যেতে হবে আরো বহু দূর : আসাদ বিন হাফিজ

http://www.asadbinhafiz.com/2022/08/blog-post_220.html

যেতে হবে আরো বহু দূরঃ ০১

যেতে হবে আরো বহু দূর, কথাটা শুনলেই মনে হয়, আর কতদূর যেতে হবে? আমাদের গন্তব্য আর কত দূর? আমরা কোথায় যেতে চাই? আমরা কি কোন অজানা গন্তব্যে হাঁটছি? নাকি আমাদের কোন নির্দিষ্ট গন্তব্য আছে?

যেতে হবে আরো বহু দূর, কথাটা বলে দেয় আমরা পথে আছি তাহলে আমরা কোথা থেকে রওনা দিয়েছিলাম? দীঘল পথের কোন কোন বাঁক আমরা পার হয়ে এসেছি? বিগত চল্লিশটা বছর তো ক্রমাগত হেঁটেছি তাতে কি পথ কমলো কিছু আমি কি রিলেরেসের মত আমার জন্য যে দাঁড়িয়ে আছে তার কাছে আসতে পেরেছি? আমার পরবর্তী প্রজন্মের হাতে কি আমি জিয়নকাঠি তুলে দিতে পারবো? যাতে সেই কাঠি নিয়ে সে দৌড় দিতে পারে?

এমন কত কথাই মনে উঁকি দেয় কোন কোন প্রশ্নের হয়তো জবাব আছে আবার কোন প্রশ্নের সুস্পষ্ট জবাব নেই একটা ধোঁয়াশার মধ্য দিয়ে আমরা এগুচ্ছি হয়তো আমরা না দেখলেও আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম তাদের গন্তব্যের মিনার দেখতে পাবে

তাই এ লেখাটার কোন রঙ নাই এটা না প্রবন্ধ, না ইতিহাস, না ভ্রমণ কাহিনী, কিছুই না ছোটবেলা সম্ভবত মীর মশাররফ হোসেনের একটা বই পড়েছিলাম "উদভ্রান্ত পথিকের মনের কথা" বা উদাসীন পথিকের মনের কথা, এটা সেই রকম তবে পার্থক্য হচ্ছে, এ পথিক উদভ্রান্ত নয় সে জানে সে কোথা থেকে রওনা করেছে এবং কোথায় গিয়ে শেষ হবে তার সফর

বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস অনেক দীর্ঘ চর্যাপদ ও শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের পথ মাড়িয়ে মঙ্গলকাব্যের জগত মন্থন করে সুলতানী আমল ও মোগল আমল পার হয়ে পুঁথিকাব্যের মোড় ঘুরে আমরা আলাওলের মানবিক সাহিত্যে প্রবেশ করেছিলাম অনেক আগেই

ইংরেজ এসে সে সাহিত্যের যবনিকা টানলো বিনা পয়সায় চা খাওয়াবার মত বিনা পয়সায় নয়া সাহিত্য দিল, নাম দিল আধুনিক সাহিত্য আমরা পান্তাভাত ও খিচুড়ি বাদ দিয়ে চা বিস্কিট দিয়ে নাস্তা খেতে শিখে গেলাম চাষাভুষার বাংলা ছেড়ে আমরা সাহেবি বাংলা শিখে গেলাম গামছা লুঙ্গি ছেড়ে প্যান্ট সার্ট পরা শিখলাম

সহজ সরল জীবনচর্চা বাদ দিয়ে আমরা চাটুকারী শিখলাম

আমরা শিখলাম প্রভুকীর্তন তোষামুদী করে কিভাবে নানা উপাধি অর্জন করা যায় তা আমাদের রপ্ত হয়ে গেল সে ফিরিস্তি এখানে নাইবা টানলাম

এরপর দেখলাম রবীন্দ্র যুগ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ইংরেজ আনুকূল্যে বিশ্বকবি হলেন তিনি লাভ করলেন নোবেল প্রাইজ বাংলা সাহিত্য ঠাঁই করে নিল বিশ্ব দরবারে

এরপর বিদ্রোহের ঝান্ডা উড়িয়ে এলেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম ইংরেজকে বললেন, এদেশ ছাড়বি কিনা বল, নইলে কিলের চোটে হাড় করিব জল

এরপর এলেন ত্রিশের কবিদল মানবিকতার শ্লোগানের আড়ালে এরা মূলত বাংলা সাহিত্যে পাশবিকতার উদ্বোধন করলেন সাহিত্যে ফুল, পাখি, প্রকৃতি বাদ দিয়ে মানব বন্দনা করে চিরন্তন প্রেমের যে ঐশ্বর্য আমাদের ছিল সেখানে তারা রোপন করলেন দেহজ ও কামজ প্রেম সমাজ ও সভ্যতার বদলে প্রাধান্য পেল ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ জীবন হয়ে উঠলো ভোগসর্বস্ব তারা এই ভোগবাদের প্রধান অন্তরায় হিসাবে চিহ্নিত করলেন ধর্মকে

বাংলা সাহিত্যের উৎপত্তি হয়েছিল ধর্মকে আশ্রয় করে চর্যাপদ বৌদ্ধ ধর্মাশ্রিত সহজিয়া মতবাদকেন্দ্রিক কবিতা এরপর এলো শ্রীকৃষ্ণকীর্তন শ্রীকৃষ্ণের গুনগান যার মূখ্য বিষয় এখানেও ধর্মই প্রাধান্য পেল এরপর এলো মঙ্গলকাব্য মঙ্গলকাব্য পুরোটাই ধর্মাশ্রাদিত পুঁথিসাহিত্য ও জঙ্গনামা কাব্যেও ধর্মেরই প্রাধান্য পরিলক্ষিত হলো কিন্তু ত্রিশের দশকের কবিদের হাতে বাংলা সাহিত্য হয়ে গেল ধর্মবিদ্বেষী

এর কারণও স্পষ্ট ধর্ম অনৈতিক কাজকে ঘৃণা করে ধর্ষণ, পরকিয়া, ঘুষ, দুর্নীতি, হিংসা, মাতাল হওয়া, জবরদস্তি, লুটপাট, জুলুম, অত্যাচার এরকম সকল মন্দ কাজকে অপছন্দ করে ধর্ম আর ভোগবাদের মূল কথা হলো, খাও, দাও, ফুর্তি করো সেখানে নীতি নৈতিকতা ও ন্যায় অন্যায়ের কোন বালাই নেই এই অমানবিকতার নামই হলো আধুনিকতা ও মানবতাবাদ এখানে আমিত্ববাদই সব এই ভোগবাদই সব মানবিকতা ও নৈতিকতা খেয়ে ফেললো এভাবেই ভোগবাদী নষ্ট মানুষের প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়াল ধর্ম সত্তর দশক পর্যন্ত এই ধর্মবিরোধী তৎপরতার প্রাধান্য অব্যাহত থাকলো কারণ বিশ্বে তখন ভোগবাদ ও কমিউনিজমের প্রচন্ড প্রতাপ বিরাজ করছিল কমিউনিজমের ভাষায় ধর্মকে আফিম বলে গন্য করা হলো ফলে, পুঁজিবাদ ও সমাজবাদ দুটো মতবাদই ধর্মকে তাদের প্রধান শত্রু গন্য করে এর বিরুদ্ধে ক্রমাগত বিদ্বেষ ছড়াতে শুরু করে

পাকিস্তানী শোষকরা তাদের এ বিদ্বেষে ঘি ঢালে তারা সব অপকর্মের ওপরেই ইসলামের লেবেল লাগাতে থাকে মানুষ ইসলামের নামে এসব অনৈসলামিক কর্মকান্ড দেখে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে

মানুষ কবি সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবীদের দ্বারা প্রভাবিত হয় এখানেও হলো তাই আমাদের বুদ্ধিজীবীরা মানব রচিত পুঁজিবাদ তথা অবাধ ভোগবাদকে ঠেকানোর জন্য সমাজবাদের স্বপ্ন তুলে ধরলো মানুষের সামনে, যেখানে মানুষের সব স্বাধীনতা কেড়ে নিয়ে সেই স্বাধীনতা তুলে দিল পার্টির হাতে পার্টির নেতারা পরিণত হলো নব্য শোষকে পুঁজিবাদে শোষণ করতো পুঁজিপতিরা, সমাজবাদে শোষণ করে পার্টির নেতারা, পাবলিক যে মাইনকা চিপায় ছিল সেখানেই রইলো, মাঝখান থেকে পরিবর্তিত হলো শোষক

এ সময়কালে কবি গোলাম মোস্তফা, শাহাদাৎ হোসেন, তালিম হোসেন, ফররুখ আহমদ, সৈয়দ আলী আহসান, আবদুস সাত্তার প্রমুখ কবিরা ব্যক্তিগতভাবে বাংলা সাহিত্যকে তার মূল রুটে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন কিন্তু বিশ্বব্যাপী ধর্মবিরোধী যে প্রবল স্রোত বইছিল তার মোকাবেলা করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি তবে তারা শক্তিমান লেখক হওয়ার কারণে, শত চেষ্টার পরও তাদেরকে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস থেকে মুছে ফেলা যায়নি আসলে লেখক বাঁচে তার লেখায়, তাকে অবজ্ঞা করা যায়, মুছে ফেলা যায় না

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা সাহিত্যে যে বিশাল রচনা সম্ভার গড়ে তোলেন এবং বাংলা সাহিত্যকে বিশ্ব দরবারে নিয়ে যান তারপর বাংলা সাহিত্যে যিনি সবচে বড় ঝড় তোলেন তিনি কবি কাজী নজরুল ইসলাম তিনি বাংলাদেশের জাতীয় কবি এটা কেবল কাগজে কলমে বা রাষ্ট্রীয় ঘোষণায় নয়, বাস্তবেই তিনি বাংলাদেশের জাতীয় কবি বাংলাদেশের মানুষের প্রাণের আকুতি তিনি তার সাহিত্যে তুলে ধরেছেন আমাদের হাসি কান্না, দুঃখ আনন্দ, রাগ অনুরাগ সবই তার লেখায় উঠে এসেছে সাহিত্যের এমন কোন বিভাগ নেই, যেখানে তিনি হাঁটেননি এমন কোন ধর্ম নেই, যার গুনগানে তিনি মুখর হননি

আপন সম্প্রদায়ের পক্ষে তিনি যেমন কলম ধরেছেন, তেমনি সম্প্রদায়ের উর্ধে ওঠে কি করে অসাম্প্রদায়িক হতে হয়, সেটাও নজরুল থেকেই শিখতে হয় অন্যকে আঘাত না করে কিভাবে নিজের জয়গান গাইতে হয় তাও নজরুল আমাদের শিখিয়েছেন

জুলুমের বিরুদ্ধে বাঙালির রুখে দাঁড়ানোর যে চিরায়ত অভ্যাস সেই সাহসিকতা, প্রেমের যে নিমগ্নতা সবই আমরা নজরুলে পাই তাই চোখ বন্ধ করেই বলা যায়, নজরুল আমাদের জাতীয় কবি তিনি আমাদের ভালবাসায়, শ্রদ্ধায়, প্রাণের গভীরে আছেন, থাকবেন

কথা বলছিলাম বাংলা সাহিত্যের গতি প্রকৃতি নিয়ে কি করে বাংলা সাহিত্যে নষ্টামী ঢুকে, কি করে ধর্মিবদ্ধেষ আমাদের মননে ঢুকে যায়, কি করে আমাদের মধ্যে মানবিক মূল্যবোধ কমে যায়, কি করে আমরা পাশবিকতায় ঢুকে পড়ি, অনৈতিকতা ও অধর্মে আমরা কেমন করে জড়িয়ে পড়ি, কতটা জড়িয়ে পড়ি, এগুলো বিশদ আলোচনা করা নিষ্প্রয়োজন আমরা নিজেরাই তার সাক্ষী মন্দ আমাদের কাছে আর মন্দ মনে হয় না, এরচে ভয়ংকর খবর আর কি হতে পারে

সমাজে সুবাতাস বইয়ে দেয়া কবি ও লেখকদের কাজ, কিন্তু কোথায় সুবাতাস? কারাগার ভরে আছে ধারণ ক্ষমতার কয়েকগুণ মানুষে, এটা কি সুবাতাসের নমুনা? বৃদ্ধাশ্রমের মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে বলুন, এটা কি সুবাতাসের নমুনা?

ধর্ষণের যে খবর প্রতিদিন খবরের কাগজে পান সেটা কি সুবাতাসের নমুনা? গুম, খুনসহ এমন কোন অপকর্ম আছে, যা আমরা করছি না? না, এ তালিকা লম্বা করে লাভ নেই আমরা একটু সুবাতাসের জন্য হাপিত্যেশ করছি সে বাতাস আমাদের পেতেই হবে মায়ের হাতে সন্তান খুন আমরা আর দেখতে চাই না দেখতে চাই না ঐশীর হাতে মা বাপ নিহত হতে আমরা পাখির কাকলি শুনতে চাই ফুলের সুবাস চাই প্রেম চাই জনে জনে, মনে মনে বাংলা সাহিত্যে সে বাতাস বইতে শুরু করেছে সে বাতাসের কথাই বলবো কোন এক সকালে

২৩শে জুলাই ২০২০ : ১১টা

যেতে হবে আরো বহু দূরঃ ০২

কবি হাসান আলীমের একটা বইয়ের নাম, আশির দশকঃ জ্যোতিজোস্নার কবিকন্ঠ বইটিতে তিনি আশির দশকের কয়েকজন কবির সাহিত্যকর্মের সামান্য মূল্যায়ন করেছেন এই আশির দশকে এসে বাংলা সাহিত্য যে ছোট্ট বাঁকটি নিয়েছিল, সে বাঁকটি এখন আর ছোট নেই, যত দিন যাচ্ছে, সাহিত্যে শুদ্ধস্বর ততই বাড়ছে

বাংলা সাহিত্য দুর্বোদ্ধতা ও যৌনতা আক্রান্ত হওয়ার ফলে ক্রমেই জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছিল তিরিশ থেকে সত্তর পর্যন্ত এ ধারা বেগবান ছিল মানুষ কবিতা ও সাহিত্য বিমুখ হয়ে পড়ছিল কিন্তু সৃজনশীলতা কখনো থেমে থাকে না কবিরা যখন বুঝতে পারলো কবিতা কেন জনবিচ্ছিন্ন হচ্ছে, তখন তারা এর উত্তরণের উপায় চিন্তা করতে লাগলো এর সমাধানের উপায় খুঁজতে গিয়ে একদল তরুণ কবি হঠাৎ করেই যেন হাতে সোনার খনি পেয়ে গেল তারা বাংলাদেশের সমাজ জীবন বিশ্লেষণ করে দেখলো, এত বিরূপ প্রচারণার পরও বাংলাদেশের মানুষ ধর্মকেই পছন্দ করে হতে পারে তারা মুসলিম, হতে পারে হিন্দু, হতে পারে বৌদ্ধ বা খৃস্টান সমাজের মানুষ নাস্তিক হওয়ার চাইতে নিজ নিজ ধর্মের প্রতিই অধিক ভালবাসা পোষণ করে ফলে যেসব লেখকরা নষ্ট জীবনের প্রতি আসক্ত নবীন লেখকদের ঘৃণা তাদের জড়িয়ে ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল তরুণ ছাত্র এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে মিয়া মুহাম্মদ আইয়ুর, মাসুদ মজুমদার, মাহবুবুর রহমান মোরশেদ, মতিউর রহমান মল্লিক এরা প্রচলিত স্রোতের বিপরীতে নতুন আশার বানী উচ্চকিত করে বিপরীত উচ্চারণ নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলে কিন্তু মিয়া মোহাম্মদ আইয়ুব ও মাহবুব মোরশেদ সরকারী আমলা ও মাসুদ মজুমদার সাংবাদিকতায় ঢুকে গেলে মল্লিক অনেকটা নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন

তিনি ছিলেন অসম্ভব গুণী একজন মানুষ নিজে গান লিখতেন, সুর দিতেন, গাইতেন তিনি কবিতা লিখতেন, ছড়া লিখতেন, সাহিত্যের নানা শাখায় বিচরণের চেষ্টা করতেন তার বাড়ি ছিল বাগেরহাটের বারুইপাড়া গ্রামে একবার মরহুম মীর কাসেম আলী বাগেরহাট গিয়ে এ রত্নের সন্ধান পান মানিকে মানিক চেনে তিনি দেখেই বুঝলেন, এ পাথরের ভেতর বারুদ আছে সময়মত ঘসা দিলেই জ্বলে উঠবে আগুন তিনি তাকে ঢাকায় নিয়ে এলেন বাংলা সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অঙ্গন পেল এক বিস্ময়কর অমর প্রতিভা মূলতঃ মতিউর রহমান মল্লিককে কেন্দ্র করে মীর কাসেম আলী যে স্বপ্ন দেখেছিলেন তার ফলেই বাংলা সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে নতুন বিপ্লবের সূচনা হয় আজকে আমরা বাংলা সাহিত্যে যে ইসলামী ধারা দেখছি, একবাক্যে বলা যায় এর স্বপ্নদ্রষ্টা ছিলেন মীর কাসেম আলী ও সিপাহসালার ছিলেন কবি মতিউর রহমান মল্লিক

এখানে খুব স্পষ্ট করে আমি বলতে চাই, আকাশে সূর্য একটাই থাকে পৃথিবী আলোকিত হয় এক সূর্যের তাপেই চাঁদ তারা যেটুকু আলো দেয় তা সূর্যের কাছ থেকে নিয়েই আলো দেয়

না, আমি চাঁদ তারার আলোকে খাটো করে দেখছি না প্রেমিক জুটি চাঁদের আলোতেই অভিসারে বেরোয় চাঁদের আলোর টানেই নদীতে জোয়ারভাটা হয় জোনাকীর আলোরও একটা গুরুত্ব আছে সব আলো দিয়ে সব কাজ হয় না চাঁদের জোসনা কখনো সূর্য দিতে পারে না

ধ্রুবতারা খুবই ম্রিয়মান একটি তারা কিন্তু দিক নির্ণয়ে তাকেই আমরা টার্গেট করি আমাদের কারো কারো মাঝে মুই কি হনুরে একটা ভাব লক্ষ্য করি সে জন্যই এ কথাটা বললাম

যে কোন সৃষ্টির বেলাতেই দেখা যায়, কাজটা একজন করে, কিন্তু তাকে সাহস যোগায়, প্রেরণা দেয়, উদ্দীপ্ত করে অন্যরা মল্লিকভাই নিঃসঙ্গ থাকার মানুষ নন তার চারপাশে সব সময় ভক্তের ভীড় লেগেই থাকতো এ সময় কয়েকজন বিরল কাব্য প্রতিভা মল্লিক ভাইয়ের আরাদ্ধ বিপ্লবের সহযোগী হয় তারাও মল্লিক ভাইয়ের মত বাংলা সাহিত্যের গতি ঘুরিয়ে দিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয় তারা বয়সে সবাই নবীন একটা দুটো করে কাঁচা হাতের কবিতা ছাপা হচ্ছে মাত্র আমরা চিনিনি কিন্তু বাংলা সাহিত্যের অমর প্রতিভা কবি আল মাহমুদ সেই নবীন কবিগোষ্ঠীর মাঝেই অযুত সম্ভাবনা লক্ষ্য করলেন তিনি তার বখতিয়ারের ঘোড়া কাব্যগ্রন্থটি উৎসর্গ করলেন চার তরুণকে কবি মতিউর রহমান মল্লিক, আসাদ বিন হাফিজ, সোলায়মান আহসান ও বুলবুল সরওয়ার এরাই যে নতুন বিপ্লবের অগ্রসৈনিক হবেন কবি আল মাহমুদই তাদের প্রথম শনাক্ত করেন বইটি বাংলা সাহিত্য পরিষদের প্রথম কবিতার বই  এরই মধ্যে এ কাফেলায় শামিল হন আরো তিনজন সিলেটের কবি মুকুল চৌধুরী, কবি হাসান আলীম ও যশোর থেকে কবি মোশাররফ হোসেন খান বাংলা সাহিত্যে এ সপ্তরথীর অবদান পরবর্তীতে ইতিহাস হয়ে যায়

এ সপ্তরথীর সাথে পরবর্তীতে আরো অনেকেই যুক্ত হলেও এ সাতজন দীর্ঘকাল একসাথে কাব্যান্দোলন করেন মূলত, এদেরকে বলা যায় আশির দশকের জ্যোতি জোসনার কবিকন্ঠের পাইওনিয়ার এদের মধ্যে মতিউর রহমান মল্লিক, আসাদ বিন হাফিজ, হাসান আলীম ও মোশাররফ হোসেন খান এ চারজন শপথের কর্মী হিসাবে অনন্য ভূমিকা পালন করেন বাকী সোলায়মান আহসান, মুকুল চৌধুরী ও বুলবুল সরওয়ার নানা কারণে শপথ নিতে না পারলেও তাদের কমিটমেন্ট ও অবদান কোন অংশে কম ছিল না বুলবুলের মিশর চলে যাওয়া, মুকুলের ইসলামিক ফাউন্ডেশনের চাকরী তাদের শপথের অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়

সোলায়মান আহসান উঠে আসেন চাকসুর নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বুলবুল ও সোলায়মান দুজনেই সোনার বাংলার সাহিত্য সম্পাদকের দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন

হাসান আলীম আশির বিশ্বাসী বলয়ের কবিদের একটি বৃহৎ কাব্য সংকলন করেন আশির কবিতা নামে যা প্রকাশ করে সাহিত্য সংস্কৃতি কেন্দ্র

একসময় আমাদেরও মনে হতো কাব্যচর্চা করা একটি বেহুদা কাজ কিন্তু কোরান হাদিস পড়ে আমাদের এ ভুল ভেঙে যায়

বিষয়টা খুব ইন্টারেস্টিং আমাদের সম্মানিত আলেমগণ সুরা আশ শোয়ারা পড়েছেন শোয়ারা মানে কবিগণ এ সুরার যে আয়াতটি সবচে মশহুর সেখানে বলা হয়েছে, আর কবিদের কথা, তারা বিভ্রান্তির উপত্যকায় ঘুরে বেড়ায় আর নিজেরা যা বলে তা করে না এটুকু পড়েই কবিদের সম্পর্কে আলেমগণ চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে চলে আসেন, কবিরা পাগল তারা বিভ্রান্তির উপত্যকা ঘুরে বেড়ায় তারা যা বলে তা করে না অতএব, কবিরা পরিত্যাজ্য কী অবাক কান্ড আল্লাহর বানীরও ভুল ব্যাখ্যা? তারা কি ইসলামের কথা বলার স্টাইলটাও জানে না?

এতো সেই জিকির, যেখানে বলা হয়, লা ইলাহা, লা ইলাহা ইলাহ নাই, ইলাহ নাই এই জিকির করে কি মুসলমান হওয়া যায়? না, যায় না আপনাকে বলতে হবে ইল্লাল্লাহসহ তখন অর্থ হবে, আল্লাহ ছাড়া ইলাহ নাই আল্লাহ এ আয়াতের পরবর্তী অংশে বলেছেন, তবে তারা ছাড়া যারা ঈমান এনেছে, সৎ কাজ করেছে ও নির্যাতীত হলে প্রতিবাদ করে

এ বিষয়টি আমার বলার দরকার নেই এ আয়াত নাজিল হওয়ার পর সাহাবী কবিরা রাসুলের দরবারে যেয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলে, ইয়া রাসুলাল্লাহ, আমাদের কী হবে? আমরাও তো কবিতা লিখি রাসুল সা বললেন, আয়াতের শেষ পর্যন্ত পড়ো তোমরা শেষোক্ত দলের

তার মানে, কেউ যদি আল্লাহর প্রিয়ভাজন কবি হতে চায়, তবে তাকে তিনটি কাজ করতে হবে এক, ঈমান আনতে হবে দুই, সৎ কাজ করতে হবে তিন, নির্যাতীত হলে প্রতিবাদ করতে হবে ব্যাস, কবির ডিউটি শেষ

আপনি মুসলমানও হবেন, আবার আল্লাহর হুকুমের ভুল ব্যাখ্যা করবেন, এটা তো হতে পারে না আল্লাহর হুকুম কোন খেলতামাশার বিষয় নয় যে, এটা নিয়ে আপনি মজা করবেন, অপব্যাখ্যা করবেন, উল্টো ব্যাখ্যা করবেন

কাউকে যদি আল্লাহ কবিতা লেখার দক্ষতা দিয়ে থাকেন তার দায়িত্ব হচ্ছে সেই নেয়ামতের শোকর আদায় করা কবিতা লেখা যেই কবিদের নিয়ে মহান প্রভু সুরা নাজিল করে তাদের দিকনির্দেশনা দিয়েছেন সেই কবিদের নিয়ে আপনি তামাশা করার কে?

