তালিকায় ছিলেন। ফলে এই গ্রুপটার সাথে বেশীদিন কাজ করার আমার সুযোগ  হয়নি। শিল্পী হাসান আখতার ও তোফাজ্জল হোসেন খান ছাড়া সবাই মোটামুটি সাইমুম ছেড়ে চলে যায়।

আমাকে প্রধানত নির্ভর করতে হয় ছোটদের ওপর। এদেরই এক গ্রুপকে বড় ও এক গ্রুপকে ছোট ধরে এগিয়ে যেতে হয়। এরা যে কি পরিমান টেলেন্ট ছিল তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এরাই পরবর্তীতে সাইমুমের গুরু দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে এগিয়ে যায়। আজকে তারা সবাই প্রতিষ্ঠিত ও গুণী তারকা। আমার সৌভাগ্য, আমি এই তারকামন্ডলীর সাথেই জীবনের একটা উল্লেষযোগ্য সময় অতিবাহিত করতে পেরেছি।

আগের বড় গ্রুপের ছোট দুই সদস্য হাসান আখতার ও তোফাজ্জল হোসাইন খান এসে ছোটদের সাথে মিলিত হয়। ছোটদের গ্রুপ থেকে উঠে আসে গণসঙ্গীত শিল্পী আবুল কাশেম,বর্তমানের প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন মাওলানা তারেক মনওয়ার, প্রফেসার সাবের ছেলে নোমান আল আযামী, অধ্যাপক সাইফুল্লাহ মানছুর, আবুল হোসাইন মাহমুদ, শহীদুল্লাহ মাসুদ, কামরুল ইসলাম হুমাউন এবং আরো অনেকে। তাৎক্ষণিক যাদের নাম বলতে পারিনি কেউ তাদের নাম সংযোজন করলে খুশী হবো। ছোটদের গ্রুপে ছিল আকরাম মুজাহিদ, সালমান আল আযামী ও আরো অনেকে। এদের মধ্য থেকে অনেকেই (অর্ধডজনেরও বেশী) সাইমুমের পরিচালকের দায়িত্ব পালন করে। ভাবা যায়? মনে হলেই এখনো ভালো লাগে। আমি এতগুলো পরিচালকের পরিচালক ছিলাম? তাও সাইমুমের স্বর্ণউজ্জল দিনের পরিচালক। 

সবার মত আমারও মনে হয় আমার সময়ই সাইমুম একটি স্বর্ণালী সময় কাটিয়েছে। অনেক স্মৃতিময় ঘটনার মধ্য দিয়ে পার করেছে ব্যস্ততম সময়। দুএকটা স্মৃৃতিচারণ করি।

তাফাজ্জল ভাই ও সাইফুল্লাহ ভাইয়ের রক্তে ভেজা সাইমুমঃ

ইসলামী সংস্কৃতির জন্য রক্তদানের সবচে বড় ঘটনাটি আমার সময়ই সংঘটিত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনে ডাকসুর নির্বাচনী সভা চলছে। সভা শেষে শুরু হলো বিশাল মিছিল। প্রথম সারিতে নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী কেন্ডিডেটগণ ও নেতৃবৃন্দ। আমিও আছি সে সারিতে। ঠিক মনে নেই এটা এনাম কাদের পরিষদ নাকি তাহের কাদের পরিষদ ছিল। ডাকসুর সাহিত্য সম্পাদক পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছি আমি। আমার প্রতিপক্ষে লড়ছেন দুই জাদরেল কবি। একজন তসলিমা নাসরিনের প্রথম স্বামী প্রয়াত কবি রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ। অন্যজন ঢাকা কলেজে আমার সহপাঠী কবি মোহন রায়হান। আমরা একই ক্লাশে পড়তাম এবং দুজনেই কবিতা লিখতাম। ঢাকা কলেজে আমরা দুজনই ভিপি পদে নির্বাচন করি এবং দুজনেই পরাজিতও হই। ডাকসুতে এসে আবার আমরা মুখোমুখি হই।

এ সময়ের কথা।

নেতৃবৃন্দের পরের সারিতে ছিল সাইমুমের শিল্পীগণ। মিছিলটি বিভিন্ন হল প্রদক্ষিণ করে যখন এফ রহমান হলের সামনে আসলো তখন কোনদিক থেকে যে গ্রেনেড এসে আমাদের আঘাত হানলো বুঝে  উঠার আগেই দেখি পিচঢালা রাজপথ রক্তে রঞ্জিত। এক নয়, একাধিক গ্রেনেড ফেটেছিল, তবে কয়টা বলতে পারি না। গ্রেনেডগুলো ফাটে নেতৃবৃন্ধের সারি পার করে মূল মিছিলের আগে, যেখানে সাইমুমের শিল্পীরা অবস্থান করছিল। গ্রেনেডের স্প্লিন্টার শিল্পীদের শরীর ঝাঁঝরা করে দিল। অনেকেই রক্তাক্ত। পড়ে আছে পিচের ওপর। কিছু স্প্লিন্টার মূল মিছিলের প্রথম সারিতে যারা ছিল তাদের আহত করলো, কিছু নেতৃবৃন্দকেও। আমি দেখলাম কিছু স্প্লিন্টার আমার পেন্ট ফুটো করে গোশতের ভেতর গিয়ে বসে আছে। কিন্তু তেমন ব্যথা অনুভব করছি না। আহতদের ধরে ধরে মেডিকেলের ইমার্জেন্সিতে নেয়া শুরু হলো।

