ফিতাবন্দী তিতা কথাঃ আসাদ বিন হাফিজ
ফিতাবন্দী তিতা কথাঃ আসাদ বিন হাফিজ
গ্রাম বাংলায় একটা প্রবাদ আছেঃ গরম ভাতে
বিলাই বেজার উচিত কথায় বিয়াই বেজার। তাই থুতু গেলার মত অনেকেই উচিত কথা গিলে ফেলে।
সহজে বাইরে প্রকাশ করে না। কমবেশী এ কাজটা সবাই করে। আমিও।
জীবনে কত যে উচিত কথা গিলে ফেলেছি তার ইয়ত্তা
নাই। কালভদ্রে যদি বলে ফেলি তবে লোকজন ভাবে,
লোকটা
কি অভদ্র, এমন কথা কেউ কাউকে বলে।
আরো বিপদ আছে। আপনি যদি জানেন, মন্ত্রী
মহোদয় কোন প্রজেক্টের টাকা চুরি করেছে,
কক্ষণো
তা ভুলেও কাউকে বলবেন না। তাতে মন্ত্রী সাবের জনপ্রিয়তা ও ক্ষমতা কেবল বাড়বে, কমবে
না। তবে মন্ত্রীর পোষা কুকুরের কামড়ে আপনার আহত হবার সমূহ সম্ভাবনা আছে। তাই মানুষ উচিত কথা সহজে
বলে না। আপনিও বলবেন না।
আপনাকে না বলে ছমিরুদ্দি আপনার গাছের দুটো আম
খেয়েছে, তাকে আপনি চোর বলতেই পারেন। কিন্তু আপনার ভার্সিটি পড়ুয়া
সন্তান যদি মন্ত্রীর বিরোধী হয় এবং তিনি তাকে লোক লাগিয়ে পিটিয়ে পরে হাসপাতালে
দেখতে যান তাহলে মন্ত্রীর প্রশংসায় আপনিও মুখর হবেন। মন্ত্রী যদি তার চিকিৎসার
জন্য দুইশ টাকা দেন তবে আপনি ধন্য হয়ে যাবেন। এরেই বলে রাজনীতি।
আমার দুঃখ, আপনি
চুরি করে আম খেয়েছেন সে জন্য না, দুঃখ হচ্ছে লোকে য়ে আপনাকে
চোর বলে ডাকবে সে জন্য। দুঃখ, আপনার কাঁধের ফেরেশতা এ
জন্য আপনার আমলনামায় পূণ্যের বদলে যে পাপ লিখবে সে জন্য।
আপনিও জানেন আমিও জানি, কারো
সম্পদ না বলে ভোগ করাকে চুরি বলে। সে সম্পদ কোটি টাকা হলেও চুরি, দশ
টাকা হলেও চুরি। নামাজ পড়তে গিয়ে অন্যের জুতা নিয়ে যায় যে সেও চোর, যে
রাতে সিঁদ কেটে চুরি করে সেও চোর। যদি কোন পীর সারারাত হোটেলে থেকে সকালে বাথরুমের
তোয়ালে ব্যাগে ভরে বাড়ি নিয়ে যায় তিনিও চোর,
কেনাকাটার
ফাঁকে ভ্যানেটি ব্যাগে গোপনে নেইল পালিশ লুকিয়ে রাখাও চুরি।
চুরি যে কত প্রকার ও কি কি তা বলে শেষ করা
যাবে না।
মাকে যেমন দশমাস দশদিন কষ্ট করে সন্তান জন্ম
দিতে হয়, তেমনি একজন লেখকও অনেক
পরিশ্রম করে, মেধা খাটিয়ে একটি লেখা
জন্ম দেন। মায়ের সন্তান চুরি হয়ে গেলে মা যেমন কষ্ট পান তেমনি একটা লেখা চুরি হয়ে
গেলে লেখকও কষ্ট পান। সোনাদানা চুরির মত মেধা চুরিও চুরি।
কিন্তু এটা আমরা অনেকেই মানতে পারি না।
অনেকে আবার এরকমও বলেন, এই
কাজটাতো অমুকে করেছেন, তমুকে করেছেন তবে আমি করলে
দোষ কি?