মুশকিল হচ্ছে, আমরা কোরান পড়ি, কিন্তু বুঝি আমাদের বুদ্ধি অনুসারে একজন ওয়াজ করছেন, ভাইসব, রাসুল যা করেছেন, যা করতে বলেছেন, যা করার অনুমতি দিয়েছেন সবই সুন্নত আমাদের নবী ঘোড়ার পিঠে চড়ে তলোয়ার দিয়ে যুদ্ধ করেছেন, অতএব ঘোড়ার পিঠে চড়ে তলোয়ার দিয়ে যুদ্ধ করা সুন্নত

আরেকজন ব্যাখ্যা করছেন, ভাইসব, রাসুলের জামানায় ঘোড়া ও তলোয়ার ছিল যুদ্ধের সেরা অস্ত্র, রাসুল তাই ব্যবহার করেছেন, অতএব রাসুলের সুন্নাত হচ্ছে, আপনিও আপনার জামানার সেরা অস্ত্রটি ব্যবহার করবেন

ব্যাখ্যা কিন্তু কোনটাই ভুল নয় আপনি কোন ব্যাখ্যা নেবেন সেটা নির্ভর করবে আপনার বুদ্ধির ওপর

কোরান পড়াটা বড় কথা নয়, আপনি কিভাবে বুঝলেন সেটাই বড় কথা

মনে রাখবেন, অর্ধেক কলেমা পড়ে কাফের হওয়া যায়, মুসলমান নয় মুসলমান হতে হলে আপনাকে পুরোটাই পড়তে হবে

আমরা ইসলাম বুঝেছি, উদার মানসিকতা নিয়ে মনের মধ্যে কোন বদ্ধমূল ধারণা নিয়ে আমরা ইসলাম বুঝতে যায়নি কোরানের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পড়েছি অন্তত আট দশটা তাফসীর বুঝতে চেষ্টা করেছি কোরান কি বলতে চায় এই কোরআনের কিছু আয়াত নাজিল হয়েছে মুমীনদের লক্ষ্য করে, কিছু রাসুলকে সম্বোধন করে আপনি খেয়াল করলে দেখবেন, কোরানের বিশাল অংশ নাজিল হয়েছে ইয়া আইউহান্নাস বলে মানে, হে মানবজাতি বা হে মানুষ বলে তার মানে কোরআন কেবল মুসলমানের নয়, মানবজাতিরও যেখানে আল্লাহ নিজে মানবজাতিকে লক্ষ্য করে কিছু বলছেন, সেটা আপনি আপনার ঘরে আটকে রাখার কে? মানুষকে জানতে দিন,  আপনার আল্লাহ সবার জন্য কি বলছেন তিনি হাবিলেরও স্রষ্টা, কাবিলেরও অতএব তার আইন তো সবার জন্যই কোরান মানুষের সম্পদ, কেবল মুসলমানের নয় কোরান কেবল আমার বা আমার পরিবারের জন্য আসেনি আমার বংশের জন্যও না এর কল্যাণের ভাগ সবাই পেতে পারে আপনি কেন অন্যদের বঞ্চিত করবেন?

আরও একটি বিষয় এখানে প্রনিধানযোগ্য

আমি চাই আমার সন্তান মন্দ কাজ থেকে দূরে থাকুক আপনি আমার প্রতিবেশী আপনার সন্তান আমার সন্তানের বন্ধু আপনার ছেলে মন্দ কাজে জড়িয়ে পড়লে আমার ছেলেও জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে আপনিও নিশ্চয়ই চান আপনার ছেলে ভাল থাকুক তাহলে সমাজকে ভাল রাখার জন্য আপনার ও আমার একজোট হয়ে কাজ করতে হবে কবি সাহিত্যিকরা সে স্বপ্নই এঁকে দেবে সবার মনে আমাদের সন্তানরা হবে তাদের স্বপ্নের সমান বড়

সাহিত্যে সুবাতাস বইয়ে দেয়ার যে স্বপ্ন নিয়ে আমরা যুথবদ্ধ হয়েছিলাম সে স্বপ্ন রূপায়নের জন্য আমরা বেছে নেই ইসলামকে আমরা মনে করি, ইসলাম একটি সার্বজনীন জীবন বিধান যে বিধানের ছায়ায় সকল মানুষ নিজস্ব স্বাধীনতা নিয়ে বসবাস করতে পারবে কারণ এ বিধান কোন মানুষের তৈরি নয় বিশ্বের যিনি স্রষ্টা তিনি সবার প্রয়োজনের দিকে নজর রেখে এ বিধান বানিয়েছেন ইসলাম বলে, তুমি যদি জানো একটু পরেই এ বিশ্ব ধ্বংস হয়ে যাবে তবু সুযোগ থাকলে একটি বৃক্ষ রোপণ করো

অর্ধ পৃথিবীর শাসক ওমর রা বলেন, ফোরাতের কুলে একটা কুকুরও যদি না খেয়ে মরে আমি ওমরকে জবাবদিহী করতে হবে আর মহানবী সা প্রতিবেশী অমুসলিম অসুস্থ মহিলাকে যে সেবা দিয়ে সারিয়ে তুলেছিলেন এ ঘটনা কে না জানে! তার মানে, অমুসলমানকে ভালবাসা, সেবা করাও রাসুলের সুন্নাত আমরা সে ইসলামের জাগরণ চাই, যেখানে শুধুই কল্যাণ বাস করে

২৪শে জুলাই ২০২০ : ৮টা

যেতে হবে আরো বহু দূরঃ ০৩

কথা বলছিলাম আশির দশক নিয়ে তিরিশের পর বাংলা সাহিত্য আবারো তার মূলের দিকে যাত্রা করে সাহিত্যে যা হয় সাহিত্য কোন বদ্ধ পুকুর নয় সাহিত্য নদীর মত প্রবহমান সময়ের সাথে সাথে তার ভাষা পাল্টায়, শব্দে নতুনত্ব আসে, চেতনায় বিপ্লব ঘটে নতুন ভাষায়, নতুন মননে, নবসাজে সাহিত্য ঝলমল করে ওঠে এটা ঘটে মূলত সময়ের প্রয়োজনে কিন্তু কাউকে না কাউকে সূচনা করতে হয় যেমনটি আমরা দেখেছি আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের বেলায় যুদ্ধ শুরুর আগেই কবিরা যুদ্ধ শুরু করে দেয় পাকিস্তানী শাসকরা ইসলামের নাম ভাঙিয়ে শোষণ করছিল বলেই জনগণ শোষণের বিরোধিতা করতে গিয়ে তথাকথিত  ইসলাম বিরোধিতায় জড়িয়ে পড়েছিল কিন্তু সাম্য মৈত্রী ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ করে যে ইসলাম, যে ইসলাম সার্বজনীন ও মানবতার জয়গানে মুখর মানুষ সে ইসলামকে চায় যা মানুষে মানুষে হিংসা বাড়ায়, ঘৃণা বাড়ায়, শঠতা বাড়ায়, অনৈতিকতা বাড়ায়, প্রতারণা বাড়ায়, অহংকার বাড়ায়, লোভ বাড়ায়, হিংস্রতা বাড়ায় তা মানুষের স্বভাবের সাথে যায় না  যে আদর্শ মানুষে মানুষে সম্প্রীতি বাড়ায়,  পরষ্পরের প্রতি দয়াবান হতে উদ্বুদ্ধ করে, তার প্রতিই মানুষের সহজাত আকর্ষণ এতে করে সমাজে বয়ে যায় শান্তির সুবাতাস

আশির জ্যোতিজোস্নার কবিকন্ঠগুলো সে সুবাতাসের জন্যই কন্ঠ উচ্চকিত করেছিল সূচনায় মতিউর রহমান মল্লিকের নেতৃত্বে সপ্তরথি (কবি মতিউর রহমান মল্লিক, আসাদ বিন হাফিজ, সোলায়মান আহসান  বুলবুল সরওয়ার, মুকুল চৌধুরী, হাসান আলীম ও কবি মোশাররফ হোসেন খান) কবিতায় নতুন সুর বাজালেও অল্পদিনেই তা যেমন আকর্ষণ করে প্রবীণদের, তেমনি সমকালীন কবিদের, এবং নব্বই দশকসহ পরবর্তী নবীন কবিদেরও তাই এ ধারাটি দ্রুত পল্লবিত ও বিকশিত হয়

আগেই বলেছি, এ কবিকন্ঠকে প্রথম শনাক্ত করেন কবি আল মাহমুদ তিনি তাদের নামে বখতিয়ারের ঘোড়া কাব্যগ্রন্থটি উৎসর্গ করেন (কবি মতিউর রহমান মল্লিক, আসাদ বিন হাফিজ, সোলায়মান আহসান ও বুলবুল সরওয়ার) লাব্বাইক বলে এতে শামিল হন মুকুল চৌধুরী, হাসান আলীম ও কবি মোশাররফ হোসেন খান একটু পরে যুক্ত হন কবি গোলাম মোহাম্মদ, নাসির হেলাল ও শরীফ আবদুল গোফরান সিলেটের নিজামউদ্দিন সালেহ প্রচন্ড শক্তিমত্তার পরিচয় দেন সবুজের আগ্নেয় প্রপাত গ্রন্থটি লিখে কাফেলায় শামিল হন যশোরের খসরু পারভেজ কিন্তু এ দুজন বেশীদিন সরব থাকেননি

এ তালিকা আরো অনেক দীর্ঘ করা যায় কিন্তু আমি সেদিকে যাচ্ছি না আমি আগে প্রবীণ কবিদের কথা বলি কবি আল মাহমুদের বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র ছেড়ে ইসলামের দিকে ফিরে আসা তার কবিবন্ধু ও প্রবীণদের মধ্যে বেশ বড় রকমের একটি আলোড়ন তোলে

আবদুল মান্নান সৈয়দ ফররুখ আহমদের শ্রেষ্ঠ কবিতা সম্পাদনা করতে গিয়ে ইসলামের সৌন্দর্য নতুন করে আত্মস্থ করেন তার মায়েরও আশা ছিল তিনি ইসলামের একজন খাদেম হোন

আমি এবং মল্লিক ভাই তখন বিআইসির দোতালায় একই রুমে বসি উনি দেখেন মাসিক কলম আর আমি বাংলা সাহিত্য পরিষদ আমাদের পাশের বিল্ডিংয়ের নিচতলায় আবদুল মান্নান সৈয়দের অফিস আমরা সুযোগ পেলেই স্যারের ওখানে ঢু মারি আড্ডা হয়, গল্প হয় আমরা শিখি সাহিত্য, স্যার জানতে চান, আমাদের স্বপ্নের কথা আল মাহমুদ ও আবদুল মান্নান সৈয়দ দুজনেই একাধিক প্রবন্ধ লিখে আশির দশকের এই নবযাত্রাকে অভিনন্দিত করেন

কবি আবদুস সাত্তার বসতেন নবারুন ও সচিত্র বাংলাদেশ অফিসে আড্ডা দেয়ার জন্য আমরা ওখানেও যেতাম আর যেতাম ড. আশরাফ সিদ্দিকীর ধানমন্ডির বাসায় কবি আফজাল চৌধুরী ইসলামিক ফাউন্ডেশন ঢাকা কেন্দ্রের পরিচালক হয়ে এলে তখন তার অফিসও আমাদের আড্ডাখানায় হয় তিনি বসতেন তোপখানা রোডে শিশুকল্যাণ ফাউন্ডেশনের দোতালায় এছাড়া সৈয়দ আলী আহসান, মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ  এরা আমাদের ভালবাসতেন এবং আমাদের উৎসাহ দিতেন তারা বিভিন্ন সভা সেমিনারে আমাদের আন্দোলনের সাফল্য কামনা করতেন কবি আবিদ আজাদের আজিমপুরের প্রেসে যেতাম তার পত্রিকায় লেখা দিতে দৈনিক বাংলার মোড়ে যেতাম কবি ফজল শাহাবুদ্দিনের আখড়ায় এভাবে আমরা প্রথিতযশা কবি সাহিত্যিকদের আনুকূল্য ও সমর্থন লাভ করি, যা আমাদের সাহস ও উদ্দীপনা যুগিয়েছে

তখন আমি ঢাকা কলেজে বাংলায় অনার্স পড়ি ঢাকা কলেজে পড়ার সুবাদে আমি সরাসরি শিক্ষক হিসাবে পাই মশহুর শিক্ষাবিদ আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ ও কৌশিক সম্পাদক কামাল আতাউর রহমানকে আমি তাদেরও প্রিয় ছাত্র ছিলাম

তখনও বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র সেভাবে গড়ে ওঠেনি ঢাকা কলেজের পাশে নিয়েয়ারের অফিসের এক কামরায় আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার ক্লাশ নিতেন কিসের ক্লাশ? বলতেন, বিশ্ব সাহিত্যের ক্লাশ ওখানেই বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের উৎপত্তি হয় আমি তখন বড় ভাইয়ের বাসা নিয়েয়ারের কোয়ার্টারে থাকি মাঝে মাঝে ঢু মারি বিশ্ব সাহিত্যের ক্লাশেও

ওদিকে অনার্সে ক্লাশমেট হিসাবে পাই কবি মোহন রায়হানকে আদর্শিক দিক থেকে আমরা ছিলাম দুই মেরুর বাসিন্দা আবার ক্লাশমেট হিসাবে আমরা পরষ্পর বন্ধু ফলে সম্পর্কটাও সেভাবে ওঠানামা করতো আমরা যখন অনার্সে তখন কলেজে ঢুকে ছড়াকার লুৎফর রহমান রিটন ও আমিরুল ইসলাম তাদের প্রতিভা তাদেরকে আমার কাছাকাছি নিয়ে আসে আমার স্নেহ ও ভালবাসা থেকে তারা কখনো বিচ্ছিন্ন হয়নি তারাও আমাকে শ্রদ্ধা করতো বড় ভাইয়ের মত মাঝখানে ফাটল ধরায় রাজনীতি ছাত্র সংসদ নির্বাচন এলে ওরা দুইজন দুই প্যানেলে সাহিত্য সম্পাদক হিসাবে দাঁড়ায় প্রধানত পারিবারিক প্রভাবে আমি ভিন্ন একটি প্যানেলে ভিপি পদে কিন্তু তখন ছাত্রদলগুলোর মধ্যে  এখনকারমত এত বিদ্বেষভাব ছিল না ফলে তাদের সাথে কখনো আমাকে বৈরিতায় যেতে হয়নি এই সম্পর্কের ফলে বৈরি বাতাসের খোঁজ যেমন আমি সহজেই পেতাম তেমনি আমি আমার স্বপ্নকেও সহজেই সনাক্ত করতে পারতাম

আশির এ কাব্যান্দোলনের শুরুতে আমাদের হাতে শুধু স্বপ্নই ছিল স্বপ্নের সাথে ছিল আশা ও ভালবাসা আমরা আমাদের স্বপ্নের পক্ষে কিছু তাত্ত্বিক আলোচনা ও দিকনির্দেশনা চাচ্ছিলাম যেহেতু সবার মত আমরাও জানতাম কবিরা বিভ্রান্তির উপত্যকায় ঘুরে বেড়ায়, তাই একটা সংকোচ ও দ্বিধা তখনো আমাদের আচ্ছন্ন করে রেখেছিল বিষয়টা উত্থাপিত হলো বাংলা সাহিত্য পরিষদের পরিচালনা কমিটির মিটিংএ সিদ্ধান্ত হলো, এ বিষয়ে একটা প্রবন্ধ লিখবেন জনাব আবদুল মান্নান তালিব আগামী মাসের কমিটি সভায় তিনি সেটা পেশ করবেন

তিনি তাই করলেন প্রবন্ধটি শোনার পর বলা হলো, সিলেক্টেড ব্যক্তিদের নিয়ে এর ওপর এক বা একাধিক সেমিনার হবে সেমিনারে সবাই খোলামেলা মতামত দেবেন সেই মতামতের ওপর ভিত্তি করে তিনি প্রবন্ধটি আবার লিখবেন তারপর সেটি আবার কমিটিতে পেশ হবে কমিটিতে পাশ হওয়ার পর তা বই আকারে ছাপা হবে যতদূর মনে আছে, সেমিনারে ছিলেন জনাব আবুল আসাদ, একেএম নাজির আহমদ, জামেদ আলী, সিদ্দিক জামাল, মতিউর রহমান মল্লিক, আসাদ বিন হাফিজ সেই সেমিনারের ফসল "ইসলামী সাহিত্যঃ মূল্যবোধ ও উপাদান" এটিই ছিল আমাদের প্রেরণার একমাত্র হাতিয়ার আমরা বইটি বার বার পাঠচক্র করে বুঝতে চেষ্টা করেছি অন্যদের বুঝানোর চেষ্টা করেছি

দ্বিতীয় হাতিয়ারটি পাই আমরা মাসিক কলমের সৌজন্যে কলম সম্পাদনা করেন কবি মতিউর রহমান মল্লিক তাঁর পরিচিত এক ভাই নাম সম্ভবত মহিবুল্লাহ মিশরে আল আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন তিনি শিল্প সাহিত্য সম্পর্কিত মহানবীর সা. চল্লিশটি হাদীসের সন্ধান পান বিষয়টি মল্লিক ভাইকে জানালে তিনি ওটি দ্রুত অনুবাদ করে পাঠাতে বলেন এবং সেটি পাওয়ার পর কলমে প্রকাশ করেন কিন্তু কলম মাসিক পত্রিকা বলে এবং সার্কুলেশন কম থাকায় এ হাদিসগুলো তেমন প্রচার পায়নি

এ ক্ষেত্রে তৃতীয় হাতিয়ারটি আমরা পাই কবি মুকুল চৌধুরী ও আসাদ বিন হাফিজের যৌথ সম্পাদনায় "রাসুলের শানে কবিতা" নামক গ্রন্থ থেকে এখানে কলমের সেই হাদীসগুলো ব্যাখ্যা ও প্রাসঙ্গিক আলোচনাসহ চৌষট্টি পৃষ্ঠার একটি দীর্ঘ সম্পাদকীয় ছাপা হয়

এ ছাড়া এ বইতে সাহাবীদের কবিতা, অন্যভাষার কবিতায় বড়পীরসহ বড় বড় বুজর্গানে দ্বীনের কবিতা ছাপার ফলে কাব্যচর্চা যে নিন্দনীয় নয়, তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে এর ফলে কাব্যচর্চা করার যৌক্তিকতাও স্পষ্ট হয় নবীনরাসহ আমাদের মধ্যে আস্থার নবজন্ম হয়

আশির দশককে নিয়ে বই লিখেন কবি মজিদ মাহমুদ সবচে বৃহৎ কাজটি করেন কবি হাসান আলীম তিনি আশির প্রায় পঞ্চাশ ষাটজন কবির কবিতা এক মলাটে আবদ্ধ করেন যাদের প্রায় প্রত্যেকেই বিশ্বাসী মননশীল লেখায় বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে তোলেন তিনি নব্বই দশক নিয়েও চমৎকার প্রবন্ধ রচনা করেন কবি মুকুল চৌধুরী সাহিত্যে ইসলামের প্রভাব নিয়ে বই লিখেন, যা ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে মুদ্রিত হয়

সাহিত্য সংস্কৃতি কেন্দ্র প্রতি বছরই সীরাত উপলক্ষে সমৃদ্ধ সীরাত সংকলন প্রকাশ করে সে সব সংকলনে আশির দশক নিয়ে নানা প্রবন্ধ প্রকাশ পায় সোলায়মান আহসান আশির দশক নামে কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করে কিছু নিবন্ধ কবি মোশাররফ খানও লিখেন কিন্তু তার কলমের যে ধার সে তুলনায় তা আমার কাছে অপর্যাপ্ত মনে হয়েছে এ ক্ষেত্রে সোলায়মান আহসান ও মোশাররফ হোসেন খান নতুন করে কলম ধরলে আমরা আরো অনেক কিছু জানতে পারবো

আশির দশকের এই বিপ্লবী কাফেলার প্রথম কবিতার বইয়ের নাম "শ্বাপদ অরণ্যে অগ্নিশিশু" কবির নাম হাসান আলীম বইটি বেরোয় কবির মায়ের জমানো টাকায়।।

এ বইয়ের একটু ইতিহাস আছে বইটি বেরোনোর আগেই আমরা কয়েকজন পান্ডুলিপিটি পাঠ করি তারপর আমরা একনাগাড়ে কয়েকদিন একসাথে বসে লাইন বাই লাইন পড়ি ও এডিট করি যতদূর মনে পড়ে হাসান আলীম ছাড়াও এ আড্ডায় ছিলেন কবি মতিউর রহমান মল্লিক, আসাদ বিন হাফিজ, বুলবুল সরওয়ার ও মুকুল চৌধুরী মোশাররফ হোসেন খান তখনো ঢাকা আসেননি, তিনি তখন যশোরের একটি মাসিক পত্রিকার সাথে যুক্ত সোলায়মান আহসান কি কারণে যেন ঢাকায় ছিলেন না

বইটির প্রচ্ছদ করেন একজন প্রফেশনাল আর্টিস্ট সম্ভবত তখন তিনি দৈনিক আজাদের স্টাফ আর্টিস্ট নাম মোহাম্মদ নূরুল ইসলাম তিনি লাল কালোতে চমৎকার একটি বাইকালার কভার করেন

আগেই বলেছি, "শ্বাপদ অরণ্যে অগ্নিশিশু" ছিল আমাদের যৃথবদ্ধ স্বপ্নের প্রথম কবিতার বই যদিও বইটি ছিল হাসান আলীমের, বইটি বেরোনোর পর মনে হলো ওটা আমাদেরই বই আমি তখন ঢাবির বাংলায় মাস্টার্স করছি, হাসান আলীম সাইন্স ফ্যাকাল্টিতে থাকে আমরা বন্ধুরা একেকজন দশ বারোটা করে বই নিয়ে বের হই এবং তা বিক্রি করে টাকা জমা দেই আলীমের কাছে, যাতে মায়ের আদরের ছেলে মায়ের টাকা ফেরত দিতে পারে আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সে সময়কার ছাত্রী বোনদের কাছে কৃতজ্ঞ, ছাত্রদের চাইতেও ছাত্রীদের কাছে বইটি বেশী জনপ্রিয় ছিল ছাত্রী বোনরা নিজেরা আগ্রহ করে বই নিয়ে ডিএমসি ও বুয়েটে গিয়ে ফেরি করতেন এভাবে অল্পদিনেই বইটি ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে

শ্বাপদ অরণ্যে অগ্নিশিশুর সাথে আমরা আরো একটি বইয়ের প্রচ্ছদ ছাপিয়ে ছিলাম বইটি ছিল ছড়ার নাম রাজপথের ছড়া এর কভারও নূরুল ইসলাম ভাইয়ের করা এবং বেশ চমৎকার  লাল জমিনের ওপর এ্যাশ কালারের কয়েকটি চমৎকার কলম সম্পাদনা করেছিলেন জনাব মাসুদ মজুমদার ও আসাদ বিন হাফিজ বইটির শুরুতেই ছিল তুখোড় ছড়াকার আবু সালেহের সেই বিখ্যাত ছড়াঃ

ধরা যাবেনা ছোঁয়া যাবেনা  বলা যাবে না কথা

রক্ত দিয়ে পেলাম শালার মরার স্বাধীনতা

এ ছাড়াও যতদূর মনে পড়ে এতে ছড়া দিয়েছিলেন মাহবুব মোরশেদ, সৈয়দ মুসা রেজা, মহিউদ্দিন আকবর, মতিউর রহমান মল্লিক, আসাদ বিন হাফিজ, বুলবুল সরওয়ার ও আরো কয়েকজন এটি একটি প্রতিবাদী ছড়ার সংকলন রাজপথের ছড়া সে সময় বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল ছড়াগুলোতে পা চুলকানোর চাইতে বারুদের উত্তাপ বেশী ছিল আমাদের সামনে তখন আল মাহমুদের মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো, বখতিয়ারের ঘোড়া টগবগ করে ছুটছে সেইসব উত্তেজনাময় সময়গুলো ছিল সত্যি অনন্য (চলবে)

২৬শে জুলাই ২০২০ : বিকাল ৫টা

যেতে হবে আরো বহু দূরঃ ০৪

আশির দশক শব্দটা মনে এলেই মনটা কেমন অন্যরকম হয়ে য়ায় কত বেদনারা গুমরে মরে মনের গহীনে আনন্দরা হেসে যায় ঝর্ণার কলতানের মত অর্জনগুলো দেখলে ভাল লাগে এই ভেবে, একদিন এই শুভ প্রয়াসের সাথে আমিও ছিলাম আবার যা যা স্বপ্ন ছিল, তা বাস্তবায়িত করতে না পারার মনোবেদনাও কম নয় এরই নাম জীবন জীবনের সকল চাহিদা পূরণ করে মারা গেছে এমন লোক পাওয়া যেমন কঠিন, তেমনি কোন সাধই পূরণ হয়নি এমন লোক পাওয়াও দুষ্কর

অধিকাংশ মানুষকেই অতৃপ্তি নিয়ে চলে যেতে হয়, এটাই বাস্তবতা আশির জ্যোতিজোস্নার কবিকন্ঠ হয়ে যারা একদিন একত্রে হাঁটতে শুরু করেছিলাম, আজ আর সে যুথবদ্ধতা নেই আমাদের সিপাহসালার কবি মতিউর রহমান মল্লিক প্রভুর ডাকে সাড়া দিয়ে চলে গেছেন ওপারে আমাদের অনুজপ্রতীম বন্ধু কবি গোলাম মোহাম্মদের মত সরল মানুষটিও আমাদের এক যাতনাময় বিশ্বে রেখে বিদায় নিলেন যেন না পারার কষ্ট তিনি আর বইতে পারছিলেন না চলে গেলেন আমাদের মুরুব্বী একেএম নাজির আহমদ আমাদের গুরু জনাব আবদুল মান্নান তালিবও চলে গেলেন না ফেরার দেশে মনে কি পড়ে কথাশিল্পী জামেদ আলীর নাম? যিনি হঠাৎ করেই এসে লালশাড়ি ও মেঘলামতির দেশে উপহার দিয়ে আমাদের চমকে দিয়েছিলেন কয়জনের নাম বলবো? আমরা কি ভুলে গেলাম দরদী প্রিয় মানুষ সিদ্দিক জামালকে? যার দরদী হাতের ছোঁয়া না পেলে অনেক ফুলই হারিয়ে যেতো সংস্কৃতির এ ময়দান থেকে মনে পড়ে বাংলা সাহিত্য পরিষদের জন্মলগ্নে যে হাসিমাখা মুখটি আমাদের অভয় দিয়ে বলেছিল, যারা কাজ করে ভুল তাদেরই হয় সব কাজে অনুমতির দরকার নেই, কাজ করে যাও ভুল হলে আমরাই ডেকে বলে দেবো, কোন পথে হাঁটবে সেই অভয়বানী শোনার জন্য কোথায় পাবো মোল্লা ভাইকে?