প্রথমেই যারা গুরুতর আহত তাদের পালা। তোফাজ্জল ভাই, আজিজ সাইফুল্লাহ ও আরো কয়েকজনকে নিয়ে যাওয়া হলো। তখনো অনেকেই কাতরাচ্ছে। আমি উঠে দাঁড়ালাম। দেখলাম আমার সবচে কাছে আকরাম মুজাহিদ। নোয়াখালীর মাস্টার শফিকুল্লাহ সাহেবের ছোট ছেলে। শিল্পী তারেক মনওয়ারের ছোট ভাই। তখনো সে স্কুলের ছাত্র। আমি তাকে কোলে তুলে নিলাম। একটা রিকসা ডেকে ছুটলাম হাসপাতালে। আমি তাকে জাপটে ধরেছিলাম আর সে বলছিল, আসাদ ভাই, সরেন, সরেন। আপনার কাপড়ে রক্ত লাগবে।

সেই ঘটনায় অনেক রক্ত ঝরেছে। কিন্তু ত্যাগের এ পরীক্ষায় এগিয়ে গেলেন দুজন মানুষ। একজন, যাকে আমরা ওস্তাদ তোফাজ্জল হোসেন খান বলে চিনি। তিনি ছিলেন সাইমুমের অগ্রসেনানীদের একজন। তার একটি পা হাটু থেকে কেটে ফেলতে হয়।

আর অপরজন ছিল ঢাকা কলেজে আমার প্রিয় কর্মী আজিজ সাইফুল্লাহ। আমি যখন ভিপি কেন্ডিডেট ছিলাম তখন দেখেছি কি পরিশ্রম তারা করেছে। তারও একটি পা কেটে ফেলতে হয়।

সেই গ্রেনেড বিষ্ফোরণের ঘটনায় অনেক রক্ত ঝরেছে। আহত হয়েছে প্রায় অর্ধশত তরতাজা তরুণ। কিন্তু আলহামদুলিল্লাহ। সে ঘটনায় কেউ শাহাদাত বরণ করেনি  এবং দুজন ছাড়া আর কারো অঙ্গহানিও হয়নি। চিকিৎসার পর সবাই সুস্থ হয়ে যায়।

এ ঘটনায় জীবনের মত পঙ্গু হয়ে যান দুজন মানুষ, একজন তোফাজ্জল হোসেন খান ও আজিজ সাইফুল্লাহ। না, তাদের এ ত্যাগ সংগঠন ভুলে যায়নি, তোফাজ্জল ভাইয়ের চাকরী হয়ে যায় ইসলামী ব্যাংকে আর আজিজ সাইফুল্লাহ ভাইয়ের ইবনে সীনায়। আমরা আশাবাদী ও দোয়া করি  তাদের এ ত্যাগ আল্লাহও ভুলে যাবেন না। আল্লাহ তাদের জন্য উত্তম পুরষ্কার নিয়ে অপেক্ষা করছেন। 

কবি মল্লিক নেই, আছে তার সৃষ্টি, আছে তার আদর্শ। মানুষের জীবনকে সুশোভিত করতে হলে সে আদর্শকে সমাজে বিকশিত করার কোন বিকল্প নেই। এ দায়িত্ব এখন আমাদের। আমরা যারা তার আদর্শকে ভালবাসি তাদের। আশার বিষয়, বাদ্যবিহীন গানের যে সংস্কৃতি তিনি প্রমোট করেছেন

সে বৃক্ষ শুধু বড় হয়নি, সে বৃক্ষের চারা ছড়িয়ে পড়ছে দেশ থেকে দেশান্তরে। তবে অশ্লিলতামুক্ত শুদ্ধস্বর সাহিত্যের যে আন্দোলন তিনি শুরু করেছিলেন আশির দশকে, তার বহু মালামাল গোডাউনে পড়ে আছে। তার সহযোদ্ধারা বিরতিহীনভাবে শুদ্ধ সাহিত্য আজো সৃষ্টি করে চলেছেন। কবি মল্লিককে আশির দশকের শুদ্ধস্বর সাহিত্য গোষ্ঠীর সেনাপতি বলা হয়। কিন্তু এই সেনাপতি ও তার সৈনিকদের সৃষ্টি সম্ভার পরিকল্পিত ভাবে প্রকাশিত না হলে কবি মতিউর রহমান মল্লিকের পূর্ণাঙ্গ পরিচিতি ও মূল্যায়ন সম্ভব নয়। আশির কাব্য জোস্নার কবিদের শ্রেষ্ঠ রচনাবলী প্রকাশিত হলে আমরা জানতে পারবো এই সেনাপতির বিজয়ের সীমানা কতদূর বিস্তৃত হয়েছে। মল্লিকীয় সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন বাংলাদেশের সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে কোনো প্রভাব ফেলেছে কিনা, ফেললে কতটুকু? মল্লিকসহ আশির শব্দসৈনিকদের শ্রেষ্ঠ রচনাবলী প্রকাশ না হওয়া পর্যন্ত তা নিরূপণ করা সম্ভব নয়। তবে সঙ্গীতের ক্ষেত্রে তিনি সারাদেশ সফর করে অগনিত গোষ্ঠী তৈরী করেছিলেন। তার ফলে,প্রচুর গীতিকার, সুরকার, শিল্পী তৈরী হয়েছে এবং তারা সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে। সৃষ্টি হয়েছে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক সংসদ। আমরা আরো আশাবাদী, বৃহত্তর সংগঠনের কেন্দ্রীয় সাহিত্য সংস্কৃতি বিভাগ সরব হওয়ায়। 

প্রায় পঞ্চাশ বছর সাধনা তথা সার, পানি দিয়ে যে বৃক্ষ তিনি বড় করে তুলেছেন, সেই বৃক্ষের ফল দেয়ার সময় হয়েছে। দেখা যাক, বৃক্ষের মালিক কতটা সুচারুভাবে ফসল ঘরে তুলতে পারেন।

অনেক শুকরিয়া প্রিয়জন ।

No comments

Powered by Blogger.