না ভাই,
আপনাকে
আমি দোষ দিচ্ছি না। মন্ত্রী সাহেব চুরি করেন,
এমপি
চুরি করেন, চেয়ারম্যান চুরি করেন, মেম্বার
চুরি করেন, আমি করলে দোষ কি? নারে
ভাই, দোষ নাই।
চোরের
দেশে সবাই চোর। আমি, তুমি সকলেই।
এখানে দোষের কিছু নাই। কিন্তু সমস্যা অন্য জায়গায়।
আপনার কবরে আমি যাবো না, আমার কবরে আপনি যাবেন না।
এ দুনিয়ায় আমি কি কি করেছি সবই রেকর্ড হয়ে যাচ্ছে। হাশরের মাঠে মালিক আমাকে আমার
কাজের বেতন দেবেন। সেদিন কিন্তু আপনার পাওনা কেউ নেবে না। সিসি ক্যামেরায় যা
রেকর্ড হচ্ছে সে অনুযায়ী আপনি আপনার পাওনা পেয়ে যাবেন।
উচিত কথা বলে আমি আপনার বিরাগভাজন হয়ে লাভ কি? আমার
কুঁড়েঘর আমার, আপনার অট্টালিকা আপনার।
আপনার সামর্থ থাকলে আপনি রোজ রোজ চায়নিজ খাবেন,
আমি
মানা করার কে? আপনিই গান লিখবেন, আপনিই
সুর দেবেন, আপনিই গাইবেন।
লক্ষ জনতার হাততালি আপনি পাবেন, আমি
তার ভাগ চাইবো না। আপনি মাহফিলে, অনুষ্ঠানে যাতায়াতের জন্য
রাহা খরচ পাবেন আমি তার ভাগ চাইবো না। গান গাওয়ার পর খুশি হয়ে আপনাকে কর্তৃপক্ষ যে
বকশিশ দেন তার ভাগ কি আমি কখনো চেয়েছি?
কেউ
কেউ নাকি কন্ট্রাক্ট করে অনুষ্ঠানে যান,
সে
কন্ট্রাকের ভাগ কি আমি চেয়েছি?
যেহেতু আপনি ইসলামী গান করেন সওয়াবের আশায় সে
জন্য আমি চাই আপনি পাপ মুক্ত থাকেন। সে জন্যই এসব বলা। অনুষ্ঠানাদিতে নাম বলতে না
পারার নানারকম কারণ থাকতে পারে। হঠাৎ করে নাম ভুলে যেতে পারেন। তাড়াহুড়ো থাকতে
পারে।
কিন্তু ইউটিউবের ঘটনাটা কি? রবীন্দ্রসঙ্গীতের
এলবামে রবীন্দ্রনাথের নাম ব্যাবহার হয়,
নজরুল
সঙ্গীতে নজরুলের নাম, লালনের গান লালনের নামে
চলে কিন্তু ইসলামী গানের ব্যাপারে গীতিকারের নাম বাদ দেয়ার মানসিকতা বড়ই দুঃখজনক।
যেখানে আল্লাহর নির্দেশ, তোমরা জেনেশুনে সত্য গোপন
করোনা আর সত্যের সাথে মিথ্যাকে মিশ্রিত করোনা,
সেখানে
আপনি সরাসরি আল্লাহর হুকুম অমান্য করছেন?
আর
ভাব দেখান আপনি ইসলামের মহা খাদেম।
ইদানিং এমনও দেখা যাচ্ছে, ইউটিউবে
একটা গান রিলিজ হচ্ছে, সেখানে ব্যবহার হচ্ছে শুধু
শিল্পীর নাম ও ছবি।
কেনরে ভাই?