সম্ভবত উনিশশ তিরানব্বই সালের ঘটনা সাপ্তাহিক বিচিত্রায় ইসলামী সংস্কৃতির উত্থান নিয়ে একটি কভারস্টোরি প্রকাশ পায় তাতে আশংকা প্রকাশ করা হয়, জনৈক মীর কাসেম আলীর তত্ত্বাবধানে দেশে যে ইসলামী সাংস্কৃতিক তৎপরতা চলছে, তা বড় ভাবনার বিষয় দিন দিন তাদের তৎপরতা বেড়েই চলেছে মতিউর রহমান মল্লিক ও আসাদ বিন হাফিজের মাধ্যমে এ কাজ চললেও এর নেপথ্য নায়ক মীর কাসেম আলীগং একদিন এ চারাগাছ মহীরুহ হয়ে উঠতে পারে আজ সে মীর কাসেম আলীও নেই, মল্লিকও নেই কিন্তু তাদের চারাগাছ ঠিকই মহীরুহ হয়ে উঠেছে

ইসলামী সংস্কৃতির এ বিস্তার ছিল সময়ের দাবী এ দেশের সাধারণ মানুষ নষ্টামীর সয়লাব দেখে আতংকিত হয়ে পড়েছিল তাই সত্য ও সুন্দরের স্বপ্ন তারা দেখা শুরু করেছিলেন নষ্টামীর বৃক্ষ এখন ফল দিতে শুরু করেছে সেই ফল ভোগ করছি আমরা কিন্তু এটাই পৃথিবীর শেষ ঠিকানা নয় একদিন বুড়ো বটবৃক্ষ ম্রিয়মান হবে তরতর করে বেড়ে উঠছে যে বৃক্ষ তাতে নতুন ফল ধরবে শান্তি ও সুবাতাসে ভরে উঠবে দুনিয়া জাহান

সময়ের এ কাজ কেউ না কেউ করতোই এ মীর কাসেম আলী নাই, অন্য মীর কাসেম আলী আসবে এ মল্লিক নাই, হাল ধরবে অন্য কোন মল্লিক পৃথিবী তার পথে এগিয়ে যাবেই সময়ের গতি কেউ রোধ করতে পারে না

মনে রাখবেন, মানুষ মারা যায়, স্বপ্ন মরে না স্বপ্ন কাল থেকে কালান্তরে ঘুরে বেড়ায় সে শুধু অপেক্ষা করে উপযুক্ত সময়ের সময় হলে কেউ কাউকে আটকে রাখতে পারে না তিরানব্বই হাজার সৈন্য যেমন বাংলাদেশের স্বাধীনতা আটকাতে পারেনি তেমনি কোটি জনতার কান্না দিয়ে আটকানো যায় না গৌরবের শাহাদাত যা অবধারিত তা ঘটবেই

আশির জ্যোতিজোস্নার কবিকন্ঠের বড় অর্জন সঠিক সময়ে সময়কে ধারণ করতে পারা তারা নিজেরা শপথদীপ্ত হতে পেরেছে নিজের সময়কালের লেখকদের আশান্বিত করতে পেরেছে প্রবীণদের মনে সাহস বুনতে পেরেছে আর নবীনদের দিতে পেরেছে অভয়

তাদের সবচে বড় অর্জন সুন্দরের স্বপ্ন আঁকড়ে ধরতে পারা আমরা যে খুব বড় কিছু নই, আমরাও জানি, আপনারাও জানেন কিন্তু আমরা আমাদের চাইতে ভাল যারা লেখেন তাদেরও আপন করতে পেরেছি, আমাদের লেখা দিয়ে প্রতিপক্ষকেও চমৎকৃত করতে পেরেছি, আমাদের পাঠকদেরও আকৃষ্ট করতে পেরেছি আমরা কবিতা দিয়ে যাত্রা করলেও কবিতার মাঝেই আটকে থাকিনি আমরা ছড়িয়ে পড়েছি সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় বুলবুল সরওয়ারের মত ভ্রমণ কাহিনী বাংলা সাহিত্যে কয়টা পাবেন? গোলাম মোহাম্মদের মত হৃদয়কাড়া গান?

এটাও সত্য, আমরা একজন শাহজাহান পেয়েছিলাম সে জন্যই আমরা তাজমহল বানাতে পেরেছি তিনি যেমন মতিউর রহমান মল্লিকের মত হীরকখন্ড দিয়ে এ সৌধ নির্মাণ করিয়েছেন, তেমনি সে সৌধের আসবাবগুলো ঝকঝকে তকতকে করার জন্য আবদুল হাই শিকদারের মত কারিগরও জোগাড় করেছিলেন আমাদের আশার দিক হচ্ছে, আমরা আমাদের সামনে কিছু উজ্জ্বল তারকা দেখতে পাচ্ছি যদি তারা নিবিষ্ট মনে লেগে থাকেন, তবে তারা আমাদের চাইতেও ভালভাবে এ স্বপ্ন এগিয়ে নিতে পারবেন কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, তারা কতটুকু লেগে থাকতে পারবেন

বেশী উজ্জ্বল তারকা ধুমকেতুর মতই আসে এবং হারিয়ে যায় ধ্রুবতারা জ্বলে মিটমিট করে কিন্তু সে থাকে অনড় অটল তেমনি সাহিত্যেও একই ঘটনা ঘটতে পারে বেশী প্রতিভাবানরা প্রতিভার দেমাগে নষ্ট হয়ে যেতে পারে আবার আরো দীপ্তিমান হয়ে উজ্জ্বল আলোও বিকিরণ করতে পারে

আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে ইশাররফ হোসেনের কথা কী সপ্রতিভ ছেলে এখন পড়ে আছে বিদেশে জানি না, সে আমাদের কি দেবে? বগুড়ার সাজ্জাদ বিপ্লব তুখোড় ছড়াকার উচ্চতর স্বপ্ন নিয়ে এখন বিদেশে

আশির দশকের সূচনাপর্বের কথা প্রতি সপ্তাহে সাহিত্য সভা করে যাচ্ছি আজিমপুর থেকে তিনটি রত্ন আসে তাদের দেখি আর মুগ্ধ হই খন্দকার নজরে মওলা, হোসেনুজ্জামান আল আমীন, খন্দকার রাশিদুল হাসান তপন যদি আমাদের মত কম প্রতিভাধর হতো তবে হয়তো তারা দেশেই পড়ে থাকতো কিন্তু না, প্রতিভা তাদের বড় পরিসরে নিয়ে গেল যেমন সুখে আছে নাসির মাহমুদ, শাকিল রিয়াজ এবা

একজন সৃষ্টিশীল মানুষ দিনের পর দিন ঘুমিয়ে থাকতে পারে, এটা অবিশ্বাস্য কিন্তু এরকম ঘটনাও ঘটে জিলিপি সম্পাদক আহমদ মতিউর রহমান, একদার বুদ্ধিজীবী মীযানুল করীম, সিলেটের নারী লেখিকা রোকেয়া খাতুন রুবী, এরকম কতজনই তো দেশে থেকেও ডুব মেরে আছেন অথচ আশার বাতি জ্বালিয়ে এখনো আমরা তাদের খুঁজি

এরকম দুঃখ খুঁজলে কত দুঃখ আশেপাশে ঘুরতে দেখি আশির কাব্যান্দোলনের সবচে বড় ব্যর্থতা নিজেদের লোকচক্ষুর সামনে আনতে না পারা মায়ের জমানো পয়সায় হাসান আলীর বই বের করার পর প্রায় পঞ্চাশ হয়ে গেল তারপর সবাই সাধ্যমত বই বের করেছে, কিন্তু কেউ বউয়ের জমানো টাকা হাতিয়ে, কেউ ভাবীর মানিব্যাগ কেটে, নানা ভাবে, নানা ধান্ধায় যে স্বপ্নের পিছনে আমরা ছুটে চলেছি সেই স্বপ্ন আমরা কখনো জাতিকে দেখাতে পারিনি

লেখকরা লেখে নানা বিষয়ে সব লেখাই কি স্বপ্ন পূরণের সহায়ক হয়? ব্যক্তিগত বিষয়াবলী, সামাজিক বিষয় কতকিছুইতো থাকে কবিতায় পাঁচমিশালী লেখা দিয়ে তিন ফর্মার ২০০ বই ছেপে আমরা কবিত্ব জাহির করি তারপর সে বই মামারে, খালারে, নেতারে সৌজন্য না দিলে কবি হয়ে যায় কিপ্টা, বেয়াদপ গত পঞ্চাশ বছরের অর্জন এতটুকুই

এই আন্দোলনের যারা অগ্রসেনানী তাদেরই যখন এই অবস্থা তখন তাদের ডাকে যারা এগিয়ে এসেছিল তাদের মনে ভীতি দেখা দেয় যদি জিজ্ঞেস করি, ভাই কতদিন দেখা নেই, কেমন আছেন? তিনি এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখেন কেউ দেখে ফেললো কিনা, তারপর, কানের কাছে মুখ এনে বলেন, ভাই আপনি জানেন, আপনাকে আমি কত ভালবাসি এভাবে প্রকাশ্যে দেখা হোক এটা চাই না, কারণ আপনাদের সাথে মেলামেশা করলে নানা পত্রিকা আমাকে ব্ল্যাকলিস্ট করে ফেলবে তখন তারা আর আমাদের লেখা ছাপবে না

নবীনরা আমাদের স্বপ্নের কথা শুনে খুব আগ্রহ নিয়ে এগিয়ে আসে কিছুদিন গেলে আমাদের দুরাবস্থা যখন বুঝতে পারে, তখনি চম্পট দেয় বলি, পালাও কেনো? তখন ইনিয়ে বিনিয়ে যা বলে তার মর্ম দাঁড়ায় এই, আপনাদের পত্রিকা তো আমাদের চেনে না  আপনারা আছেন আপনাদের স্বপ্ন নিয়ে, তারা আছে তাদের জগত নিয়ে আপনারা তো সেই যোদ্ধা যারা অস্ত্র বাড়িতে রেখে ময়দানে যায় যুদ্ধ করতে আপনি যে ময়দানে এলেন, আপনার অস্ত্র কই?

আবদুল মান্নান সৈয়দ ফররুখ আহমদের শ্রেষ্ঠ কবিতা বের করে শিখিয়ে দিয়ে গেলেন, স্বপ্ন যদি ছড়াতে চাও, এভাবে স্বপ্নগুলো জমা করে ছড়িয়ে দাও সারাদেশে মানুষ তখন বুঝতে পারবে, মল্লিকের স্বপ্ন কি, আলীমের স্বপ্ন কি  মানুষ বুঝতে পারবে আশির দশক এ জাতিকে কোথায় নিয়ে যেতে চায়? কিন্তু বিগত পঞ্চাশ বছরে মল্লিক, আসাদ, আলীম, বুলবুল, সোলায়মান, মুকুল বা মোশাররফ হোসেন খান কারো একটা "শ্রেষ্ঠ কবিতার " সংকলন কি আপনারা দেখেছেন? না, দেখেননিএটাও আমাদের অর্জন আপনি যদি চান, এভাবেও আশির দশককে মূল্যায়ন করতে পারেন

মল্লিক নেই, গোলাম মোহাম্মদ নেই, বুলবুল সরওয়ার থেকেও নেই, সোলায়মান আহসান খালি বড় বড় কথা বলে, মুকুল মফস্বলে, আলীম বেশী সাদাসিধা, আসাদ অসুস্থ আছে এক মোশাররফ হোসেন খান সে গেলে আশির ঘরে ধোঁয়া দেয়ারও কেউ থাকবে না

কে হাল ধরবে তখন? তাদের গড়ে তোলার কোন ব্যবস্থা কি হয়েছে? তাদেরকে মাঠে ছেড়ে দিলে তারা কি গন্ধ শুঁকে শুঁকে নিজের ঘরে ফিরতে পারবে?

না, এতটা নিরাশ হওয়ার সময় এখনো আসেনি মুমীন কখনো নিরাশ হয় না বললে এরকম অনেক কথাই বলা যায় কি দরকার এটুকু বললাম এ জন্য, যাতে আমাদের ভুল থেকে পরবর্তীরা শিক্ষা নিতে পারে শুনেছি, মুমীন একই গর্তে বার বার পা দেয় না ইতিহাসই বলবে আমরা কোথায় যাবো সিলেটের রাগিব হোসেন চৌধুরীর কথা দিয়ে আজকের পর্ব শেষ করি তিনি একটি উপন্যাস লিখেছিলেন, মুক্তির ময়দান কখনো নিরব থাকে না আমরাও বিশ্বাস করি, মুক্তির ময়দান কখনো নিরব থাকে না

আসুন আমরা প্রার্থনা করি, আল্লাহ, তুমি আমাদের জন্য আরেকজন মীর কাসেম ও মল্লিক পাঠাও

২৮শে জুলাই ২০২০ : ১টা

যেতে হবে আরো বহু দূরঃ ০৫

যেতে হবে আরো বহু দূর, মানে আমরা অনেকটা পথ পেরিয়ে এসেছি কিন্তু আমরা যে যাচ্ছি এটাই কি ঠিকানায় যাওয়ার সঠিক পথ? নাকি ভুল পথে হাঁটছি? কখনো কি পথিকের মনে এমন দ্বিধাদ্বন্দ্ব জাগতে পারে না? যদি আপনি মনে করেন, পারে, তবে পথিকের চলার গতি সামান্য হলেও শ্লথ হয় চলার পথে প্রতি পদক্ষেপে এমন সতর্ক থাকাটাই বুদ্ধিমানের কাজ

কথাটা এ জন্য বললাম, আপনিও জানেন মানুষমাত্রই পাপী নবী রাসুল ছাড়া আর কেউ বলতে পারে না, আমি পাপী না আমি জানি, আমিও পাপী, আপনিও পাপী কিন্তু সেই পাপের কথা আমরা জনে জনে বলে বেড়াই না ইসলামের নির্দেশও তাই রাসুল সা. আমাদের জানিয়েছেন, আপনি যদি কারো দোষ গোপন করেন তবে আল্লাহও আপনার দোষ গোপন করবেন

আবার পবিত্র কোরআনে আল্লাহ নিজেই সত্য গোপন করতে নিষেধ করেছেন এর ফলে অনেক কম বুদ্ধিমান মানুষই দ্বিধায় পড়ে যান কারো গীবত করাকে আল্লাহ প্রচন্ড অপছন্দ করেন তিনি এটাকে মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়ার সাথে তুলনা করেছেন এখন আপনি কি করবেন? আপনি কি সত্য গোপন করবেন, নাকি সব বলে বেড়াবেন?

আসলে আমি এতই কম বুদ্ধির মানুষ, এরকম সমস্যায় পড়লে আমি হতবুদ্ধি হয়ে পড়ি চালাক মানুষরা এমন সুযোগ কাজে লাগিয়ে তরতর করে এগিয়ে যায়, আর ভাবে কী অর্জনটাই না সে করলো?

এ রোগ মানুষের আদি রোগ ইসলাম অনুসারীদের মধ্যেও এ ধরণের চালাক লোকের কখনো অভাব হয়নি এটা ইসলামের প্রাথমিক জামানায়ও ছিল, আজো আছে এর মধ্য দিয়েই আমাদেরকে হেঁটে যেতে হয়

এ ক্ষেত্রে পর্যায়ক্রমে সাধ্যমত সংশোধনের প্রচেষ্টা চালানো দরকার কোন সামষ্ঠিক বিষয়, যা প্রকাশ করলে সমাজের কোন কল্যাণ হতে পারে, তা প্রকাশ করে দেয়াই সঙ্গত অবশ্য এ কথাটা বুঝতে আমার বহুদিন সময় লেগেছে

আশির দশকের প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তি নিয়ে কথা বলছিলাম জ্যোতিজোস্নার কবিকন্ঠ হয়ে কাজ করতে গিয়ে তিন ধরনের লেখকের সাক্ষাৎ পেয়েছি আপনার এর যে কোনটি বেছে নেয়ার স্বাধীনতা আছে, কারণ এ স্বাধীনতা আপনি আপনার প্রভুর কাছ থেকে পেয়েছেন মহান আল্লাহ এর কোনটা ভাল সেটা বুঝার জন্য আপনাকে বিবেক দিয়েছেন

এ তিন দলের একদল হচ্ছে তারা, যারা মন্দ কথা বলতে আনন্দ পায় তারা মন্দ কথা বলে এবং নিজেও মন্দ কাজে নিজেকে জড়িয়ে রাখে

আরেকদল হচ্ছে তারা, যারা মনে করে পৃথিবীর সব মানুষের ভাল হয়ে যাওয়া উচিত তাতে সমাজে শান্তি ফিরে আসবে শুধু আমার জন্য মন্দের রাস্তাটা খোলা থাক আমার মত দুয়েকজন মন্দের মাঝে ডুবে থাকলে সমাজের তেমন ক্ষতি হবে না

আরেকদল মনে করে, লেখকরা হচ্ছে সমাজে ফুলের বাগান তারা তাদের রূপলাবন্য ও সুবাস দিয়ে যদি পৃথিবীকে আনন্দময় করে তুলতে না পারে তবে লেখক হয়ে লাভটা কি?

আলহামদুলিল্লাহ সমাজে যে নৈতিকতাবোধ ও মানবিক মূল্যবোধ আছে তাতে শেষোক্ত দলের লেখকই সমাজে বেশী এখনো শিক্ষক ও লেখকদের মধ্যে সামাজিক কল্যাণ চিন্তাই বেশী

এবার আমাদের কথা বলি আমরা যারা আদিতে এ আন্দোলনে শরীক হয়েছিলাম, আমাদের সবার মেধা, যোগ্যতা, প্রতিভা, মনন ও বোধের মাত্রা সমান নয় আমি এ আন্দোলনকে ততটাই বুঝেছি, যতটুকু বোঝার ক্ষমতা আল্লাহ আমাকে দিয়েছেন যার প্রতিভা ও বোধশক্তি আমার চাইতে বেশী তিনি হয়তো অন্যভাবে বুঝেছেন যার ডেলিভারী পাওয়ার বেশী তিনি সমাজ ও আন্দোলনকে বেশী দিয়েছেন

কিন্তু এ ব্যাপারে সবাই একমত হবেন, আমরা কেউ নিজের সাথে প্রতারণা করিনি কেউ আমাদের তুলে ধরবে এ আশায় কেউ বসে থাকিনি রাগ বা অভিমান করে স্বপ্ন ভুলে গালে হাত দিয়ে বসে থাকিনি কে কতটা কি দিল সে দিকে তাকিয়ে থাকিনি আমরা আমাদের যোগ্যতা অনুযায়ী, সামর্থ্য অনুযায়ী সর্বোত্তমটা দেয়ার চেষ্টা করেছি, এখনো নিরন্তর করে যাচ্ছি

চলার পথে আমরা কত জনের সহায়তা পেয়েছি তার ইয়ত্তা নেই আমরা কবি গোলাম মোস্তফার পরিবারের সহায়তা পেয়েছি, কবি তালিম হোসেনের পরিবারের সহায়তা পেয়েছি সৈয়দ আলী আহসান, ড. আশরাফ সিদ্দিকী, মোহাম্মদ মাফফুজউল্লাহ, কবি আবদুস সাত্তার, জাহাঙ্গীর ফিরোজ, শাহীন রেজা, এরকম কতজন কতভাবে সহায়তা করেছেন ইনকিলাবের মাওলানা রুহুল আমীন, মসউদ উশ শহীদ, খালেক বিন জয়েনউদ্দিন এভাবে অনেকের নামই বলা যায় আসলে গণসমর্থন ছাড়া কোন বিপ্লবই সফল হয় নাআমরা লেখক, পাঠক, বুদ্ধিজীবী সবারই সমর্থন ও সহযোগিতা পেয়েছি জয়নুল আবেদীন আজাদ, মাহবুবুল হক, অধ্যাপক মতিউর রহমান, বাংলা একাডেমীর সিরাজউদ্দিন এরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আমাদের সাথে কাজ করেছেন কবি আবদুল হাই শিকদার, রেজাউদ্দিন স্টালিন এবং তাদের বন্ধুরা সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে আমাদের ধন্য করেছেন কিশওয়ার ইবনে দিলাওয়ার, নূরুল আলম রইসী, নয়ন আহমদ, শেলী নাজ, জোবায়দা গুলশান আরা, আল মুজাহিদী, আসাদ চৌধুরী, আবদুল মুকীত চৌধুরী, নামের কি আর শেষ আছে?

আমাদের সবারই স্বপ্ন এবং প্রত্যাশা ছিল, আমরা সাহিত্যে সুবাতাস বইয়ে দেবো আমরা সমাজের জন্য ক্ষতিকর, অন্যায় ও মন্দকে প্রমোট করবো না ভালোর স্বপক্ষে হবে আমাদের অবস্থান

আগেই বলেছি, এ স্বপ্নটা উদ্বোধন করেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল ছাত্র তাদের গড়া বিপরীত উচ্চারণ ছিল এ স্বপ্নের ফেরিওয়ালা তারা অল্পসময়ের মধ্যে এটিকে জাতির মধ্যে রোপন করে দিয়ে বিদায় নেয়

হয়তো তারা এখন গায়, "কফি হাউজের সে আড্ডাটা আজ আর নেই " ছাত্রদের এ সাফল্য দেখে এটাকে বৃহত্তর পরিসরে নিয়ে যাওয়ার জন্য গঠিত হয় বাংলা সাহিত্য পরিষদ এটা ছিল এক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত  বছর বছর ছাত্রদের ছাত্রজীবন শেষ হয়ে যায় এ ধরনের একটি স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য দীর্ঘমেয়াদী ও অবকাঠামো সমৃদ্ধ আয়োজন দরকার কেন্দ্রের তত্ত্বাবধানে বাংলা সাহিত্য পরিষদ সেই সুদূরপ্রসারী স্বপ্নের ফসল প্রবীণের চিন্তা ও নবীনের উদ্যম কাজে লাগিয়ে শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির ময়দানে ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটানোর স্বপ্নবোনার নেপথ্য কারিগরদের এই শুভ উদ্যোগ আল্লাহ কবুল করুন

২৯শে জুলাই ২০২০

যেতে হবে আরো বহু দূরঃ ০৬

বিপরীত উচ্চারণ থেকে কি করে বাংলা সাহিত্য পরিষদ এলো, কেন এলো, এটা নিশ্চয় আঁচ করতে পেরেছেন আমার আগের লেখায় এটা ছিল সময়ের দাবী আর এই বাংলা সাহিত্য পরিষদ আমাদের মনে যে আশার আলো জ্বালায় তাতে আলোকিত হয়েছিল আমাদের হৃদয়, সাহসে উচ্চকিত হয়েছিল নবীন কাফেলা

সাহিত্যে সুবাতাস বইয়ে দেয়ার মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়েছিল তরুণ লেখক সমাজ আরবে যেমন আইয়ামে জাহেলিয়াত বা অন্ধকার যুগের অমানিশা দেখে ইসলামে এসে আশ্রয় নিয়েছিল পাপবিদগ্ধ সমাজ তেমনি মন্দের ভয়াবহতা আঁচ করে শুভ ও কল্যাণের প্রত্যাশায় আমাদের সমাজও ছিল উন্মুখ ফলে আশির জ্যোতিজোস্নার কবিরা অনুকূল জোয়ারেই নৌকা ভাসিয়েছিল আর সে জন্যই তাদের আশা ও স্বপ্ন ছিল আকাশ সমান বাংলা সাহিত্য পরিষদ ছিল তাদের সে স্বপ্নের আলোঘর

আল মাহমুদের বখতিয়ারের ঘোড়া বাংলা সাহিত্যের প্রচলিত ধারার কোন কাব্য ছিল না এর বানী, সুর, বলার ধরণ সবটাই ছিল প্রচলিত ধারার সম্পূর্ণ বিপরীত আমরা এতদিন কবিতায় শুনেছি, ইসলামকে কিভাবে গালি দিতে হয়, এবার শোনলাম মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার উদাত্ত আহবান কবিতায় কিকরে সত্য ও সুন্দরের আহবান জানাতে হয়, তা আমাদের শিখিয়ে দিলেন বাংলা কাব্যের মুহাম্মদ বিন কাসিম কবি আল মাহমুদ সপ্তরথীর সাথে লাব্বাইক বলে শামিল হলেন গোলাম মোহাম্মদ,  শরীফ আবদুল গোফরান, নাসির হেলাল প্রমুখ এরাই হলেন তার বখতিয়ারের ঘোড়া বাংলা সাহিত্যে জ্বলে উঠলো নতুন আলোর মশাল

এরপর কোরান ও হাদীস মন্থন করে আবদুল মান্নান তালিব ইসলামী সাহিত্য মূল্যবোধ ও উপাদান গ্রন্থে বললেন, যা অনৈলামিক নয় তাই ইসলামিক যা হারাম নয় তাই হালাল আমরা জেনে গেলাম ইসলামী সাহিত্যের পরিধি জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি আমরা যা করি সবই হালাল, শুধু আল্লাহ যা করতে নিষেধ করেছেন সেটুকু হারাম কি উদার ও ব্যাপক দৃষ্টিভঙ্গি প্রেম করবেন, করেন প্রেম করার জন্যই তো আল্লাহ মা হাওয়াকে বানিয়ে ছিলেন বাবা আদমের জন্য আপনার ভাষা ব্যবহার ও বর্ণনাভঙ্গি কেমন হবে তা জেনে নেন কোরআন থেকে পড়ুন সুরা ইউসুফ

এভাবেই আমরা পৃথিবী সমান বড় কর্মক্ষেত্র পেলাম সাহিত্য চর্চার জন্য এলেন কথাশিল্পী জামেদ আলী আমাদের হাতে তুলে দিলেন লাল শাড়ি বললেন, এই হচ্ছে তার নমুনা তুমি চাইলে এই লাল শাড়িকেও নিশান বানাতে পারো এরপর আমরা বের করলাম আল্লাহর পথের সৈনিক মিশরের নাজিব কিলানী অসামান্য উপন্যাসের অনুবাদ

এভাবেই আমরা আমাদের স্বপ্নের স্বপক্ষে সাহিত্যের উদাহরণ তুলে ধরলাম জাতির সামনে জাতি বিস্মিত, অভিভুত আমরা আনন্দিত আমাদের পাঠক ও পৃষ্ঠপোষকরা উল্লসিত

তার পরের কথা বলার আগে বুদ্ধিমান জামাইয়ের গল্পটা বলে নেই জামাই অনেক বড়লোক আলীশান বাড়ি প্রচুর চাকর বাকর বিয়ে করেছে গ্রামের এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জামাই শুধু বড়লোক না, পন্ডিত মানুষও রাতে খাওয়া দাওয়ার পর তিনি গেলেন শুইতে জামাইকে শোয়ার ঘরে দিয়ে  বউ নিজে খেতে গেল এটাই দেশের নিয়ম আগে পুরুষরা খায়, পরে মেয়েরা

বউ খাওয়া দাওয়া করে একটু সেজেগুঁজে শুতে গেল গিয়ে দেখে জামাই বাবু তখনো বিছনায় যাননি একটা চেয়ারে বসে বসে ঝিমুচ্ছেন বউ বললো, একি, তুমি এখনো শোয়নি? বসে বসে ঝিমুচ্ছ কেন? জামাই মিয়া বললো, শুই কেমন করে দেখ না খাটের চারদিক ঘেরাও দেয়া, ঢুকবো কোথা দিয়ে? বউতো হেসেই খুন বললো, চলো আমার সাথে ঢুকবে বউ গিয়ে মশারি তুলে ফাঁক করে আগে নিজে ঢুকে এরপর বললো, এসো, এবার ঢুকো

এবার জামাইও হেসে দিল বললো, এত সোজা? বউ বললো, তুমি মশারি চেনো না? এটা না টানালে তো মশা খেয়ে ফেলবে তোমাকে জামাই বললো, , তাই বুঝি আমরা তো মশার উপদ্রব থেকে বাঁচতে ঘরে এরোসল দেই

বেশী বুদ্ধিমানদের এরকম হয় রবি ঠাকুরের জুতা আবিষ্কারের কথা মনে নেই? দেশের তাবৎ বুদ্ধিজীবীরা যা পারেনি সেই সমস্যার সমাধান করে দিল সামান্য এক মুচি

সাধারণ মানুষ বোঝে, পাহাড়ধ্বস শুরু হলে সেই পাথর আটকাতে যেতে হয় না তাতে নিজেরই চিড়েচেপ্টা হতে হয় যখন প্রবল বন্যা শুরু হয়ে যায় তখন সেই পানি বুক দিয়ে আটকাতে হয় না তাতে নিজেরই ভেসে যেতে হয় গণজোয়ার শুরু হলে সেখানে বাঁধা দিতে হয় না দিলে তাকে ইরানের রেজা শাহ পাহলভীর ভাগ্য বরণ করতে হয় বুদ্ধিমান ও সাধারণ মানুষ এ জন্যই আলাদা

আশির দশক নিয়ে আমরা যাত্রা করেছি এগিয়ে যাচ্ছি সাঁই সাঁই করে আমাদের অগ্রগতি দেখে সবাই খুশী এসময় কোত্থেকে একদল বুদ্ধিজীবী এগিয়ে এলো তারা মুরুব্বিদের বুঝালো, করছেন কি? দেখছেন না এদের পপুলারিটি দিন দিন কেমন বাড়ছে এ তো বাঁশের চেয়ে কঞ্চি বড়  হবার দশা আপনারা করেন রাজনীতি ওরা আপনাদের দয়ার ভিখিরি আটকান এদের এরপর কি করে আশির এ অগ্রযাত্রা রোধ করা যায় সে বুদ্ধি বাতলে দিল

আমরা এসব বুদ্ধির কিছুই জানলামও না, বুঝলাম না বুদ্ধিমানরা বুদ্ধি দিল, আগে বড় হও, ধনী হও টাকা ছাড়া ভর্তুকি দিয়ে এ হাতি কয়দিন পালা যাবে? আমাদের কোন কোন মুরুব্বি মনে করতো, সাহিত্য ও সংগীত চর্চা, এসব ফালতু কাজ তারাও এই মত সমর্থন করলো  আমরা বড় বড় ভাষণ শোনলাম, সাহিত্য সংস্কৃতি সমাজ বিপ্লবের হাতিয়ার কোন জাতিকে ধ্বংস করতে চাইলে তার সংস্কৃতি ধ্বংস করে দাও তাহলে যুদ্ধ ছাড়াই তোমরা জিতে যাবে তাই  এ অঙ্গনকে কোনভাবেই হেলা করা যাবে না

সাহিত্য সংস্কৃতি অঙ্গনের এ কাজকে আরো জোরালো করতে হবে কিন্তু একটা জনসভা করতে যে পরিমাণ খরচ হয়, একটা পত্রিকা চালাতে যে পরিমাণ খরচ হয়,  সাহিত্য সংস্কৃতি দুটো বিভাগকে সারাবছর চালানোর জন্যও সে পরিমান বাজেট বরাদ্দ হয় না এ ব্যর্থতা আমাদের এটা স্বীকার করতে এখন আর কোন লজ্জা নেই

জানি, সফলতা ব্যর্থতা দুটোই আমাদের আছে কাজ করতে গেলে ভুল মানুষের হবেই মুমীন যখন বুঝতে পারে তার ভুল হয়েছে তখনি সে তওবা করে ভুল থেকে ফিরে আসে আর যে তা স্বীকার করে না, সে হয়ে যায় শয়তান মানুষ ও শয়তানের মধ্যে এটাই পার্থক্য কিন্তু আমরা ভুল বুঝতে বুঝতে পঞ্চাশ বছর পার করে ফেলেছি ফলে, তওবা করারও মওকা পাইনি, ভুলের থেকে বের হওয়াও হয়ে উঠেনি

মনে পড়লো ইমাম সাহেবের নসীহতের কথা তিনি বলছিলেন, শয়তান যখন বুঝে এ ব্যক্তিকে আর পাপের পথে নেয়া যাবে না, সে পূণ্য কাজ করবেই, তখন শয়তান তাকে পাপের পথে আর ডাকে না বলে, আহ, কয়দিনই বা হায়াত, পূণ্য বাড়াও তাফসীর পড়া বাদ দিয়ে তেলাওয়াত করো প্রতি হরফে দশ নেকী বেহেশতে যেতে চাইলে এই দোয়াগুলো আমল করো তোমার বেহেশতে যাওয়া একেবারে নিশ্চিত আপনি তখন মসজিদে বসে দোয়া দরুদে ডুবে যাবেন আর আপনার ছেলে সেই সুযোগে অন্য মেয়ের সাথে প্রেম করবে

আসলে আমাদের এবাদতের কনসেপশন বদলাতে হবে এবাদত হচ্ছে দায়িত্ব পালন মসজিদে মসজিদে চিল্লা দেয়ার নাম এবাদত না নামাজের সময় নামাজ পড়বেন, স্ত্রী সহবাসের সময় সহবাস করবেন, এটার নাম এবাদত আপনি ততটুকু দায়িত্বই নেবেন, যতটুকু আপনি পালন করতে পারবেন আপনি যখন ছিলেন না তখনও দুনিয়া চলেছে, আপনি যখন থাকবেন না তখনো দুনিয়া চলবে পৃথিবীর সব কাজের দায়িত্ব আপনাকে দেয়া হয়নি আপনার ওপর জুলুম করার দায়িত্বও আপনাকে দেয়া হয়নি তাহলে দশটি কোম্পানীর চেয়ারম্যান আপনাকেই হতে হবে কেন? এসব ভাবার বিষয় আপনি জানেন, আল্লাহ মজলুমের পক্ষে, জালিমের বিপক্ষে তাহলে আপনি কোন সাহসে অধীনস্তদের ওপর জুলুম করেন? আপনি যতবড় নেতা, পীর বা আলেম হোন না কেন, আল্লাহর ইনসাফের রশি আপনাকে পাকড়াও করবেই

আমাদের প্রথম ভুল ছিল, নেতার অন্ধ আনুগত্য ওমর রা. লম্বা জোব্বা বানানোর কাপড় কোথায় পেল, এই প্রশ্ন করা আপনার শুধু অধিকার নয়, দায়িত্বও যদি আপনার নজরদারীর দায়িত্ব আপনি ঠিকভাবে পালন না করেন, তবে সমাজে যে পাপ অনুষ্ঠিত হবে তার দায়ভাগ আপনাকেও নিতে হবে কারণ আপনার গাফলতির সুযোগেই এ পাপ সংগঠিত হয়েছে আপনার কর্মচারী চুরি করলে সে দায়িত্বও আপনাকেই নিতে হবে কারণ চুরি রোধের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা আপনি নেন নি

বেশী কথা বলে ফেলছি কিন্তু জীবন এমনই জীবনকে সহজ করুন, জীবন হবে  আনন্দময় কঠিন করুন, কষ্টের পর কষ্ট আপনাকে জড়িয়ে ধরবে আপনার গাড়ি নেই, মানে আপনার গাড়ি হারাবার ভয়ও নেই  অঢেল সম্পদ নেই, দারোয়ান রাখার ঝক্কি ঝামেলাও নেই যতই আপনার সম্পদ কম, ততোই কষ্টও কম যে মানুষ বেহুদা কষ্ট করে সম্পদ বাড়ায়, সে পয়সা দিয়ে দুশ্চিন্তা কেনে সাথে কেনে কষ্ট ও বেদনা

আপনি এসব জানেন তবু  সম্পদের পেছনে দিনরাত ছুটে বেড়ান এ অসুখের নাম আধুনিকতা এই আধুনিকতা করতে গিয়ে আপনি আপনার সন্তানদের সময় দিতে পারেন না ক্লান্ত শরীরে স্ত্রীসঙ্গও ভাল লাগে না এত লোভ কেন? কাফনের তো কোন পকেট থাকে না একদিন চোখ বন্ধ হয়ে যাবে, আর  আপনিও রওনা দেবেন আপনার প্রভুর কাছে, সারা জীবনের কাজের হিসাব দিতে

এরই নাম জীবনচক্র ইমলাম চায় আপনার জীবন সহজ করতে, আর আপনি চান কঠিন করতে ইসলাম বলে, পড়শিকে অভুক্ত রেখে যে পেট পুরে খায় সে আমার উম্মত না আপনি জানেন না, আপনার পাশের ফ্লাটে যিনি থাকেন তিনি হিন্দু না মুসলমান এইতো আপনার ইসলাম

বলছিলাম আমাদের অপারগতার কথা আমরা ইসলামের নামে এখন যে ভন্ডামী করছি, তা মোটেও ইসলাম নয় অথচ আমরা বুঝতেই পারছি না, আমরা ভুল করছি

রাস্তাটা পূর্ব পশ্চিমে আপনি যাচ্ছেন সোজা পূব দিকে ভাবছেন, বাম দিকে এক ইঞ্চি এঙ্গেল করে দিলে এমন কি আর ক্ষতি আপনি গাড়ির চাকা এঙ্গেল করে দিলেন কয়েক মিনিট পরে দেখবেন, রাস্তার জায়গায় রাস্তা আছে,  আপনার গাড়ি পড়ে আছে রাস্তার পাশে, খাদে

কত যে ভুল করেছি, সে জানে কেবল আল্লাহ আমরা ইসলামী সাহিত্যের ব্যাপক বিকাশের লক্ষ্যে পরিষদের পক্ষ থেকে কী ধরনের নমুনা নিয়ে প্রকাশনা শুরু করেছিলাম আপনাদের মনে আছে আমাদের নিয়ত ভুল ছিল না, কাজও ভুল ছিল না ভুল ছিল চিন্তা আমরা অচিরেই আমাদের টার্গেট থেকে সরে এলাম পরিচ্ছন্ন ইসলামী সাহিত্যের বদলে আমরা ডিটেকটিভ বই ছাপায় ব্যস্ত হয়ে গেলাম যারা আমাদের মনে এ সুন্দর স্বপ্ন বুনে দিয়েছিলেন তারা আমাদের ওপর যে আস্থা রেখেছিল সে আস্থার জায়গাটা যে আমরা নষ্ট করে ফেলেছি তাও আমরা বুঝিনি যেটা একটা পকেট কাজ ছিল, তাকেই আমরা মূল কাজ বলে ধরে নিলাম আমাদের পুঁজির সিংহভাগ চলে গেল এ খাতে ফলে আশির স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিণত হলো আমাদের স্বপ্ন ও শপথ থেকে যে আমরা সরে  এসেছি, এটা বুঝে উঠার আগেই তেমন একটি ঘটনা ঘটে গেল ফলে সৃজনশীল ও ক্লাসিক লেখা প্রকাশ এক প্রকার থেমেই গেল এভাবে যারা আমাদের মনে ও মননে নতুন স্বপ্ন বুনেছিল, তারাই যে আমাদের স্বপ্নকে বালিশ চাপা দিল, এটা কি তারা বুঝতে পেরেছেন

৩০শে জুলাই ২০২০

যেতে হবে আরো বহু দূরঃ ০৭

বাংলাবাজারে এক ধরণের প্রকাশক আছেন যারা আসলে প্রকাশকও না, প্রেস মালিকও না প্রকাশনা ব্যবসা আসলে রাজকীয় ব্যবসা এর জন্য প্রচুর বিনিয়োগ দরকার হয় এসব প্রকাশকদের প্রেস করার সামর্থ্যও নাই, প্রকাশনা করার সামর্থ্য নাই তারা এক ধরনের দালাল লেখকের কাছ থেকে টাকা নিয়ে তারা লেখকের বই করে দেয়, মাঝখান থেকে কিছু কমিশন পায়

প্রকৃতপক্ষে কোন জেনুইন প্রকাশক এটা করে না

টাকার অভাবে বাংলা সাহিত্য পরিষদ একসময় কমিশন ব্যবসায় নেমে যায় এতে করে আমরা আমাদের কমিটমেন্ট থেকে আরেক ধাপ সরে আসি লাভ হয় কম্পোজের পযসা আমরা পাই, প্রুফ দেখার পয়সাও আমরা পাই, আর ছাপানোর লাভের কমিশন আমরা তখন স্বপ্নবাজ থেকে পুঁজি প্রেমিক হয়ে উঠি যারা বই ছাপতে আসে তারা আমাদের স্বপ্নের খবর জানে না তারা পুঁজির বিনিময়ে বই চায় আমরা তাদের স্বপ্ন পূরণ করি এভাবেই আমরা একসময় হয়ে যাই পুঁজিদাস পুঁজির বিনিময়ে আমরা আমাদের শ্রম ও স্বপ্ন বিক্রি করি এখন আর বই ছাপতে আমাদের পুঁজি বিনিয়োগ করতে হয় না কৈয়ের তেলে কৈ ভাজি পুঁজিবাদের  হাত থেকে জাতিকে রক্ষা করতে গিয়ে আমরা নিজেরাই হয়ে গেলাম পুঁজির দালাল

এর ফলে যা হলো, আমরা যারা পরিষদের সদস্য আমাদের বই বের করার আর সুযোগ রইলো না আমরা বুঝে গেলাম, বই বের করতে গেলে টাকা লাগবে সে টাকা জোগাড় করতে হবে নিজেকেই আমাদের যারা যতটুকু পারলো নিজের টাকায় বই বের করলো, বাসাপ দয়াপরবশ হয়ে প্রকাশকের জায়গায় পরিষদের নাম লেখার অনুমতি দিল আর আমার মত যারা টাকা জোগাড় করতে পারেনি, তাদের কোন বই পরিষদ থেকে অদ্যাবধি বের হয়নি এভাবেই কেটে গেল প্রায় পঞ্চাশ বছর

দোষটা আমারই আমিও কখনো মুখ ফুটে আমার বই করার কথা বলতে পারি নাই, আর আমি যে লেখক এটাও কেউ বুঝতে পারে নাই এতে অবশ্য আমার কোন দুঃখ নাই কারণ আল্লাহর ফয়সালা ছাড়া কিছুই ঘটে না

শাহাদাত বুলবুল, মহিউদ্দিন আকবর, নাসীমুল বারী, সোহরাব আসাদ, নয়ন আসরার, সালেহ মাহমুদ, রফিক মোহম্মদ লিটন, শাহীন হাসনাত, নুরুর রহমান বাচ্চু, নুরুজ্জামান ফিরোজ, শিকদার মোহাম্মদ কিব্রিয়াহ, মানসুর মুজাম্মিল এরকম কত লেখকের সাথে যে আমাদের সখ্যতা গড়ে উঠেছিল তার ইয়ত্তা নেই নাজিব ওয়াদুদের গদ্য, সরদার আবদুর রহমানের পবেষণা, আতা সরকারের কথা সাহিত্য কোথায় আমরা যাইনি এদের মাধ্যমে সারাদেশের লেখক ও নবীন লেখকদের সাথে আমরা নিবিড় যোগাযোগ গড়ে তুলেছিলাম এসব এখন স্বপ্ন আমাদের সৌভাগ্য, সুন্দরকে সবাই ভালবাসে তাই ব্যক্তিগতভাবে অনেকেই আজো আমাদের স্বপ্ন তাদের নিজের স্বপ্ন বানিয়ে নিয়েছে সাহিত্যে সুবাতাস বইয়ে দেয়ার এ স্বপ্ন অনেকেই পোষণ করে বলেই এখনো আমরা নিঃসঙ্গ নই

সাম্প্রতিক সময়ে আরো একটি শুভ দিক আমাদের স্বপ্নের সাথে যুক্ত হয়েছে অথবা বলা যায় তাদের স্বপ্নের সাথে আমরা একাত্ম হয়েছি এটি ঘটেছে  ফেবুর কল্যাণে অনেক বোন বেশ ভাল লিখছেন একসময় হাজেরা নজরুল, চেমন আরা, জুবাইদা গুলশান আরা, রাজিয়া মজিদ, মাফরুহা চৌধুরী, ঝর্ণাদাশ পুরকাযস্থ, সোফিয়া হুসনে জাহান,  ফরিদা মজিদ, কবি লিলি হক, সাবিনা মল্লিক, শামীমা চৌধুরী এদের সাথে আমাদের বেশ যোগাযোগ ছিল কিন্তু এরপর বোনদের সাথে আমাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এখন অবশ্য ফেবুর কল্যাণে কারা জাতিকে শুদ্ধতার পথে নিয়ে যেতে চায় আমরা সেটা দেখতে পাচ্ছি সেই সাথে অনেক প্রতিভাবান ভাইদের লেখাও আমাদের আনন্দ দিচ্ছে অনলাইন সাহিত্য সংগঠনগুলো এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রাখছে একদিন আমরা থাকবো না কিন্তু বাংলা সাহিত্যে সুন্দরের পথে এ অভিযাত্রা অব্যাহত থাকবে সবার সম্মিলিত চেষ্টায় আমাদের সন্তানরা থাকবে এক আনন্দময় বিশ্বে

৩০শে জুলাই ২০২০

যেতে হবে আরো বহু দূরঃ ০৮

আমার অযোগ্যতা, অপারগতার কোন সীমা নেই কি কি আমি পারিনা,  কি কি করার সাহসও করি নাই এবং কি কি করতে গিয়েও পারি নাই সে ফিরিস্তি লিখলে তিনশ বছরেও শেষ হবে না কিন্তু এতদিন কেউ বাঁচে না, তাই আমারও সম্ভাবনা নেই, সে জন্য রক্ষা আপনাদের সে সব শুনতে হবে না

তবে আমি যা করতে পেরেছি তা শুধুমাত্র আল্লাহর রহমতের জন্যই হয়েছে আমি তো ছার, কোন বান্দার পক্ষেই সম্ভব নয়, তার শুকরিয়া আদায় করা

আমাকে দিয়ে আমার প্রভু কিছু কাজ আঞ্জাম দিয়েছেন, এটা তাঁর মেহেরবানী, এখানে আমার কোন কৃতিত্ব নেই আমার  কৃতিত্ব একটাই, আমি আমার প্রভুর ভালবাসায় ধন্য এবং আনন্দিত অবশ্য এটাও তাঁরই দান

আপনারা অনেকেই জানেন, আমি একসময় দেশে বিদেশে জনপ্রিয় ইসলামী সাংস্কৃতিক সংগঠন সাইমুম শিল্পীগোষ্ঠীর সভাপতি ছিলাম কিন্তু কোনদিন পারফর্মার হিসাবে আমাকে মঞ্চে উঠতে হয়নি আমিই একমাত্র সভাপতি যে গান না জেনেও সাইমুমের মত মর্যাদাপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের সভাপতি ছিলাম