আপনি যদি নিজের নাম ও ছবি ব্যাবহার না করতেন
তবে বলতে পারতেন, প্রদর্শনেচ্ছা ইসলাম পছন্দ
করে না, তাই এখানে কোন নাম ও ছবি ব্যাবহার করা হয়নি।
কিন্তু তা তো করেননি।
আবার এমনও দেখা যায়, যে
স্টুডিও গানটা ছাড়ছে সেখানে ফলাও করে শিল্পীর নামের সাথে নানারকম টাইটেল যুক্ত করে
প্রচার করা হচ্ছে। ডকুমেন্টেশনের জায়গায় কোন স্টুডিওতে রেকর্ড করা হয়েছে, কে
ক্যামেরা চালিয়েছে, কে কম্পোজ করেছে, কে
ভিডিও সম্পাদনা করেছে, কে উপদেশ বানী দিয়ে ধন্য
করেছে, কে লাইট ধরেছে,
কারা
সহযোগিতা করেছে, কারা প্রযোজনা করেছে এরকম
নানা তথ্য আছে কিন্তু নেই গীতিকারের নাম,
সুরকারের
নাম। কোথাও আবার সুরকারের নামও দেয়া হয়। সবচে কম ব্যাবহার করা হয় গীতিকারের নাম। অথচ
এই গানটার প্রাথমিক মালিক গীতিকার। গীতিকারের অনুমোদন নিয়ে যিনি সুর করেছেন তিনি
সুরের মালিক। যিনি সুরকার ও গীতিকারের পর গানটি গেয়ে শোনান তিনি পরিবেশনের মালিক।
তাই সততার দাবী হচ্ছে, যখন কোন গান সবার
জ্ঞাতার্থে প্রচার করা হবে তাতে প্রথমে গীতিকার, তারপর
সুরকার, তারপর শিল্পীর নাম অন্ততঃ সমান গুরুত্ব দিয়ে উল্লেখ করা।
এরপর যার যতটুকু ভূমিকা তার উল্লেখ করা যাবে। এতটুকু নৈতিকতা যার মধ্যে নেই তিনি
ইসলামী সংস্কৃতির জন্য সম্পদ না হয়ে
আপদে
পরিণত হবেন।
ইসলামী গান নিয়ে যারা কাজ করছেন বিষয়গুলো
তাদের নোটে নেয়া প্রয়োজন। আমি যতদূর জানি,
সিএইচপি
যার কাছ থেকে গান নেন তাকে কিছু সম্মানী দেন। যাকে দিয়ে সুর করান তাকে কিছু
সম্মানী দেন। এবং গান শুট করতে যে খরচ তাও তারাই বহন করেন। ক্যামেরা থেকে শুরু করে
এডিটিংসহ সব খরচ বহন করে যে গানটি তিনি মার্কেটে ছাড়েন বিনিয়োগ উঠানোর আগেই যদি
আরো কয়েকটি প্রতিষ্ঠান গীতিকারের অনুমতি ছাড়া,
সুরকারের
অনুমতি ছাড়া, শিল্পী ও প্রযোজকের অনুমতি
ছাড়া হুবহু সেই গান, সেই সুর যদি বাজারে ছাড়েন
তবে সেই প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি ইসলামী সংস্কৃতির নামে যে জোচ্চুরি করছেন তাতে কোন
সন্দেহ নেই।
এ কথাগুলো আমি কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠাকে
ইংগিত করে বলছি না। কাউকে হেয় বা প্রমোট করার জন্য বলছি না। আমি কথা বলছি, সততার
জন্য, নৈতিকতার জন্য। যারা শিল্পী আছেন, সুরকার
আছেন, গীতিকার ও ব্যবসায়ী মহল আছেন বিষয়টি নোটে নেয়ার এখনি সময়।
বিশ্বব্যাপী ইসলামী সংস্কৃতি ক্রমেই বিস্তৃত হচ্ছে। বাড়ছে এর চাহিদা, বাড়ছে
মার্কেট। সেই সাথে শুদ্ধ সংস্কৃতির এ বাগানে নানা পোকামাড়েরও উপদ্রব ঘটছে।
শুধু সংস্কৃতি কর্মী নয়, আলেম
ওলামা নয়, বুদ্ধিজীবী নয়, রাজনৈতিক
নেতাকর্মী নয়, সর্বস্তরের গণমানুষের
সুচিন্তিত মতামত ও পরামর্শ এ দেশে ইসলামের বিকাশের পথ সুগম করতে পারে। আমি সবাইকে
নিজ নিজ মতামত প্রদান করে সুখী সুন্দর একটি সমাজ গড়ার বিনীত আহবান জানাচ্ছি।
৪/২/২১। ৫ঃ০০ টা।
No comments