এই যে গান না জানা, এটা আমার অযোগ্যতা আর এই যে না জেনেও দায়িত্ব পালন, এটা তার মেহেরবানী

আমি কি কি পারি না, তা তো আপনারা জানেনই ফলে এটা কোন ঢোল পিটানোর বিষয় নই কিন্তু আমি বা আমরা করতে চেয়েও পারি নাই, এটা আমার বা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে আমাদের ব্যর্থতা দেখিয়ে দেয় কেন পারিনি, সে প্রশ্ন উঠলে নানাজন নানাভাবে ব্যাখ্যা করবেন হতেই পারে, আমার সাথে আপনি একমত না কিন্তু কেন পারিনি তার একটি বিশ্লেষণ তো আমার থাকতেই পারে

হয়তো আমি অতীতে ভুল করেছিলাম, অথবা এখন করছি অথবা কেউ না কেউ ভুল করেছে, যে কারণে আমাদের ঝুলিতে ব্যর্থতা জমা হয়েছে সফলতা যে আমাদের নেই, তাও নয় সেই কৃতিত্ব আমাদের অর্জন অবশ্য, এটাও ঠিক নয় আমরা বিশ্বাস করি, সকল প্রশংসার মালিক আল্লাহ অতএব, এই কৃতিত্বের মালিকও আল্লাহ

যদি ভুল হয়ে থাকে, তবে আল্লাহ আমাদের মাফ করুন আর যারা নতুন এ কাজে নামবে, এসব ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে তারা যেন এ ভুলের উর্ধে উঠতে পারে সে তৌফিক দান করুন

দীর্ঘ পঞ্চাশ বছরের অভিজ্ঞায় আমি বলতে চাই, আমরা আমাদের টার্গেট স্পষ্ট করতে পারিনি ফলে করনীয়ও ঠিক করতে পারিনি একবার মনে হয়েছে, এটা করলে ভাল হবে, আবার মনে হয়েছে, না, ওটা করলেই মনে হয় ভালো হতো এই দোদুল্যমানতা আমাদের অগ্রযাত্রাকে ব্যহত করেছে

আমরা একটি আদর্শের জন্য লড়াই করছি অমানবিক একটা সমাজে মানবতা জাগিয়ে তোলার কাজ করছি কোরান আমাদের একটা মধ্যমপন্থী জাতি বলে অভিহিত করেছে তার মানে আমরা একটি  সহনশীল সমাজ নির্মাণ করতে চাচ্ছি

আমরা চাই না, পুঁজিবাদের মত অবাধ স্বাধীনতার আড়ালে পাশবিকতায় জড়িয়ে পড়ি বা স্বাধীনতা সম্পূর্ণ হরণ করে সমাজবাদের নামে মানুষকে স্বাধীনতাহীন করে যন্ত্রে পরিণত করি আমাদের মনে রাখতে হবে, আমরা যেমন প্রাণহীন যন্ত্র না, তেমনি বিবেকহীন পশুও না আমাদের বিবেক আমাদেরকে মমত্ববোধ শিখায়, প্রেম ও ভালবাসতে শিখায় ঘৃণা, লোভ ও নিষ্ঠুরতা বর্জন করে মানুষকে মানবিক ও দয়াবান হতে বলে

একদিকে আদর্শ ও নৈতিকতা অন্যদিকে সুবিধাবাদ আদর্শবান হতে হলে সুবিধাবাদ বাদ দিতে হবে, আর সুবিধাবাদী হতে হলে আদর্শ বাদ দিতে হবেএ দুটো কখনো এক সাথে চলতে পারে না যেমন রাত আর দিন এক সাথে চলতে পারে না অন্ধকার ও আলো এক সাথে থাকতে পারে না যদি কখনো এক হতে যায়, তখন তা হয়ে যায় আলোআঁধারী প্রাণ থাকতে মানুষ মরে না, মরে গেলে সে আর মানুষ থাকে না হয়ে যায় লাশ অথচ বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ এই সংকর প্রজাতির একদল মন্দের সাথে ভালো মিশায়, অন্যদল ভালোর সাথে মন্দ মিশায় কোথাও মন্দের পরিমান বেশী, কোথাও কম

মন্দরা হঠাৎ দুএকটা ভাল কাজ করে বলে, এইতো আমি ভাল কাজ করেছি আর ভালোরা মন্দ কাজ করে বলে, আমি তো একটা ভাল কাজ করার জন্যই এই মন্দটা করেছি আমার নিয়ত ভালো হুজুর ধরলো, খাঁ সাব, মাদ্রাসায় একটা মসজিদ দরকার সবাই বলেছে, আপনি একটু নড়েচড়ে বসলেই হয়ে যায় খাঁ সাহেব বললেন, সবাই কে কে? হুজুর বললেন, আরে, ওটাতো কথার কথা মানে, ইমাম সাহেব মিথ্যে বললে তা আর মিথ্যা থাকে না, হয়ে যায় কথার কথা

জানি, আমার কথা আপনাদের অনেকেরই ভাল লাগছে না এ জন্যই আমি কবিতা লিখি, কথা বলি কম বাঙালি কথা বলায় ওস্তাদ কিন্তু সত্যটা গাঁয়ে লাগলেই তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠে

তাই আমি কিছু না বলে আপনার কাছেই প্রশ্ন করছি, যার দিন কাটে খোদার অসংখ্য হুকুম অমান্য করে তাকে কি মুসলিম বলা যায়?

নামাজ হচ্ছে প্রধানত মানসিক এবাদত আপনি আমি প্রতিদিন পাঁচ বার আল্লার দরবারে হাজিরা দিয়ে নামাজ পড়ি নামাজে আমরা আমাদের প্রভুর সাথে কথা বলি কিছু ওয়াদায় আবদ্ধ হই কিছু জিনিসের স্বীকৃতি দেই রুকু, সেজদা, কিয়ামে যে ব্যায়াম হয় তা অস্বীকারের উপায় নেই আমরা নামাজের রুকু সেজদা শিখি, কিন্তু রুকু সেজদায় কি বলি তা শেখা যে জরুরী তা আমরা ভুলে যাই ফলে, আমরা আল্লাহর সাথে কি ওয়াদায় আবদ্ধ হই তাই আমরা জানি না, আর যে চুক্তির বিষয় আমরা জানি না তা পালন করার তো প্রশ্নই উঠে না  তাহলে আমাদের নামাজ থেকে সমাজ কি করে উপকৃত হবে একজন নামাজ পড়ে না, আরেকজন পড়েছে তবে তার নামাজ কবুল হয়নি, এতে কি কোন পার্থক্য আছে? একজন পড়েনি, আরেকজন পড়েছে কিন্তু তা কোন কাজে লাগেনি, তার মানেতো একই দাঁড়ালো দুজনই ব্যর্থ যে পড়েনি, সে নামাজ নিয়ে কোন সময়ও ব্যয় করেনি, আর যে পড়েছে সে পরীক্ষা দিয়েও ফেল করেছে পাসের খাতায় কারোরই নাম যায়নি

আমাদের অবস্থা হয়েছে তাই একজন অমুসলমানও ঘুষ খায়, একজন মুসলমানও

ঘুষ খায় একজন রেনামাজিও ঘুষ খায়, একজন নামাজিও ঘুষ খায় এই চারজনের মধ্যে ভাল কে? কেউ না চারজনই ঘুষখোর তবে তুলনামূলক ভাবে নামাজির অপরাধ বেশী কারণ, সে জানতো ঘুষ খাওয়ার পরিনাম কি? আর বেনামাজি জানতো না জেনেও যে পাপ করে সেই বড় অপরাধী

এরকম হাজারো অসঙ্গতিতে ভরা আমাদের জীবন ইসলামও থাকবে জুলুমও থাকবে এর নাম ইসলাম প্রাকটিস হতে পারে না ক্রমাগত শুদ্ধ মানব হওযার চেষ্টার নাম ইসলাম

ইসলাম এসেছে মানব সমাজ থেকে অশান্তি  ও অকল্যাণ দূর করতে যে সমাজে অশান্তির চাষ হও সেটা ইসলামী সমাজ নয় ইসলাম নারীর সাথে কি আচরণ করবেন, চাকরের সাথে কি আচরণ করবেন, অমুসলমানের সাথে কি আচরণ করবেন, পড়শীর সাথে কি আচরণ করবেন, বুড়ো পিতামাতার সাথে কি আচরণ করবেন এসেছে সেই আচরণ শেখাতে ইসলাম বলে বাপ মায়ের সাথে ভাল আচরণ করো আমরা আল্লাহর সাথে এবাদতের সুবিধার্থে বাপ মাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসি বাপ মাকে গ্রামের বাড়িতে রেখে আমরা চলে যাই শহরে, বিদেশে অনেক সন্তান আছে বাপ মাকে দাফন করার ফুসরতও হয় না তার আমরা বিশ্ব চষে বেড়াই সুখ ও শান্তির খোঁজে, জানি না, মায়ের হাতের এক লোকমা ভাতের ভেতর ঘুমিয়ে আছে সুখ ও শান্তি যে মানুষ বাপমায়ের সাথে আচরণই শিখতে পারলো না, তাকে আপনি কি করে ইসলাম শেখাবেন?

আপনার পরিবারকে সুখী করা আপনার দায়িত্ব অথচ পরিবারকে সঙ্গ দেয়ার সময়ই আপনার হয় না এর নাম ইসলাম নয়

আপনি ইসলাম শিখতে পীরসাহেব, দরবেশ ও বুজুর্গানে দ্বীনের কাছে যান, যারা আপনাকে কতিপয় দোয়া শিখিয়ে দেন পৃথিবীতে কোরআন কি দোয়া শিখানোর জন্য এসেছিল? আপনি জানেন না, কিন্তু হুজুরও কি জানেন না কোরআন কি শিখাতে অবতীর্ণ হয়েছে?

প্রিয় নবী বলেছেন, আমি তোমাদের কাছে দুটো জিনিস রেখে যাচ্ছি, তা আকড়ে ধরে থাকলে তোমরা কখনো বিভ্রান্ত হবে না, বিপথগামী হবেনা আর তা হচ্ছে আল কোরআন ও সুন্নাহ

অথচ আমরা ইসলাম শিখতে যাই, নেতার কাছে, পীরের কাছে, হুজুরের কাছে আমরা যাই খানকায়, মাজারে কোরান থাকে তাকের ওপরে

এভাবে ভুলে ভুলে কেটে যায় আমাদের জীবন এই ভুল করাটা কোন অপরাধ নয়, অপরাধ হচ্ছে ভুলের ওপর বসে থাকা ওখান থেকে না সরা আর ইসলাম হচ্ছে, ভুল বুঝার সাথে সাথে তওবা করে ফিরে আসা

মানুষ ভুল করবেই এটাই স্বাভাবিক শয়তান ভুলের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে, মানুষ সরে আসে

আমরা যারা আশির দশকে জ্যোতিজোস্নার কবিকন্ঠ হয়ে যাত্রা করেছিলাম, আমাদের স্বপ্ন পুরোপুরি সফল না হলেও অনেক পথ আমরা পেরিয়ে এসেছি বিপরীত উচ্চারণের মাধ্যমে এই জ্যোতিজোস্নার নিশান উড়িয়েছিল কতিপয় স্বর্ণতরুণ এ আন্দোলনকে এগিয়ে নেয়ার জন্য অচিরেই গড়ে তোলা হল বাংলাসাহিত্য পরিষদ এটিকে রূপ দেয়া হলো, কেন্দ্রীয় সাহিত্য সংগঠনের আমরা যারা ইসলামী সাহিত্য গড়ার প্রত্যয়ে জোটবদ্ধ হয়েছিলাম আল্লাহ আমাদের আশা পূরণ করলেন আমরা পেলাম অভিজ্ঞ মুরুব্বী, বাংলা সাহিত্যের প্রথিতযশা সাহিত্যিকদের স্নেহমমতা, সময়ের আনুকূল্য, তারুণ্যের উচ্ছ্বলতা, আশাবাদী নবীনের স্বপ্নভূবন

আমরা আমাদের সভাপতি হিসাবে পেলাম দৈনিক সংগ্রামের বিজ্ঞ সম্পাদক জনাব আবুল আসাদকে যার নেতৃত্বে আমরা কাটিয়ে দিলাম প্রায় পঞ্চাশটি বছর পরিচালক, ব্যবস্থাপক ও নির্বাহী পরিষদে বিভিন্ন সময় পরিবর্তন এলেও প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসাবে যাকে পেয়েছিলাম সেই আবুল আসাদ আজো পরিষদের সভাপতি এর মাঝে নতুন করে যারা বিভিন্ন সময়ে পরিষদের সদস্য পদে এসেছিলেন তাদের তালিকাটা একেবারে ছোট নয় কষ্ট করে সর্বশেষ ব্যবস্থাপক তৌহিদুর রহমান যদি এই তালিকাটা জাতিকে জানান, জাতি অন্তত জানতে পারবে, কারা এর সাথে যুক্ত হয়ে বিভিন্ন সময়ে একে এগিয়ে নিয়ে গেছেন

এবং বর্তমান পরিষদে কারা আছেন এটাও তো একটা ইতিহাস হতে পারে

একটা জাতীয় সাহিত্য সাংস্কৃতিক সংগঠন হিসাবে বাংলা সাহিত্য পরিষদ নিয়ে আমাদের স্বপ্নটা ছিল এরকমঃ

 শিশুদের জন্য জাতীয় শিশু কিশোর সংগঠন আছে, শ্রমিকদের আলাদা সংগঠন আছে, কৃষকদের আলাদা সংগঠন আছে, ছাত্রদের নিজস্ব সংগঠন আছে, ছাত্রীদের নিজস্ব সংগঠন আছে, একই ভাবে শিক্ষক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, কৃষিবিদ সবারই নিজস্ব সংগঠন আছে, তেমনি লেখকদেরও একটি জাতীয় সংগঠন থাকবে, তার নাম হলো বাংলা সাহিত্য পরিষদ যেটি এরই মধ্যে আমরা করে ফেলতে সক্ষম হয়েছি আমাদের একটি টেবিল, একটি চেয়ার ও একটি আলমিরা আছে সময়ের সাথে সাথে এ অফিস বড় হবে নবীন প্রবীণের কলকাকলিতে ভরে উঠবে আমাদের থাকবে নিজস্ব অফিস, ক্যাম্পাস, হল কত কিছু সম্ভব হলে আমরা গড়ে তুলবো লেখক পল্লী এরকম কত স্বপ্ন

প্রথমে বিভাগীয় শহরে, তারপর জেলা শহরে আমাদের শাখা হবে এরপর মহকুমা ও থানা সদরেও পৌঁছে যাবো আমরা আমাদের বই হবে জেলায় জেলায় সাহিত্য সভা ও বিক্রয়কেন্দ্র থাকবে

স্বপ্নটা ভাল না?

কিন্তু আমরা পারিনি আমাদের পরিকল্পনার পরী উড়িয়া যাওয়ার পর কল্পনাগুলো মাটিতে পড়িয়া গড়াগড়ি খাইতে লাগিল

কি পারিনি আমরা? পঞ্চাশ বছরেও ঢাকার বাইরে কোন শাখা করতে পারিনি না বিভাগীয় শহরে, না জেলা শহরে আমরা এখন সগৌরবে বলতে পারি, সারাদেশে আমাদের আর কোন শাখা নেই এই না থাকাটা আমাদের অর্জনও হতে পারে, ব্যার্থতাও হতে পারে অর্জন হলো, আমাদের মধ্যে কোন ভেজাল নেই ব্যর্থতা হলো, বিকাশ কাকে  বলে আমরা আজো জানি না

৫ই আগষ্ট ২০২০

যেতে হবে আরো বহু দূরঃ ০৯

এবার বুঝেন আমার বুদ্ধি কত কম! সবাই লেখে মুই কি হনু রে, আর আমি লিখছি আমি কি পারি নি মানুষ লেখে আমি এই করেছি, ওই করেছি এই যে এতবড় তালগাছ দেখছেন, এটা লাগিয়েছিল আমার দাদা বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে আমি এই গাছে কত পানি দিয়েছি গাছ দেখে বুঝেন না কার যত্নে তালগাছ এমন নাদুস নুদুস

না ভাই, আপনাদের বুদ্ধির সাথে আমার বুদ্ধি মিশ খায় না আমি যা করেছি, মানে আল্লাহর রহমতে যা করতে পেরেছি, তা তো সবাই জানে আকাশে চাঁদ উঠলে সবাই দেখে ওটা কি বলে বেড়াতে হয়? আর আপনি যদি দরজা জানালা বন্ধ করে মশারীর ভেতর ঘুমিয়ে থাকেন, তবে আপনার চাঁদ দেখার দরকারই বা কি?

আমি যা পারি নাই তা বলে যাওয়া দরকার এ জন্য, যদি কারো ইচ্ছা হয় এবং তিনি পারেন, তবে যেন কাজটা করে ফেলেন স্বপ্ন   জন থেকে জনে ছড়িয়ে পড়ুক, কাল থেকে কালে গড়িয়ে যাক, কেউ না কেউ সফল হবেই স্বপ্ন মরে না স্বপ্ন কাল থেকে কালে গড়িয়ে যায় সময়ের সাথে তার ডালপালা বাড়ে স্বপ্ন চলে রীলেরেসের মত আমার দৌড় যেখানে শেষ সেখান থেকেই যাত্রা শুরু করবে পরবর্তী খেলোয়াড় সেই অনাগত খেলোয়াড়ের নাম আমার হয়তো জানা নেই, কিন্তু এই খেলার আয়োজক সবই জানেন

যে স্বপ্ন এখনো স্বপ্নই রয়ে গেছে তার নামই ব্যর্থতা ব্যর্থতা পরাজয় নয়, ব্যর্থতা হচ্ছে অবাস্তবায়িত স্বপ্ন মুমীন কখনো আশাহত হয় না, তাই মুমীন কখনো পরাজিতও হয় না

বলছিলাম আশির দশকের জ্যোতিজোস্নার কবিকন্ঠের কথা আমরা যারা মল্লিক ভাইয়ের হাত ধরে এ পথে রওনা হই তখন আমাদের কারো মনেই হীনমন্যতা ছিল না, দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল না বিজয়ের পথে আমরা এগিয়ে যাবোই, যতটা পারি বাংলা সাহিত্যকে আমরা নোংরামীর হাত থেকে রক্ষা করবো সাহিত্যে আবার সুবাতাস বইয়ে দেবো আমরা আমাদের শপথে দৃঢ়, অচঞ্চল জাতির প্রত্যাশাও তাই কেউ নোংরামী চায় না কেউ অসুন্দর চায় না ফলে জাতির স্বপ্ন আর আমাদের স্বপ্ন একাকার হয়ে গেল আমাদের সাফল্যের  এটাই ছিল প্রথম কারণ

আমাদের সাথে হাত মিলিয়েছে আবদুল হাই শিকদার, রেজাউদ্দিন স্টালিন, শাহীন রেজা, জাকির আবু জাফর, চৌধুরী গোলাম মাওলা, শিল্পী ও কবি ইব্রাহীম মন্ডল, ও আরো অনেকে আমার নাম খুব কম মনে থাকে, এ তালিকা বিস্তারিত বলতে পারবে হাসান আলীম

মতিউর রহমান মল্লিকের মত দরদীপ্রাণ ছিল আমাদের সেনাপতি মীর কাসেম আলীর মত সম্রাট শাহজাহানরা ছিল আমাদের পৃষ্ঠপোষক ও প্রেরণাদাতা আর সাহসেভরা উদ্দীপনাময় সৈনিকরা ছিল বলে আমরা তাজমহল বানাতে না পারলেও তাজমহলের মত একটা আবকাঠামো গড়ে তুলতে পেরেছিলাম

আশির এ সাফল্য কোন একক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সম্পদ নয় এ হলো সম্মিলিত প্রচেষ্ঠার ফসল

আগেই বলেছি, বিপরীত উচ্চারণের স্বর্ণসন্তানরা এ স্বপ্নের বীজ বুনেছিল এ স্বপ্ন এগিয়ে নেয়ার জন্য একদা জন্ম হয়েছিল বাংলা সাহিত্য পরিষদের এর মনোগ্রামটি এঁকেছিলেন শিল্পী হামিদুল ইসলাম বখতিয়ারের ঘোড়া ছুটিয়ে এর উদ্বোধন করেছিলেন সোনার নোলকের মালিক কবি আল মাহমুদ

নিয়মিত প্রকাশনা ও মাসিক সাহিত্য সভা ছিল আমাদের মূল আয়োজন  আমাদের আশা ছিল, প্রথমে বিভাগীয় শহরে ও পরে জেলা শহরে এর শাখা কায়েম করা কিন্তু প্রায় পঞ্চাশ বছরেও আমরা আমাদের এ স্বপ্ন পূরণ করতে পারিনি

আমাদের স্বপ্ন ছিল, বাংলা একাডেমী না হোক, অন্ততঃ বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের মত একটা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা নীতি নৈতিকতা ও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ লেখকদের সুবিশাল এক প্লাটফর্ম গড়ে তোলা আমাদের হাজার হাজার সদস্য থাকবে, নানা অনুষ্ঠানে মাতিয়ে রাখবো সারাদেশ

না, আমাদের এ ন্বপ্নও পূরণ হয়নি

বোকা হলে যা হয়, সামনে শুধু প্রশ্ন থাকে, জবাব থাকে না খাতা থাকে ফকফকা আমরা অবাক হয়ে ভাবি, কী হলো? আমাদের ওস্তাদরা কি শেখালো? সারা বছর পড়ার নামে আমরা কোন অরণ্যে ঘুরে বেড়ালাম? সূচনায় সংবিধানের আলোকে আমাদের কার্যকরী পরিষদ ছিল সাত সদস্য বিশিষ্ট আর আমাদের নির্বাচক মন্ডলী মানে আমাদের স্থায়ী সদস্য ছিল বিশ থেকে পঁচিশজন অবশ্য প্রথম দিকে আমরা কে পরিষদের মেম্বার আর কে নয়, এটা কোন বিষয় ছিল না সূচনায় আমরা যে সাতজন বাংলা সাহিত্য পাল্টে দেয়ার প্রত্যয় নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলাম, আমরা ছিলাম আপোষহীন আমরা ছিলাম সৃষ্টি মুখর আমাদের কাছে আমির চেয়ে আমরা ছিল গুরুত্বপূর্ণ প্রথম নির্বাহী কমিটিতে আমি ও মল্লিক ভাই ছাড়া আর যারা ছিলেন তারা সবাই ছিলেন আমাদের মুরুব্বী আবুল আসাদ, একেএম নাজির আহমদ, আবদুল মান্নান তালিব, মোল্লা ভাই, সিদ্দিক জামাল তারা দিলেন আমাদের সাহস ও উদ্দীপনা আর আমরা তাদের ইশারায় সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়লাম যদিও আমরা মনে করতাম আমরাই মুহাম্মদ বিন কাসিমের সতেরো সওয়ার, পরে দেখলাম, না, যারা আমাদের ময়দানে নামিয়ে এগিয়ে দিচ্ছেন তারাও সাহিত্য সাধনার দুর্গম পথে নেমে পড়েছেন সবাই লিখছেন তালিব ভাই ছিলেন সবার ওস্তাদ বীরবিক্রমে ঝাপিয়ে পড়েছেন জামেদ আলী আবুল আসাদ তো নিজেই জাত লেখক নাজির ভাইও হাত গুটিয়ে বসে নেই একমাত্র সিদ্দিক জামাল সাহিত্যের নির্ভেজাল সেবক যদিও শেষ জীবনে তাঁর একটি বই প্রীতি থেকে আমি প্রকাশ করেছিলাম খ্রীস্টান মিশনারী তৎপরতা সম্পর্কে

তরুণ বন্ধুরা আমাদের নামে একটা অভিযাগ করেন, আর যারা করেন না তারাও মনে মনে পোষণ করেন, আমরা ঠিকমত তাদের নার্সিং করি না অভিযোগটি যে ভুল সে কথা আমি বলছি না এটাও আমাদের এক ধরনের অপারগতা

আসলে যেখানে আমাদের হাজার হাজার সদস্য করার কথা ছিল সেখানে আমরা সারাদেশে পঞ্চাশ বছরে পঞ্চাশজন সদস্যও করতে পারি নাই ফলে যাদের কলকাকলি মুখর হয়ে উঠার কথা ছিল বাংলা সাহিত্য পরিষদ তারা পরিষদের কর্মী হওয়াতো দূরের কথা, সাধারণ সদস্যও হতে পারে নাই আশির কাব্যান্দোলনের জন্য যা ছিল খুবই জরুরী মূলত আমাদের এই অপারগতা, অবহেলা, অবজ্ঞা তাদের দারুণভাবে মর্মাহত করে যার থেকে জন্ম নেয় ক্ষোভ, হারিয়ে যায় উৎসাহ উদ্দীপনা সেখানে এসে ভর করে একধরনের আলস্য ও নির্লিপ্ততা আশির দশকের মল্লিক ভাই, আমি, হাসান আলীম, মোশাররফ হোসেন খান আমরা সবাই ছিলাম শপথের কর্মী সোলায়মান আহসান চাকসুর সাহিত্য সম্পাদক কিন্তু দুঃখ আমাদের, নব্বই দশকের কাউকেই শপথের আওতায় আনা গেল না এরপরও পেরিয়ে গেল অনেক বছর অদ্যাবধি কোন লেখককে আর শপথের আওতায় আনা গেল না এটা শুধু ঢাকার চিত্র নয়, এ চিত্র সারাদেশের এবিষয়টা কি এখনো নোটে নেয়ার মত নয়?

আমাদের পরে অনেকেই শপথ নেয়ার অপেক্ষায় ছিল গোলাম মোহাম্মদ, বুলবুল সরওয়ার, সোলায়মান আহসান, মুকুল চৌধুরী, জাকির আবু জাফর কিন্তু এদের সাথে এমনসব ব্যবহার করা হলো, এরা কেউ শপথ নিতে রাজি হল না অর্থাৎ নবীনরা দেখলো, আশির দশকের জ্যোতিজোস্নার কবিকন্ঠ বলে যাদের উল্লেখ করা হলো, পরিষদে তাদেরই কারো কারো জায়গা হয় না, তারা শপথের কর্মী হলেও না বরং এমন কিছু লোক বাংলা সাহিত্য পরিষদের সদস্য হলো যারা শপথের কর্মী তো না-ই, কখনো তাদের মাঠে ময়দানেও দেখা যায় না

এ আলামতগুলো একটি আদর্শবাদী দলের লোকদের জন্য খুবই আপত্তিকর বিবেচিত হলো আমরা নিজেরা ডাবল স্ট্যান্ডারড  মেনটেইন করি বলে অভিযোগ উঠতে লাগলো যোগ্যতা কম থাকার পরও তিনিই ভাল, যিনি কোথাও দায়বদ্ধ নন কারণ যখন কোথাও চাকরীর সুযোগ ঘটে তখন যোগ্যতা থাকলেও শপথের কর্মীর চাকরী হয় না, বরং শপথের কর্মী হওয়াটাই তার অযোগ্যতা হয়ে দাঁড়ায় না, এসব গল্প বলছি না বাস্তবে যা দেখেছি, তাই বলছি

চেয়ারের কাছে একবার এজিএমে নতুন সদস্য বৃদ্ধির প্রস্তাব বাতিল হলে জানতে চেয়েছিলাম, কারণ কি?

জবাব পেয়েছিলাম, মেম্বার বেশী হলে প্রতিষ্ঠান হাত ছাড়া হয়ে যেতে পারে যত কন্ট্রোলের মধ্যে রাখা যায় ততোই ভাল

হ্যাঁ, কথাটা ঠিক কিন্তু আপনি জগাখিচুড়ি মেম্বার বাড়াবেন কেনো? সদস্য হওয়ার নূন্যতম শর্ত হলো, তাকে মেম্বার হতে হবে অথবা এমন কোন শর্ত দেয়া যেতে পারে

একটি আদর্শবাদী ও গণমুখী দল কি তালা দিয়ে রাখবে তার ঘর? নাকি সবার জন্য থাকবে অবারিত দ্বার?

আমরা পঞ্চাশ বছরেও ঢাকার বাইরে আর কোন শাখা খুলতে পারিনি

আমরা পঞ্চাশ বছরেও সারাদেশ থেকে পঞ্চাশজন সদস্য জোগাড় করতে পারিনি

পরিকল্পিত ইসলামী সাহিত্য সৃষ্টির উদ্যোগ জামেদ আলীতে এসে থেমে যায় এরপর কবি সাহাবা লবীদ বলে কবি আবদুস সাত্তারের একটি পুস্তিকা বেরিয়েছিল, সাহাবীরাও যে সাহিত্যচর্চা করতেন এটা দেখানোর জন্য

আল্লাহর পথের সৈনিকের পরে অনুবাদ ও ক্ল্যাসিক সাহিত্য সৃষ্টির উদ্যোগও পঞ্চাশ বছরে নেয়া আর সম্ভব হয়নি

বাংলা সাহিত্য পরিষদ হয়ে যায় কমিশনখেকো পাবলিশার্স

পুঁজিপতিদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার পরিবর্তে পুঁজিপতিদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে বই বের করার মধ্য দিয়ে আমরা হয়ে গেলাম পুঁজির গোলাম

একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন হয়ে গেল একটা বইয়ের দোকান

সৃজনশীল বই রেখে আমরা হয়ে গেলাম, থ্রিলার প্রকাশক

আমরা হয়ে গেলাম স্বপ্নহীন স্বাপ্নিক

১০ মুখে মুখে সবাই শুনলো, আমরা গণতান্ত্রিক, কিন্তু কাছে এসে দেখলো আমরা স্বৈরাচারী, এটা কি ইসলামী চরিত্র?

আজ চলছে মল্লিক ভাইয়ের মৃত্যু মাস যিনি একটি সামগ্রিক ইসলামী সাংস্কৃতিক বিপ্লবের স্বপ্ন দেখেছিলেন সেই কাফেলার সিপাহসালাররা শপথের বাইরে বসে তামশা দেখবেন, এটা কি হতে পারে?

কথাগুলো বললাম আমি বেশ হালকা চালে কিন্তু কথাগুলো হৃদয় দিয়ে অনুভব করার মত

কয়েক বছর আগে আমার যখন ওপেনহার্ট হয় তখন অপারেশন থিয়েটারে শোয়ানোর পর, চারদিকে ডাক্তার, উজ্জ্বল আলোয় ভেসে যাচ্ছে ধবধবে সাদা বিছানা, ডাক্তার আমাকে জিজ্ঞেস করছে, ভয় লাগছে? আমি মৃদু হেসে বললাম, ডাক্তার সাহেব, ভয়ের কি আছে? আপনি কেন, সারা দুনিয়ার মানুষ চেষ্টা করলেও আমাকে মারতে পারবে না, যদি আল্লাহ ইচ্ছা না করেন আর যদি তিনি চান তবে কেউ আমাকে বাঁচাতেও পারবে না অতএব, আপনার কাজ আপনি করেন, আমার কাজ আমি করি, আর আল্লাহর কাজ আল্লাহ করুক এখানে ভয়ের কিছু নাই আমার কি হবে সেটা আগে থেকেই ঠিক করা আছে এর পরের বছর যখন স্ট্রোক করি,  আমাকে এম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে নেয়া হচ্ছে, তখন এ কথাটা আবার মনে হয় এর দু বছর পরের ঘটনা কাশিমপুরের নিচ তলার এক কামরায় বসে আছি আমি যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত এক খুনী আমার পা টিপছে বললাম, তুমি কে? সে তার পরিচয় দিল বলল, আমি আপনার খাদেম আমি আল্লাহর শোকরিয়া আদায় করলাম ডা. শফিকুর রহমান সাহেব তখন থাকেন তিন বা চার তলায়  এক লোক এসে বলল, শফিক সাহেব আপনাকে ফল খাওয়ার দাওয়াত দিয়েছেন সে রুম নম্বর লেখা একটুকরো কাগজ আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে চলে গেল আমি গেলাম ওনার রুমে তিনি চেয়ারে বসতে ইশারা করলেন আমার কুশলাদি জানলেন তারপর রুমের ছেলেটাকে বললেন, কবিকে আম ও লিচু দাও আসার সময় তিনি বললেন, কবি, ঘাবড়াবেন না আল্লাহ এমনি এমনি  কিছু করেন না ভাবেন,  তিনি কেন আপনাকে এখানে এনেছেন বাইরে গিয়ে এখানকার অভিজ্ঞতা লেখবেন বাইরে এসে প্রায় চারশো পৃষ্ঠার একটা বই লিখেছি এখন তো আর প্রীতি নেই, তাই বের করতে পারিনি

ভাবছিলাম, এতবার মরার মওকা এলো, কিন্তু মরলাম না কেন? অবশ্য জানি, মরার জন্য মওকা লাগে না তখনি ভাবলাম, বোকাদের স্মৃতিকথা লিখলে কেমন হয়?

কেমন হচ্ছে বলবেন কিন্তু

৭ ই আগষ্ট ২০২০

যেতে হবে আরো বহু দূরঃ ১০

যেতে হবে আরো বহু দূর কত দূর? না আর বেশীদূর এগুনো ঠিক হবে না জানি, সত্য কথা কেউ পছন্দ করেন না আমিও না, আপনিও না এরই মধ্যে কেউ কেউ মুখ কালো করে ফেলেছেন আপনজনদের কেউ কেউ আর না এগুতে ইঙ্গিত দিচ্ছেন আমিই কি সব সত্য বলেছি নাকি? কত সত্যের যাবজ্জীবন হয়ে গেছে কত সত্য হাসতে হাসতে ফাঁসির দড়ি গলায় পড়েছে, সেসব না বলাই ভালো

 

আসলেই সত্য বড় তিক্ত কুইনাইনের চেয়েও তিতা তাইতো সত্য কেউ পছন্দ করি না আপনে বলবেন, এভাবে বলা ঠিক না কত ইমাম, হুজুর, পীর, দরবেশ আছেন, তারা তো সত্য পছন্দ করেন

নারে ভাই, এটাও সত্য না আমি যদি সত্য বলি, আপনেও আমারে পছন্দ করবেন না আপনি যাদের সত্যবাদী মনে করছেন, তারাও সত্যবাদী না আপনি কি জানেন, আপনার পীর সাহেব কোনদিন মিছে কথা বলেননি? মানুষ মাত্রই পাপী কারো পাপ বেশী, কারো কম অথচ আমরা কাউকে কাউকে ফেরেশতা তুল্য বানিয়ে ফেলি এবং তিনিও তা মেনে নেন কেন, তিনি কি জানেন না, কি পাপ তিনি করেছেন?

এভাবেই ভুলে ভুলে আমাদের জীবন কেটে যায় যখন বুঝি, ভুল করে ফেলেছি, তখন আর সেই ভুল শোধরানোর কোন সুযোগও থাকে না যদি থাকে, তখন আমরা তওবা করি

আল্লাহ মিথ্যা কথা বলেন না তাঁর ওয়াদায় আমরা বিশ্বাস করি তিনি রাহমানুর রাহীম তিনি আমাদের আশ্বাস দিয়েছেন, মাফ চাইলে তিনি তাঁর প্রিয় গোলামদের মাফ করে দেবেন

বাঙালি মুসলমানের ভুলের ফিরিস্তি টানতে চাই না শুধু একটা উদাহরণ দিই আল্লাহ বলেছেন, নামাজ সমাজ থেকে অশ্লীলতা দূর করে কিন্তু আমাদের সমাজে মসজিদেরও অভাব নাই, মুসল্লিরও অভাব নাই অশ্লীলতারও অভাব নাই কারণ কি? আল্লাহ কি মিথ্যা বলছেন (নাউজুবিল্লাহ)? নাকি আমাদের নামাজ হয় না?

খেয়াল করুন, নামাজে আমরা আল্লাহর কাছে কিছু ওয়াদা করি রুকুতে, সেজদাতে, বৈঠকে, কেরাতে সে ওয়াদাগুলো লুকিয়ে আছে আমি কি জানি, নামাজে মহান প্রভুর সাথে আমি কি ওয়াদা করলাম? না, আমরা আরবীতে কতগুলো শব্দ উচ্চারণ করি, কিন্তু তার অর্থ জানি না ফলে, আমরা নামাজ পড়ি, কিন্তু কোনো ওয়াদায় আবদ্ধ হই না নামাজে আমরা আল্লাহর সাথে মিথ্যাচার করি নিজের মালিকের সাথে ওয়াদা করে সেই ওয়াদার মর্যাদা দেই না এভাবেই নামাজের নামে আমরা এক ধরনের ভন্ডামী ও প্রতারণায় লিপ্ত হই

এখন যদি আমি বলি, আপনার নামাজ হয়নি, আপনি রাগ করবেন এমনকি, যারা আরবী জানেন, তারাও আল্লাহর সাথে কৃত ওয়াদা রক্ষা করেন না ফলে, আসলেই নামাজের বরকত আমরা পাই না

রিজিকের মালিক আল্লাহ কিন্তু আমরা রিজিকের সন্ধানে এতটাই ব্যস্ত থাকি, আমরা স্ত্রীর হক আদায় করতে পারি না, সন্তানের হক আদায় করতে পারি না, পিতামাতা, প্রতিবেশী কারো হকই আদায় করতে পারি না সময় নাই এইতো আমাদের ঈমানের অবস্থা

পৃথিবীর কোন প্রাণীটি খেতে না পেরে মারা গেছে? আল্লাহর কাছ থেকে রিজিকের মালিকানা আমরা ছিনিয়ে নিয়েছি ফলে অভাব হয়েছে আমাদের নিত্য সাথী দুঃখ কষ্ট আমাদের হাতের কামাই আমরা খাদ্য উৎপাদনের জন্য  পুঁজি বিনিয়োগ না করে পুঁজি বিনিয়োগ করি মানুষ মারার অস্ত্র তৈরীর জন্য যে মানুষের মানবতার জন্য আমরা উদগ্রীব সে মানুষ কতটা খারাপ ভাবতে পারেন?

অনেক তিক্ত কথা বলে ফেলেছি,আর না এবার মূল কথায় আসি কবি মতিউর রহমান মল্লিকের মূল টার্গেট ছিল মানুষের মধ্যে মানবতাবোধ জাগিয়ে সমাজ থেকে অন্যায় অনাচার দূর করা সমাজে হানাহানি বন্ধ করে একটি শান্তির সমাজ প্রতিষ্ঠা করা এ জন্য তিনি সভ্যতার দুটি ক্ষেত্র বেছে নিয়েছিলেন-- সাহিত্য ও সংস্কৃতি দুটো ক্ষেত্রই মানুষের মনোজগতের সাথে সম্পর্কিত মানুষের মনের মধ্যে যদি মহৎ ভাব জন্ম নেয়, তবেই মানুষ মহৎ কাজে লিপ্ত হয় চিন্তার জগত পরিশুদ্ধ হলেই  মানুষের সমাজ ও সভ্যতা পরিশুদ্ধ হয় পৃথিবীকে সুন্দর করতে হলে সুন্দর করতে হবে মানুষের মন কবি মতিউর রহমান মল্লিক মানুষের মন ও মনন পরিশুদ্ধতার কাজে আত্মনিয়োগ করেছিলেন আর এ জন্য তিনি বেছে নিয়েছিলেন ইসলামকে

এর অবশ্য কারণ আছে মূল কারণ হচ্ছে মানুষের সীমাবদ্ধতা একশো বছর আগের মানুষ ও পৃথিবী আর আজকের মানুষের অবস্থা এক নয় একশো বছরের পরের পৃথিবী কেমন হবে আমরা জানিনা মানুষ অদূরদর্শী ও স্বার্থপর ফলে তার পক্ষে মানব জীবনের জন্য একটি সুষম জীবন বিধান তৈরী করা সম্ভব নয় সে একদেশদর্শী হবে তার ভালবাসা থাকবে স্বসমাজের জন্য, স্বদেশের জন্য, স্বসময়ের জন্য

 যিনি যে যন্ত্র বানান তিনিই সে যন্ত্র চালানোর সঠিক ফর্মুলা বলতে পারেন এই পৃথিবী ও আমাদের যিনি বানিয়েছেন তিনি যে বিধান দেবেন সেটাই হবে আমাদের জন্য সর্বোত্তম স্রষ্টা নিজেই বলেছেন, তিনি পরিপূর্ণ জীবন বিধান হিসাবে ইসলামকে মনোনীত করেছেন সে জন্যই ইসলামকে আমরা সর্বোত্তম জীবন বিধান হিসাবে গ্রহণ করেছি  সুশীল লোকেরা আঙুর খায় আর কুশীলরা আঙুর পঁচিয়ে মদ বানিয়ে খায় ভাল আর মন্দের পার্থক্যটা এখানেই মানুষকে যত ইসলামের কাছাকাছি আনা যাবে তত জীবন হবে সুন্দর

আশির দশক জ্যোতিজোস্নার কবিকন্ঠ বলে যাদেরকে আমরা সূচনায় দেখেছিলাম, সে কাফেলা দিনে দিনে বড় হয়েছে মানুষ সাহিত্যের সুবাতাসকে গ্রহণ করেছে সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে নতুন একটি সজীবধারা বেগবান হয়েছে

কিন্তু এটা করতে গিয়ে আমরা দুই ধরনের প্রতিকুলতার সম্মুখীন হই একটি অভ্যন্তরীণ ও অন্যটি বহির্মুখী এ আন্দোলন   প্রমোট করতে যে ইসলামিস্টরা এগিয়ে এসেছিল, তাদেরই একটা অংশ এ আন্দোলনকে পিছন থেকে টেনে ধরছিল ইসলামে শিল্প সাহিত্য চর্চাকে নেগেটিভলি দেখার প্রবণতা এ দেশে একটি মজ্জাগত ধারণা যদিও ইসলাম তা পছন্দ করে না এখনো অনেক আলেম ওলামা সাহিত্যচর্চাকে বেহুদা কাজ মনে করেন এই প্রচলিত ধারনার কারণে আমরা যারা ইসলামী সাহিত্যের বিকাশ চাচ্ছিলাম, আমাদের দাবীও আমরা জোরালোভাবে তুলে ধরতে পারছিলাম না কিন্তু রাসূলের কিছু হাদিস এবং সূরা শোয়ারায় সাহিত্যচর্চার ব্যাপারে মহান রবের ইতিবাচক গাইডেন্স আমাদের সব দ্বিধা ধুয়েমুছে পরিষ্কার করে দেয় এরই মাঝে কবি মুকুল চৌধুরী ও আমার সম্পাদনায় প্রীতি প্রকাশন থেকে বেরোয় রাসুলের শানে কবিতা এতে একটা অধ্যায় ছিল সাহাবীদের কবিতা, একটি অধ্যায় ছিল ভিন্ন ভাষার কবিতা এবং সর্বশেষ অধ্যায় বাংলা ভাষার কবিতা এর মধ্য দিয়ে আমরা বাংলাভাষীদের জানাতে চেয়েছি, যে কবিতা চর্চা সাহাবীরা করতেন, যে কবিতা চর্চা বুজুর্গানে দ্বীন, পীর ও মুজাদ্দিদরা করতেন সে কবিতা চর্চা করা খারাপ হবে কেন? বরং কাব্যচর্চাকে উৎসাহিত করা সুন্নত রাসূল সা, মসজিদে নববীতে কবিতা পাঠের জন্য আলাদা মঞ্চ বানিয়ে তাঁর উম্মতকে বলে দিলেন, কবিদের সম্মান করতে শেখো এভাবেই আমরা এদেশের আলেম ওলামাদের বুঝাতে চেয়েছি, কবিদের ভালবাসতে হয় ভালবাসার টানে নিজের গায়ের চাদর খুলে কবিদের পরিয়ে দিতে হয় এমনকি কেউ যদি কোন সেরা জিনিস উপহার দেয়, লাইক নারী, তবে নিজে ভোগ না করে কবিদের

উপহার হিসাবে তা দিয়ে দিতে হয় এই হচ্ছে ইসলাম এরপরও কি বলে দিতে হবে কবিদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা কোন মুসলমানের জন্য শোভন নয়? রাসুল সা, তাঁর আচরণ দিয়ে কবিদের প্রতি সদয় হওয়া, কবিদের ভালবাসার যে অনুপম দৃষ্টান্ত দেখিয়েছেন, সেটাই মুসলিম জাতির জন্য প্রকৃৃত শিক্ষা "রাসূলের মধ্যে রয়েছে তোমাদের জন্য উত্তম আদর্শ" যারা বলেন, তাদের মনে রাখতে হবে, রাসূল সা, তাঁর আচরণ ও ব্যবহার দিয়েই সে আদর্শ জগতকে শিখিয়েছেন এর বিপরীত কিছু করা বা বলা কিছুতেই ইসলাম সম্মত নয়, যদি তা আমার অপছন্দও হয়

এসব কথা বুজুর্গানে দ্বীন ও ইসলামিস্টদের বুঝাতে আমাদের বিস্তর ঘাম ঝরাতে হয়েছে যুক্তিবুদ্ধি দিয়ে অনেকে বুঝলেও এখনও মন থেকে মেনে নিতে পারছেন না কবি মল্লিকের জীবনটাই কেটেছে এই সংগ্রাম করতে করতে

এটা একটা দূরুহ কাজ এই কথাগুলো তাদের বুঝাতে হয়েছে যারা সবজান্তা তিনি হতে পারেন পীর, হতে পারেন মুফাসসিরে কোরআন, হতে পারেন কোন ইসলামী দলের নেতা এরা সবাই বিদ্যার জাহাজ তারা কারো কাছ থেকে বুদ্ধি নিতে নারাজ

কিন্তু যারা রবীন্দ্রনাথের জুতা আবিষ্কার পড়েছেন তারা জানেন, বুদ্ধিমান পন্ডিতরা যা পারেন না, তা পারেন সামান্য মুচি

আপনারা আমাদের ছোট ভাবতে পারেন, কিন্তু এইসব বিদ্বানদের ইসলাম সম্পর্কিত নলেজ আমাদের অনেক সময় অবাক করেছে মনে হয়েছে, তবে কি তারাও অন্ধের হাতি দেখার মত হাতি দেখছে?

কেউ হাতির শুঁড় হাতিয়ে বলছে এইটা হাতি?  কেউ হাতির দাঁত হাতিয়ে বলছেন, ভাইরে, হাতি দেখি লোহার মত শক্ত কেউ পা হাতিয়ে বলেন, বুঝলাম, হাতি মোটা খাম্বার মতন সবাই হাতিই হাতিয়েছেন, কিন্তু কেউ হাতি দেখেননি

কারো কাছে অজিফা ও দোয়া কালামই ইসলাম, কারো কাছে ইসলাম শুধু ফরজ পালন, কারো কাছে ইসলাম মানে যুদ্ধ জেহাদ এগুলো ইসলামের বাইরের কিছু নয়, কিন্তু এগুলোই ইসলামও নয় হাতি যেমন একটা বিশাল জন্তু, তেমনি ইসলামও এক সামগ্রিক জীবন বিধান কোন সংর্কীনতা দিয়ে ইসলামকে আটক করা যায় না এই ধারনাটি জনমনে ছড়িয়ে দেয়া কবিদের অন্যতম দায়িত্ব তাই কবিদের হতে হয় উদার, মহত, ও সবাইকে ধারন করার মত এক বিশাল মনের অধিকারী মতিউর রহমান মল্লিক ছিলেন সেই রকম এক বিশাল মনের মানুষ যারা তাকে দেখেছেন তারাই অনুভব করতে পেরেছেন, বিশালতা ও ভালবাসা কি জিনিস

শুধু এতটুকুতেই তিনি সীমাবদ্ধ নন ইসলামী সাহিত্য ও সংস্কৃতি কী জিনিস তার বাস্তব নমুনা জনগণের সামনে উন্মুক্ত করাও তার আন্দোলনের অংশ ছিল সংস্কৃতির অন্যতম মাধ্যম গান ও আবৃত্তির তিনি ছিলেন উস্তাদ তিনি নিজে গান লিখতেন, গানে সুর করতেন এবং গাইতেন যে গুণ সবার মধ্যে পাওয়া যায় না যেমন আমিআমি গান লিখতে পারি কিন্তু সুরও করতে পারি না, গাইতেও পারি না এমন অনেকেই আছেন, যিনি সুর করতে পারেন কিন্তু লিখতে পারেন না কারো কারো গায়কী এত চমৎকার যে, তিনি শিল্পী হিসাবেই খ্যাতিমান হয়ে যান কিন্তু এ ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অলরাউন্ডার তার লেখায় যেমন ছিল চমৎকারিত্ব, সুরে তেমনি ছিল বৈচিত্র, আর গায়কীতে ছিল প্রাণস্পর্শী দরদ ফলে তিনি ছিলেন আমাদের থেকে আলাদা ও অনন্য আর এ জন্যই তিনি উস্তাদ শিরোপা পেয়েছিলেন তিনি যে উস্তাদ এ বিষয়টি ছিল সর্বজন স্বীকৃত তিনি ছিলেন আমাদের মাথার মুকুট আমরা জানতাম, তার উচ্চতায় যাওযা আমাদের কারো পক্ষেই সম্ভব না

সাহিত্যিক হিসাবেও তিনি ছিলেন আমাদের গুরু তিনি কবিতা লিখতেন, ছড়া লিখতেন, গান লিখতেন, প্রবন্ধ লিখতেন, ভ্রমণ কাহিনী লিখতেন, অনুবাদ করতেন সাহিত্যের তিনি ছিলেেন সব্যসাচী লেখক এখানেও তিনি অনন্য তিনি ছিলেন সর্ববিষয়ে পারদর্শী আমরা যারা তার সহযোদ্ধা ছিলাম তাদের কারোরই এমন সর্বপ্লাবী গুণ ছিল না আমাদের মধ্যে এক বা একাধিক বিষয়ে পারদর্শিতা থাকলেও এই এতটা বৈচিত্র কারো মাঝেই ছিল না ফলে, তিনিই ছিলেন আশির সাহিত্য সংস্কৃতি বিপ্লবের সেনাপতি আমাদের সৌভাগ্য, আমরা এক কল্যাণময় বিপ্লবে তার সহযোদ্ধা হতে পেরেছিলাম

১৭ই আগষ্ট ২০২০

যেতে হবে আরো বহু দূরঃ ১১

কবি মতিউর রহমান মল্লিক ভাইয়ের সব লেখাই জীবন থেকে নেয়া একেকটা ঘটনা ঘটেছে আর সেই ঘটনার প্রেক্ষিতে তৈরী হয়েছে গান ও কবিতা ফলে, গানগুলো ছিল জীবনঘনিষ্ঠ ও জীবন্ত গানগুলো ছিল প্রাণবন্ত ও প্রাণময় জীবনের অর্জনগুলো অসম্ভব পরিশ্রমে ছিনিয়ে আনতে হয়েছে সারাটা জীবন কেটেছে তার কষ্ট ও বেদনার পথ মাড়িয়ে

তিনি ছিলেন অসম্ভব আবেগী মানুষ ফলে কষ্ট ছিল তার নিত্য সাথী বার বার আঘাত পেয়েছেন, বার বার দিক বদল করেছেন, কিন্তু থেমে যাননি তার জীবন হচ্ছে তার গান তিনি গানে গানে জীবনের দুর্গম পথের কথা বলেছেন তিনি বলেছেনঃ

একজন মুজাহিদ কখনো

বসে থাকে না, বসে থাকে না

যতই আসুক বাঁধা, যতই আসুক বিপদ

ভেঙে পড়ে না, ভেঙে পড়ে না

এটা শুধু গান নয়, এটাই মল্লিক ভাইয়ের জীবনের প্রতিচ্ছবি পদে পদে বাধা পেয়েছেন, সেই বাধা নিয়ে আফসোস করার জন্য তিনি বসে থাকেননি নতুন করে, নতুন উদ্যম নিয়ে আবার চলতে শুরু করেছেন

সময়টা আমার ঠিক মনে নেই, সম্ভবত ১৯৮৭ সালের ঘটনা যে উদ্যম ও উদ্দীপনা নিয়ে বাংলা সাহিত্য পরিষদ গঠন করেছিলেন সে পরিষদ নিয়ে যে বেশীদূর যাওযা যাবে না এটা বুঝতে কষ্ট হয়নি তার তখনো আমি বাংলা সাহিত্য পরিষদের ব্যবস্থাপক আশাহত মল্লিক ভাই বুঝলেন, পরিষদ দিয়ে তার স্বপ্নপূরণ হবে না তাহলে উপায়? তিনি নতুন পথ খুঁজতে লাগলেনসারাদেশের লেখকদের একত্রিত করে বাংলা সাহিত্য পরিষদকে সারাদেশে ছড়িয়ে দেয়ার যে স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন তা যে সম্ভব নয়, এটা তিনি সেদিনই বুঝে গেলেন, যেদিন বার্ষিক এজিএমে নতুন মেম্বার নেয়ার প্রস্তাবে আপত্তি এলো

মোল্লা ভাই পরিষদ গঠন করে দিয়েই বিদায় নিলেন বিআইসির একরুমে যতদিন পরিষদের অফিস ছিল, একেএম নাজির আহমদ ভাই ততদিন পরিচালক হিসাবে ভালই দায়িত্ব পালন করতেন সাহিত্যসভা করতে হবে? বিআইসির মিলনায়তন খোলা বইয়ের স্টক রাখতে হবে, বিআইসির গোডাউনকে ব্যবহার করো আর্থিক সমস্যা? বিআইসি থেকে ধার নাও মানে,  আমাদের কোন সমস্যা নাজির ভাইকে বলারও দরকার হতো না, তার আগেই তিনি সমাধান করে ফেলতেন কিন্তু যখন অফিস বিআইসি থেকে মগবাজার চলে এলো, তিনিও পরিচালকের দায়িত্ব ছেড়ে দিলেন বলা  চলে, বাংলা সাহিত্য পরিষদ এতীম হয়ে গেল নাজির ভাই চলে যাওয়া মানে পরিষদ অভিভাবক শূন্য হয়ে পড়া

মল্লিক ভাই বিষয়টি নিয়ে আবদুল মান্নান তালিব ভাইয়ের সাথে পরামর্শ করলেন তালিব ভাই আরেক নিবেদিতপ্রাণ মাটির মানুষ আমরা সবাই তখন ঢাকা মহানগরীর জনশক্তি মোশাররফ হোসেন খান যশোর থেকে ঢাকায় চলে এসেছে মোশাররফ হোসেন খানের ভাষ্যমতে তালিব ভাইয়ের সাথে আলাপের সময় মোশাররফও সংগে ছিল তালিব ভাই মহানগরীর সাহিত্য সম্পাদক তারা সাহিত্যিকদের সংগঠিত করার জন্য মহানগরী ভিত্তিক একটি সংগঠন দাবী করলেন সেই দাবীরই ফসল সাহিত্য সংস্কৃতি কেন্দ্র প্রথম পরিচালক আবদুল মান্নান তালিব এরপর মল্লিক ভাই এরপর হাসান আবদুল কাইউম সেলিম, খন্দকার আবদুল মোমেন, সাইফুল্লাহ মানছুর, আবুল কাসেম মিঠুন, আসাদ বিন হাফিজ, এবং শেষ পর্যন্ত  মোশাররফ হোসেন খান ২০২০ সালের জুনে মোশাররফকে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়ার ফলে আশির দশকের সূচনাপর্বের সর্বশেষ ব্যক্তিটিরও অবসান ঘটলো বাংলা সাহিত্য পরিষদ বলুন, সাহিত্য সংস্কৃতি কেন্দ্র বলুন, কোথাও আর আশির দশকের স্বপ্নবাজরা রইলো না গোলাম মোহাম্মদ ও মতিউর রহমান মল্লিক এক বুক হতাশা নিয়ে চলে গেলেন প্রভুর দরবারে বুলবুল সরওয়ার বাকশক্তিহীন হয়ে পড়ে আছেন হাসপাতালে মুকুল চৌধুরী পড়ে আছেন মফস্বলে সোলায়মান আহসান কর্মহীন হয়ে বউয়ের চাকরী সম্বল করে পড়ে রইলেন অন্তরালে এখন অবশ্য সন্তানদের হাতে সংসারের ভার অথচ মল্লিক, বুলবুল, সোলায়মান আহসান এদেরকে সোনার বাংলায় ঠাঁই দিয়েছিলেন মুহাম্মদ কামারুজ্জামান আজ সোনার বাংলা আছে, নেই সেখানে আশির কোন স্বপ্নবাজ

মল্লিক ভাই চেয়েছিলেন ছাত্রদের একটি জাতীয় সাংস্কৃতিক সংগঠন থাকবে তার নাম হবে সাইমুম কিন্তু সেটি করার চাইতে জেলায় জেলায় স্বাধীন সংগঠন করে সসাস নামে তাদের সম্মিলিত বডি কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণে থাকার প্রস্তাবটিতে তিনি সম্মত হলে সারা দেশে অসংখ্য সাংস্কৃতিক সংগঠন তারই প্রচেষ্টায় গড়ে ওঠে যাদের আপনারা এখন ময়দানে দেখছেন এরপর এর বিকাশ ঘটে বিভিন্ন দেশে, নানা কারণে শিল্পীরা ছড়িয়ে পড়লে বিশেষ করে রাষ্ট্রযন্ত্রের নিপীড়নের ফলে যারা যে দেশে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে সেখানেই একটি করে সংগঠন গড়ে তুলেছে

এর মধ্য দিয়ে ইসলামী সংস্কৃতির একটি সাংগঠনিক অবকাঠামো সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে

কিন্তু মল্লিক ভাইয়ের স্বপ্ন এতটুকুই ছিল না  তার আশা ছিল একটা সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স ও সাহিত্য পল্লী হয়তো সে আশাও পূরণ হবে কিন্তু মল্লিক ভাইয়ের তা দেখা হবে না

সাহিত্য সংস্কৃতি কেন্দ্র মহানগর ভিত্তিক একটি পেশাজীবী থানার মর্যাদায় বেঁচে থাকলেও এটি একটি নিরেট সাংগঠনিক থানা একজন কবি কয়টা কবিতা লিখলো এর চাইতে কয়জন মেম্বার বাড়ালো এটিই আন্দোলনের কাছে বড় প্রশ্ন

সংগঠনের কাছে একজন ডাক্তার ও একজন কবি দুজনই পেশাজীবী কিন্তু কবিতা লিখলে পয়সা কে দেয়,  এটা কিন্তু আমাদের আজো জানা হলো না তাহলে আমরা কবিতা বিক্রির একটা হাট পেতাম

বিপরীত উচ্চারণের পর বাংলা সাহিত্য পরিষদ, এরপর সাহিত্য সংস্কৃতি কেন্দ্র, স্বপ্ন পূরণের আশায় একে একে ক্রমাগত এগিয়ে চলা কিন্তু না, স্বপ্ন ওড়ে চলে কোন সুদূরে মল্লিক ভাইকে ধারণ করতে পারে না বিআইসি, ধারণ করতে পারে না সাপ্তাহিক সোনার বাংলা বাংলা সাহিত্য পরিষদে তার দরকার নেই সাহিত্য সংস্কৃতি কেন্দ্র কোন প্রতিষ্ঠান নয়, সংগঠন তারা স্বেচ্ছাশ্রম নেয়, বেতন দেয় না ঢাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে থাকার মত কোন সংস্থান নেই তবে কি বাঘেরহাটের ছেলে আবার বাগেরহাট চলে যাবেন? তিনি গেলেন মীর কাসেম আলীর কাছে মীর কাসেম আলী তাকে ইবনে সীনায় চাকরী দিলেন ইসলামী ব্যাংককে রাজি করালেন সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে প্রতিষ্ঠা করলেন বাংলাদেশ সংস্কৃতি কেন্দ্র কেন্দ্রের নাম দিলেন প্রত্যাশা প্রাঙ্গন এ প্রতিষ্ঠান জন্মই হয়েছিল মল্লিক ভাইয়ের জন্য তিনি এর পরিচালক হলেন প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কাজ করার নতুন দ্বার খুলে গেল তিনি সেখানে অডিটোরিয়াম করলেন, পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করলেন, রেকর্ডিং স্টুডিও করলেন শুরু করলেন জেলায় জেলায় শাখা বিস্তার স্বপ্ন পূরনের পথে আরো এক ধাপ এগিয়ে গেলেন কিন্তু এটা করতে কি পরিমান শ্রম দিতে হলো সে জানেন কেবল মল্লিক ভাই

এই পথ পাড়ি দিতে গিয়ে কি পরিমান বেদনার নদী সাঁতরাতে হয়েছে তা তিনি ছাড়া কেউ জানেন না তিনি নিজেকে একটু গুটিয়ে নিলেন কাকে বিশ্বাস করবেন আর কাকে করবেন না, এই দ্বন্দ্বে পড়ে গেলেন আমরা তার যাতনা দেখতে পেতাম না, মাঝে মাঝে কিছুটা আঁচ করতে পারতাম

তখন মোবাইল ফোনের ছড়াছড়ি ছিল না দেখা সাক্ষাত করা ছাড়া যোগাযোগের কোন উপায় ছিল না হঠাৎ একদিন বিকেল বেলা গনি ভাই এলেন আমার বাসায় গনি ভাই মানে রংপুরের গনি ভাই যিনি পরে অধ্যক্ষ আবদুল গনি হিসাবে এলাকায় পরিচিত হয়েছিলেন এমপি হওয়ার জন্য নির্বাচনও করেছিলেন তিনি আলুবাজার মেসে মল্লিক ভাইদের সাথেই থাকতেন দুপুরে মল্লিক ভাই মেসে ফিরেননি, খাবারও খাননি গনি ভাই চিন্তিত হলেন বললেন, এমনটি তো হওয়ার কথা নয় না খেলে রান্নার আগেই জানাতে হয়, এটাই মেসের নিয়ম তিনি কিছু জানালেনও না, খেতেও এলেন না, এ কেমন কথা? তিনি একটা রিকসা নিয়ে সোজা আমার বাসায় বললেন, মল্লিক ভাইয়ের খবর জানেন? উনি কিছু না জানিয়েই মেসে অনুপস্থিত দুপুরে খেতেও আসেন নি চিন্তার রেখা পড়লো আমার কপালেও কারণ আমরা কোথাও গেলে কাউকে না কাউকে বলে যাই বলতে না পারলে অন্তত চিরকুট রাখি কিন্তু কাউকে কিছু না বলে এভাবে লাপাত্তা হওয়া তো ভাল কথা নয় এবার আমরা দুই ভাই ঘন্টা হিসাবে একটা পরিচিত রিকসা নিলাম উদ্দেশ্য, মল্লিক ভাই যেসব জায়গায় যেতে পারেন সেসব জায়গায় ঢু মারা

কমলাপুরে থাকতো সাইমুম শিল্পী জাহিদ হোসাইন তার বাসায় গিয়ে আমরা একটা চিরকুট পেলাম, যেটা তাকেই লেখা মল্লিক ভাই তাকে বলেছে, এই চিঠিটা আজকে খুলবে না, কালকে পড়বে আমরা তার কাছ থেকে চিঠিটা নিলাম এবং একটু সরে গিয়ে পড়লাম চিঠির হুবহু লেখা মনে নেই, তবে মূল কথা হলো, রাতের কোন এক বাসে তিনি সীমান্তে যাবেন এবং সেখান থেকে ভারতে তারা যেন চিন্তা না করে এ দেশে নেতৃত্বের কামড়াকামড়ি তার ভাল লাগে না

চিঠিটা আমরা আর জাহিদকে ফেরত দিলাম না বললাম, মল্লিক ভাই যদি আবার আসে তবে তাকে বলো, চিঠিটা আমরা নিয়ে গেছি আমরা বুঝলাম, সাইমুমের সবাইকে তিনি  এ চিঠি দেবেন এবং আমরাও একটা ছক একেঁ তার পিছু ধাওয়া করলাম আমরা যেখানেই যাই সেখানেই একটা করে চিরকুট পাই, আর তারা বলে, কিছুক্ষণ আগেই তিনি এটা দিয়ে গেছেন এভাবে রাত নয়টার দিকে আমরা গেলাম সাইফুল্লাহ মানছুরের বাসায় গিয়ে শোনলাম বিকেলে মল্লিক ভাই তাদের বাসায় একটা ব্যাগ রেখে গেছেন এবং যখন পারেন এসে নিয়ে যাবেন বলেছেন বুঝলাম, আমরা শিকারের কাছাকাছি চলে এসেছি তখন এশার নামাজ হয়ে গেছে আমরা এসে বসলাম প্রফেসার সাবের মসজিদের বারান্দায় বারান্দার বাতি নিভিয়ে দিলাম রিকসা বিদায় করে দিলাম এবার অপেক্ষার পালা বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলোনা একটুপর একটা রিকসা এসে অন্ধকার গলিতে ঢুকলো একজন লোক নামলো রিকসা থেকে তিনি মানছুরের বাসার দিকে হেঁটে যাচ্ছেন আমরাও উঠে দাঁড়ালাম মল্লিক ভাই কলিংবেল বাজাতেই কেউ এসে দরজা খুলে দিল মল্লিক ভাই রুমে ঢুকলেন, তার পিছে পিছে আমরাও ঢুকলাম

আমাদের দেখেই মল্লিক ভাই যা বুঝার বুঝে নিলেন আমরা কোন রিএ্যাকশন শো করলাম না বললাম, মিলন ভাই আপনাকে এখনি কলাবাগান মেসে দেখা করতে বলেছেন

তিনি আমাদের দিকে তাকিয়ে একটু রহস্যময় হাসি হাসলেন আমরা একটা বেবীটেক্সী ডেকে সোজা কলাবাগান মেসে চিঠিগুলো তুলে দিলাম মিলন ভাইয়ের হাতে সে রাতে আমাদের আর ঘরে ফেরা হয়নি গভীর রাতে এসে আলফালাহর মেহমানখানায় মল্লিক ভাইকে মাঝখানে রেখে দুই ভাই দুই পাশে শুয়ে পড়লাম

এটা কোন গল্প নয় মানসিক যন্ত্রণা কোন পর্যায়ে গেলে একটা মানুষ এমন আচরণ করতে পারে একটু ভাবুন একবার না, একাধিকবার তিনি এমন বিড়ম্বনার শিকার হয়েছেন

আজকে মল্লিক ভাই মরার দশবছর পর কেউ দশদিনব্যাপী, কেউ মাসব্যাপী, কেউ বছরব্যাপী মননে মল্লিক স্মরণ ২০২০ পালন করছেন এটি খুবই আনন্দের কথা কিন্তু আগামী দিনের পথ চলার জন্য কিছু প্রশ্নের জবাব পাওয়া ও কিছু বিবেচনা মল্লিক ভক্তদের করা উচিত কেবল আবেগ দিয়ে আন্দোলন হয় না এর জন্য প্রয়োজন সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ প্রয়োজন অতীত থেকে শিক্ষা গ্রহণ

ইসলামপ্রিয় শিল্পী ও লেখকদের মধ্যে এতো শপথভীতি কেন? তারা ইসলামের জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত, কিন্তু শপথ নেয়ার কথা বললেই পিছিয়ে যায় কেন?

মল্লিকসহ আমরা যারা শপথ নিয়েছিলাম বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ পার হল, আমরা নতুন করে আর কাউকে শপথ নিতে রাজি করাতে পারছিনা কেন?

সৈনিককে ময়দানে পাঠাতে হয় অস্ত্র দিয়ে যাদের হাতে অস্ত্র দিলাম তারা ময়দানে যায় না কেন? আর যারা ময়দান চষে বেড়াল তারা দীর্ঘ অর্ধশতাব্দী পার হওয়ার পরও অস্ত্রহীন কেন? অর্থাৎ লেখকদের লেখা প্রকাশ ও শিল্পীদের শিল্পকর্ম বিকাশের সুযোগগুলো কারা বন্ধ করে দিল? আলমানার, বাংলা সাহিত্য পরিষদ, সংগ্রাম, আধুনিক প্রকাশনী, মাসিক কলম, পৃথিবী, সোনার বাংলা, কিশোরকন্ঠ, এডুকেশন সোসাইটি এইসব প্রতিষ্ঠান যদি নতুন লেখক ও শিল্পীই তৈরী করতে না পারে তাহলে এসব প্রতিষ্ঠান বানানো হলো কেন?

একদিন যারা শপথ নিয়ে সাইমুমের পরিচালক হয়েছিল তারা এখন শপথের বাইরে কেন?

আবুল আসাদ রচনাবলী,  তালিব রচনাবলী, জামেদ আলী রচনাবলী, মল্লিক রচনাবলী এসব বের করার জন্যই তো বাংলা সাহিত্য পরিষদ গঠন করা হয়েছিল এখন দেশজ কোত্থেকে আসলো? কেন এলো? মল্লিক রচনাবলী বের করার দেশজ কে?

আশির দশক বলে মল্লিকের নেতৃত্বে যে লেখক গোষ্ঠীকে নতুন ধারার সাহিত্য সৃষ্টির দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল তারা কই? পঞ্চাশ বছরে তারা কি করলো? তারা কি ঘুমিয়ে আছে, নাকি কিছু সৃষ্টি করতে পেরেছে?

 তারা ইসলামী ধারার যে সাহিত্য সৃষ্টি করেছে সেই সাহিত্য জাতির সামনে তুলে না দিয়ে নবীন লেখক খুঁজতে কে বলেছে নব্য স্বপ্নবাজদের? রান্না করা খাবার ঘরে পড়ে আছে,  বেড়ে দেয়ার লোক নাই, রান্না ঘরে কারা রান্না চড়ায় নতুন করে? আমার ক্ষেতের ফসল নষ্ট হচ্ছে তোলার লোক নাই, আমি যাই পাশের গাঁয়ে ধান কাটতে নিজের ছেলে সাতদিন না খাওয়া, আমি হাটে ঢোল পিটাচ্ছি, খাবার প্যাকেট কে নেবেন? একের পর এক এমনসব ঘটনা ঘটতেই লাগলো

আজ পর্যন্ত কি বেরিয়েছে মল্লিকের শ্রেষ্ঠ কবিতা, আলীমের নির্বাচিত কবিতা, আশির দশকের নির্বাচিত দশটি কাব্য?

আশির কবিদের গাছে তুলে দিয়ে মই সরিয়ে নেয়ার বুদ্ধিটা কি শরিয়তসম্মত? জামেদ আলী তো কারো পিছে পিছে ঘুরেননি আমার বইটা ছেপে দিন বলে, বরং তিনি আগে ফরমায়েশ পেয়েছেন, পরে লিখেছেন   অথচ তার  রচনাবলীটাও আমরা বের করতে পারিনি কিন্তু নবীন লেখককে আমরা মোটা অংকের পুরষ্কার দিচ্ছি মহাসমারোহে বই বের করে দিচ্ছি না, নবীন লেখককে উৎসাহিত করা দরকার এটা যেমন ঠিক, তেমনি আমরা কেমন সাহিত্য চাই তার নমুনা আগেই তাদের সামনে দেয়াটা আরও বেশী দরকার

আরো কথা আছে অন্যসময় বলবো

১৯শে আগষ্ট ২০২০

যেতে হবে আরো বহু দূরঃ ১২

জানি, আমার লেখা পড়ে কেউ কেউ আমাকে পন্ডিত ভেবে নিয়েছেন কিন্তু আমি যে মোটেই পন্ডিত নই এটা আপনারা জানেন না জুতা আবিস্কারের সেই মুচির মতই কখনো কখনো আমার বুদ্ধি কাজে লেগে যায় আমি যে কোন পন্ডিত নই, সেটা আমার চাইতে কেউ বেশী জানে না

২০২০ সালে কবি মতিউর রহমান মল্লিকের ইন্তেকালের দশ বছর পূর্তি হয় তার ভক্তরা তার পরিচিতি বিশ্বময় ছড়িয়ে দেয়ার লক্ষ্যে কেউ দশদিনব্যাপী, কেউ মাসব্যাপী মননে মল্লিক নামে ব্যাপক অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করেছে কেউ কেউ মল্লিকবর্ষ পালনেরও আওয়াজ তুলছেন মল্লিক ভক্তদের জন্য এটা বিরাট আনন্দের ব্যাপারআমি এ উদ্যোগের সর্বাঙ্গীন সফলতা কামনা করি

বাংলাদেশ সংগীত কেন্দ্রের সেক্রেটারী  আবু তাহের বেলাল বলেছেন, মল্লিক বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী তবে তার সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি প্রথমে কবি ও তারপরে শিল্পী ও গীতিকার তার শিল্পীসত্ত্বা কবি সত্ত্বাকে অতিক্রম করতে পারেনি আমি এ মন্তব্যের সাথে পুরোপুরি একমত

আসলে লেখক শিল্পী জানেনা তিনি কোন পরিচয়ে বড় হবেন ভক্তরাই কাউকে বানায় বিশ্বকবি, কাউকে পল্লী কবি, কাউকে বিদ্রোহী কবি মল্লিকের পরিচয়ও ভক্তরাই নির্ধারণ করবেন, তিনি কোন পরিচয়ে বড় হবেন তবে তিনি বাংলা সাহিত্যে আশির দশকের একজন সেরা কবি হিসাবে যে স্বীকৃত হবেন, এতে আমার কোন সন্দেহ নেই

মল্লিক ভাই বাদ্যবিহীন ইসলামী গানের সেনাপতি এ ব্যাপারে কেউ দ্বিমত করবেন বলে মনে হয়না যেমন কেউ অস্বীকার করে না, তিনি আশির দশকে বাংলা কাব্যে শুদ্ধস্বর প্রবর্তনের সিপাহসালার তোফাজ্জল হোসেন খান, সাইফুল্লাহ মানছুর, গোলাম মাওলা, মশিউর রহমান, ওবায়দুল্লাহ তারেক, লিটন হাফিজ এবং আরো আরো অনেকে শিল্পী হিসাবে উঠে এসে যখন বললো, মতিউর রহমান মল্লিক আমাদের ওস্তাদ তখন দেশবাসী অনুধাবন করলো, তিনি কি মাপের শিল্পী ছিলেন এই শিল্পীদের যদি তুলে আনা না হতো তবে তিনিও উঠে আসতেন না একা একা কোন আন্দোলন হয়না এই গানকে প্রমোট করার জন্য আমাদের যেতে হয়েছে সুরকারের কাছে, শিল্পীর কাছে যেতে হয়েছে রেকর্ড করার জন্য স্টুডিওতে কিনতে হয়েছে ক্যাসেট তারপর এগুলোকে চিত্রায়িত করতে হয়েছে  পরিশ্রম ও পুঁজি বিনিয়োগের ফলে গানের জগতে আমরা ইসলামী সংস্কৃতির একটি নমুনা হাজির করতে সমর্থ হয়েছি যদি এটা আমরা না করতাম তবে মল্লিক ভাই বিস্মৃতির অতলে কবেই হারিয়ে যেতেন আমরা গানকে গ্রাম পর্যন্ত নিয়ে যেতে পেরেছি, শিশু, বৃদ্ধ, নারী সবার হাতে হাতে তুলে দিতে পেরেছি, তাই তার গান বেঁচে গেছে, টিকে গেছে

এ জন্য আমাদেরকে তোফাজ্জল হোসেন খান, সাইফুল্লাহ মানছুর, গোলাম মাওলা, মশিউর রহমান, ওবায়দুল্লাহ তারেক, লিটন হাফিজ এদেরকে নার্সিং করতে হয়েছে

এবার কবিতার কথা বলি

কালের বিচারে মল্লিক ভাই বাংলা সাহিত্যে আশির দশকে শুদ্ধস্বর বিস্তারের নায়ক হিসাবে বরিত হবেন এ ব্যাপারে সন্দেহ নেই কবি সুকান্তের সৃষ্টির পরিমান অঢেল নয় কিন্তু তার কবিতাকে তার আদর্শের পতাকাবাহীরা প্রমোট করেছেন তার কবিতা তার আদর্শের পতাকাবাহীরা প্রমোট করেছে বলেই তার কাব্যসমগ্র এখন সাধারণ মানুষের ঘরেও শোভা পাচ্ছে কবিতার যে শক্তিময়তা তার কাব্যে আছে মল্লিকের কাব্যে তার চাইতেও নান্দনিকতা বিদ্যমান ফলে তিনি হারিয়ে যাবেন এমন আশংকার কোন কারণ নেই গানের মতই তিনি সাহিত্যও বিপ্লব সৃষ্টি করেছেন এবং শুদ্ধস্বর কবিগোষ্ঠীর নেতৃত্ব দিয়েছেন তার সাহিত্য বুঝতে হলে আশির দশককে বুঝতে হবে এক ফুলগাছে বাগান হয়না, বাগানে চাই বৈচিত্রময় ফুলের সমাবেশ এবং সেসব ফুল হওযা চাই বৈশিষ্টমন্ডিত কোন ফুল তার সৌরভের জন্য বিখ্যাত হবে, কেউ ছড়াবে তার রূপের দ্যুতি মানুষ ভালবাসার জনকে গিফট করবে লাল গোলাপ, রূপসী খোঁপায় গুঁজবে বেলী ফুলের মালা এভাবেই মানুষ মল্লিকীয় বাগানের আকর্ষণে আকর্ষিত হবে দীপ্ত হবে মল্লিকের আদর্শে

মল্লিক নেই, রয়েছে তার সৃষ্টি, রয়েছে তার আদর্শ মল্লিকের আদর্শ কেবল তার সমকালীন বন্ধুদের আকর্ষণ করেনি, আকর্ষিত হয়েছিল তার পূর্বসুরীরাও  আল মাহমুদ মল্লিককে উৎসর্গ করে যে বখতিয়ারের ঘোড়া ছুটিয়েছিলেন তা এসে থেমেছে আমাদের মিছিলে আমরা জানতে পেরেছি কেন আমাদের জন্ম হয়েছিল আমরা কোন মিছিল নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি আমাদের দায়িত্ব কর্তব্য কি কিন্তু তার আলোকিত কাব্যমালা আমরা এদেশের জনগণের হাতে তুলে দেয়ার সামর্থ এখনো অর্জন করতে পারিনি আমরা পারিনি মল্লিকের শ্রেষ্ঠ কবিতা পাঠকদের হাতে তুলে দিতে হয়তো কেউ কেউ বলবেন, তার রচনাবলীর প্রথমখন্ড বেরিয়েছে, বাকিগুলোও বেরোনোর পথে কিন্তু রচনাবলী ও শ্রেষ্ঠ কবিতা এক জিনিস নয় রচনাবলী সংরক্ষণের জিনিস, শ্রেষ্ঠ কবিতা ব্যবহারের জিনিস শ্রেষ্ঠ কবিতাগুলি মানুষ নানা অনুষ্ঠানে আবৃত্তি করবে, তার কবিতার রূপে মুগ্ধ হবে শ্রেষ্ঠ কবিতা হবে বহনযোগ্য শুধু মল্লিকের শ্রেষ্ঠ কবিতা বের করলেই হবে না, আশির কাব্যান্দোলনে যারা তার সহযোদ্ধা ছিল তাদের শ্রেষ্ঠ কবিতাও একই সাথে প্রকাশ করতে হবে আমাদেরকে ময়দানে দেখে যারা লাব্বায়েক বলে এ যুদ্ধে লাফিয়ে পড়েছিল, যেমন আবদুল হাই শিকদার, তাদেরও বাছাই কবিতা বের করে নতুন প্রজন্মকে জানাতে হবে, এদেশের ঈমানদার মুসলমানরা এখনো ইসলামকেই ভালবাসে বিশ্বাসী কবিতার কদর যেমন করতেন আমাদের মহানবী, তেমনি তাঁর উম্মতরাও বিশ্বাসী কবিতার কদর করে ইসলামী কবিতা লেখার কারণে আজও যেমন আমাদের মাঝে বেঁচে আছে হাসসান বিন সাবিত ও শেখ সাদী তেমনি যারা ইসলামী কবিতা লেখে তারা দেশের সীমানা ভেঙে, সময়ের আবর্ত ভেঙে বেঁচে থাকে অনন্তকাল আশির দশকে আমরা চট্টগ্রামে গোলাম মওলাসহ একঝাঁক, সিলেটে আবদুল হামিদ মানিক, রাবেয়া রাগিবসহ একঝাঁক, যশোরে গাজী এনামুল হকসহ সারাদেশেই বহু কবিকে লাব্বাইক বলে এ আলোকিত জোসনায় শামিল হতে দেখেছি ব্যক্তি বন্দনা নয়, আদর্শের লড়াইতে যিনিই আমাদের সহযোগী হবেন, এবং আদর্শকে উচ্চকিত করবেন আমরা তারই কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এগিয়ে যাবো

আপনাদের মনে থাকার কথা, কথাশিল্পী আতা সরকার সুন্দর তুমি পবিত্রতম নামে কোরআনের কাহিনী নিয়ে গল্প লিখে আশির দশকে বাংলা সাহিত্যে চমক সৃষ্টি করেছিলেন এরপর তিনি  লিখেন তিতুর লেঠেল, আপন লড়াই উপন্যাস জামেদ আলী লেখেন লাল শাড়ি ও মেঘলামতির দেশেসহ আলোকিত কথাসাহিত্য নূর মোহাম্মদ মল্লিক, ইকবাল কবির মোহন সৃষ্টি করেন শিশু সাহিত্য ভ্রমণকাহিনীতে বিপ্লব সৃষ্টি করেন বুলবুল সরওয়ার এসবই ছিল আশির কাব্যান্দোলনের প্রভাব সাহিত্যের সকল শাখায় সুবাতাস বইতে শুরু করেছিল কিন্তু আমরা সে ধারা বা আগ্রহ ধরে রাখতে পারিনিমল্লিকের মৃত্যর দশবছর পর আমরা বুঝতে পারছি ছলচাতুরি করে ইসলাম হয় না ইসলামের ভালবাসা সব মানুষের জন্য, কিন্তু আদর্শ জলাঞ্জলি দেয়ার নাম ইসলাম নয় আপনি ইসলাম আঁকড়ে ধরা মানেই মানবজাতির জন্য কল্যাণকে আঁকড়ে ধরা আল্লাহর রোদ বৃষ্টি যেমন সবার জন্য তেমনি আল্লাহর মনোনীত ধর্মও সবার জন্যই কল্যাণকর মানুষে মানুষে শ্রদ্ধাবোধ তৈরী, উদারতা, মহত্ব, সততা, নৈতিকতা এইসব গুণ অর্জনে উদ্বোধ্য করাই ধর্মের কাজ

যদি মল্লিককে আমরা সম্মান দিতে চাই, ভালবাসতে চাই, তবে আমাদের বিচক্ষণ হতে হবে হুজুগে মেতে উঠা বুদ্ধিমানদের শোভা পায় না যদি আপনি ভয় দেখিয়ে প্রতিপক্ষকে তাড়াতে চান তবে আপনি সামর্থের চাইতে অধিক শক্তি প্রদর্শন করতে পারেন, কিন্তু যদি মোকাবেলা করতে হয় তবে আপনার উচিত রিজার্ভ ফোর্স রাখা যাতে শত্রু আপনাকে দুর্বল ভেবে অল্পশক্তি নিয়ে আঘাত করে পরাজিত হয় জিততে হলে কখনো প্রতিপক্ষকে ভয় দেখাতে নাই  এটা যেমন সবার জন্য প্রযোজ্য তেমনি সাংস্কৃতিক ময়দানের জন্যও আগে আপনি যোদ্ধা বাড়ান, অস্ত্র বাড়ান এবং জেতার মত শক্তি অর্জন করুন আপনি প্রস্তুত হওয়ার আগেই প্রতিপক্ষকে ময়দানে ডেকে আনা বোকামী

যুদ্ধে পদাতিক, নৌ ও বিমান বাহিনী থাকে সবার সম্মিলিত প্রস্তুতির আগেই কোন বাহিনীকে একা সম্মুখসমরে পাঁঠিয়ে দেয়াও অনুচিত যুদ্ধে যেতে হয় সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিয়ে সাহিত্যকে পিছনে ফেলে সংস্কৃতিকে এগিয়ে নেয়া ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দেয়ার নামান্তর

বিষয়টা একটু পরিষ্কার করে বলি সাহিত্য মানুষের চিন্তা জগতে বিপ্লব ঘটায় আর সংস্কৃতি প্রধানত আবেগে টোকা দেয় সাহিত্য মানুষের বোধ বিশ্বাস ও মননে পরিবর্তন আনে, সংস্কৃতি প্রধানত মনকে উদ্দীপ্ত করে মল্লিক ভাই যেটা গানে গানে বলেছেন এভাবেঃ

হঠাৎ করে জীবন দেয়া

হয়তো সহজ তুমি মানো কি

কিন্তু তিলে তিলে

অসহ জ্বালা সয়ে..........

হঠাৎ করে জীবন দিতে যে জযবা, এটা তৈরী করে সংস্কৃতি আর তিলে তিলে মানুষের বোধবিশ্বাসকে জাগিয়ে তোলে সাহিত্য, মানুষের চিন্তারাজ্যকে পরিশুদ্ধ করে সাহিত্য

তাই বলছিলাম, আগে সাহিত্য দিয়ে মানুষের মনোরাজ্যে পরিবর্তন ঘটান, তারপর সংস্কৃতি দিয়ে তাকে বিপ্লবে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করুন

কবি মল্লিক স্মরণ ২০২০ জাতীয় কমিটি গঠন করা হয়েছে এ কমিটির চমৎকার আয়োজনগুলো আমাদের আশান্বিত করেছে দশবছর পূর্তির এ স্মরণ কমিটির কাছে কবি মল্লিককে ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় করার স্বার্থে " জ্যোসনাস্নাত আশি" বা এধরনের কোন শিরোনামে একবক্সে একগুচ্ছ বই ছাপা দরকার শুধু মল্লিকের শ্রেষ্ঠ কবিতা নয়, এতে থাকবে তার সহযোদ্ধা আসাদ বিন হাফিজ, হাসান আলীম, মোশাররফ হোসেন খান, মুকুল চৌধুরীর শ্রেষ্ঠ কবিতা তেমনি বুলবুল সরওয়ার ও সোলায়মান আহসানের শ্রেষ্ঠ অর্জন মল্লিকীয় আন্দোলনে পূর্বসূরীদের মধ্যে যে প্রভাব পড়েছিল, যে কারণে কালের কলসের কবি আল মাহমুদ বখতিয়ারের ঘোড়া দিয়ে বরণ করে নিয়েছিল আশির সৈনিকদের তার নমুনাও আনতে হবে ময়দানে তেমনি পরবর্তীতে আবদুল হাই শিকদারের মত যারা লাব্বাইক বলে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মিছিলে তাদের শ্রেষ্ঠকর্মগুলো তুলে ধরে জানাতে হবে জাতিকে শুধু তাই নয়, জামেদ আলী ও আতা সরকাররা কথাসাহিত্যে যে বিপ্লব এনেছিল, কোরআনের কাহিনী দিয়ে বানিয়েছিল সুন্দর তুমি পবিত্রতম, সেই নমুনা জাতিকে না দেখালে জাতি বুঝতে পারবে না সাহিত্যের সব শাখায় শুদ্ধস্বর বিস্তারে তার ভূমিকা কি ছিল সাহিত্যে বিগত পঞ্চাশ বছরে তিনি কি পরিবর্তন এনেছিলেন তা জানতে পারলে জাতি ইসলামের আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠবে হতাশা ঝেড়ে ফেলে সত্য, সুন্দর, কল্যাণের আলোয় জাতিকে গড়ে তোলার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়বে  নবীন লেখক সম্প্রদায় মল্লিক ভক্তরা যত তাড়াতাড়ি এসব বুঝবে ততোই সুবাতাসে ভরে উঠবে বাংলা সাহিত্য

২২শে আগষ্ট ২০২০

যেতে হবে আরো বহু দূরঃ ১৩

কবি মতিউর রহমান মল্লিক (জঃ ৫ মার্চ ১৯৫৪, মৃঃ ১২ আগস্ট ২০১০) বাংলা সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের এক দুঃসাহসী সিপাহসালার বিগত শতাব্দীর আশির দশকে তিনি সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে এক নতুন বিপ্লবের বীজ বুনেন বাংলা সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অঙ্গন সে সময় পাশ্চাত্য তথা বিজাতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির রাহুগ্রাসে পড়েছিল বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি যে মানবিক মূল্যবোধ ও সহনশীল সংস্কৃতি নিয়ে পথ চলছিল সে পথ বিষবৃক্ষ দিয়ে ঢেকে দিয়েছিল এই বিদেশী সংস্কৃতি মানবিকতার জায়গায় বাসা বেঁধেছিল অমানবিকতা, বিশ্বাসের জায়গা দখল করেছিল অবিশ্বাস ও সন্দেহ গ্রামপ্রধান সহজ সরল জীবন সংস্কৃতিতে ঢুকে পড়েছিল প্রযুক্তি ও যন্ত্রদানব সুখের সমাজে দুঃখবোধ এসে বাসা বেঁধেছিল সেই দুঃখ তাড়ানোর জন্য বিদেশ থেকে আনা হল মদ ও নেশার দ্রব্য মানুষ নেশাখোর হয়ে জড়িয়ে পড়লো অশ্লীলতা ও অনৈতিক কাজে আর এ নেশা ও অনৈতিক কাজের জন্য দরকার হলো অর্থ মানুষ বাধ্য হলো অসৎ পথে অর্থ উপার্জনে বেড়ে গেল চুরি ডাকাতি রাহাজানি বাড়লো প্রতারণা ভোগের উপকরণ পেয়ে মানুষ হয়ে গেল ভোগবাদী চালু হলো নাচ, গান, বাইজির জলসা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে কুরুচি প্রবেশ করলো বিংশ শতাব্দীর অর্ধেকটা সময় কেটে গেল এই ডামাডোলে এভাবেই আমরা বিদেশী সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের শিকার হয়ে পড়ি

বাংলার বুদ্ধিজীবী ও চিন্তাশীল মহল এ অবস্থায় বিচলিত হয়ে পড়লেন এর থেকে উত্তরণের উপায় খুঁজতে লাগলেন তারা সমাজে শান্তি ও স্বস্তি ফিরিয়ে আনার জন্য শুরু হলো ব্যক্তি উদ্যোগ এভাবেই কেটে গেল আরো দুই যুগ এ উদ্যোগ দানা বাঁধলো আশির দশকে এসে আশির দশকে একদল যুবক এই হতাশাজনক পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য যুথবদ্ধ হলেন তারা সাহিত্য ও সংস্কৃতির এই স্রোত পাল্টে দেয়ার জন্য গঠন করলেন বিপরীত উচ্চারণ এ উচ্চারণ ভুলের বিপরীতে শুদ্ধতার উচ্চারণ অসুন্দরের বিপরীতে সুন্দরের উচ্চারণ এ উচ্চারণ ছিল জাতির আকাংখিত ও প্রত্যাশিত কারণ যুদ্ধবিধস্ত একটি দেশ স্বাধীনতার পর নতুন আশায় বুক বাঁধার স্বপ্ন দেখছিল

যুদ্ধবিধস্ত ও হতাশা পীড়িত একটি জাতির মনে নতুন আশার আলো জাগিয়ে তোলার স্বপ্ন সর্বত্রই  কেমন এক জাগরণ সৃষ্টি করলো বিশেষ করে তরুণ সমাজের মধ্যে তরুণদের একটা অংশ বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার  মাধ্যমে এর উত্তরণ চাইলেন আর একটা অংশ বললেন, মানুষের গড়া কোন মতবাদ দিয়ে এ নৈরাজ্যকর অবস্থার অবসান ঘটানো সম্ভব নয় এ জন্য দরকার এমন কোন দর্শন ও মতবাদ যেটা মানুষের বানানো নয় মানুষের অতীত বর্তমান ভবিষ্যত জানেন এমন কোন সত্ত্বার বানানো সেটাই কোরানিক দর্শন, আমাদের প্রিয় ইসলাম

এই তরুণ গ্রুপটি ছাত্রদের মধ্যে একটি সংগঠন কায়েম করে সূচনা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭৭ সালের ৬ ফেব্রুয়ারী প্রথম সভাপতি নির্বাচিত হন মীর কাসেম আলী

সারাদেশে এ গ্রুপটি দ্রুত বিস্তার লাভ করে মীর কাসেম আলী সারাদেশ সফর করেন তিনি বাগেরহাট গিয়ে এক তরুণের গান শুনে মুগ্ধ হন এ যুবকের নাম মতিউর রহমান মল্লিক তিনি তাঁকে ঢাকায় নিয়ে আসেন ইনিই আশির দশকের শুদ্ধস্বর শিল্পী ও কবিদের সেনাপতি

সাংস্কৃতিক আগ্রাসনে কবি মল্লিকের ভূমিকা আলোচনা করতে গেলে প্রথমেই এ আগ্রাসনের কারণ চিহ্নিত করতে হয় রোগ চিহ্নিত না করে চিকিৎসা করা যায় না তাই আলোচনার আগেই আগ্রাসনের কারণটি আমাদের ভালভাবে বুঝতে হবে

আমি এ ব্যাপারে শুধু একটি কথাই বলতে চাই, সংস্কৃতি সম্পর্কে যত আলোচনাই আপনি পাবেন, তার মূল কথা হচ্ছে, "সংস্কার মূলক কীর্তিই হচ্ছে সংস্কৃতি" আপনার ঘর জরাজীর্ণ হয়ে গেলে আপনি যেমন তা সংস্কার করে বাস উপযোগী করেন, আপনার জামা ময়লা হয়ে গেলে আপনি যেমন তা ধুয়ে পরিষ্কার করেন, জীবনও তেমনি প্রতিদিন আপনাকে দাঁত ব্রাশ করতে হয়, দিনে কয়েক বার অজু করতে হয়, তেমনি প্রতিদিনই জীবনকে সুন্দর করার জন্য আপনাকে সচেষ্ট থাকতে হয় আপনি অফিসে যাওয়ার সময় নিজেকে সংস্কার করে অফিসে যাওয়ার পোশাক পরেন দেহকে সংস্কার করতে হয়, চরিত্রকে সংস্কার করতে হয় এই যে জীবনকে ক্রমাগত উন্নততর করার প্রচেষ্টা এরই নাম সংস্কৃতি সংস্কৃতি হচ্ছে আপনি এখন যে অবস্থানে আছেন সেখান থেকে আরেকটু ভাল অবস্থানে যাওয়ার চেষ্টার নাম

সংস্কৃতি সারা জীবন এই অব্যাহত ভাল হওয়ার প্রচেষ্টার নাম কোরআনে যেটাকে বলা হয়েছে, হে ঈমানদারগণ, তোমরা মুসলমান না হয়ে মৃত্যুবরণ করো না তার মানে, ঈমান আনার পর একজন মুসলমানের যেসব গুণ অর্জন করা দরকার সেইসব গুণ অর্জন করার জন্য সচেষ্ট হও যেখানে ভুল, সেখানেই তওবা যখন বুঝবে, ভুল হচ্ছে তখনই সেখান থেকে প্রত্যাবর্তন করো ভুল থেকে এই ফিরে আসার নামই সংস্কৃতিবান হওয়া

ভারতীয় উপমহাদেশে ইসলামের বিকাশ ঘটেছে অপূর্ণাঙ্গভাব যেটাকে আমি বলি অন্ধের হাতি দেখার মত কারো কাছে ইসলাম কায়েম মানে রাষ্ট্রীয়ভাবে ইসলাম বিজয়ী করা কারো কাছে ইসলাম হচ্ছে কতিপয় আমল ও দোয়া কালাম অধিকাংশ মুসলমান মনে করে মুসলমানের ঘরে জন্ম নিলেই সে মুসলমান আসলে কোরআন ও হাদীস মাতৃভাষায় না থাকার ফলে এ বিপর্যয় ঘটেছে আমরা আরবী পড়ি, কিন্তু মুখে কি বলি সেটা নিজেরাই বুঝি না কেউ কোন মসলা জানতে চাইলে অনেক সময় নিজের বিবেকবুদ্ধি খাঁটিয়ে আলেমরা ফায়সালা দিয়ে দিতেন কিন্তু সে ব্যাপারে ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা অল্পশিক্ষিত আলেমরা জানতেনও না, বলতেনও নাজ্ঞানের স্বল্পতা ও অজ্ঞতার কারণে অনেক সময় কোরানের ভুল ব্যাখ্যা, উল্টো ব্যাখ্যাও আমাদের শুনতে হয়েছে

একটি উদাহরণ দিই আমাদের সমাজে এখনো এ ধারনা রয়েছে, সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চা একটি ফালতু কাজ ও সময়ের অপচয়মাত্র কিন্তু এ ধারনা ইসলামের সম্পূর্ণ বিপরীত এটা যদি ফালতু কাজই হতো তবে আল্লাহ কবিদের নিয়ে কোরআনে একটি পুর্ণাঙ্গ সুরা নাজিলের কোন প্রয়োজন অনুভব করতেন না কেউ কেউ বলতে পারেন, আশ শোয়ারা কোরানের একটি সুরার নামমাত্র, যেমন বাকারা গরুর গুনকীর্তন করা এর উদ্দেশ্য নয় কিন্তু না, বিষয়টি এমন নয় এই সুরায় কবিদের স্বাভাবিক গুণ বৈশিষ্ট তুলে ধরা হয়েছে এরপর ঈমানদার কবিদের যোগ্যতা বর্ণনা করা হয়েছে কবিদের দায়িত্ব কর্তব্য স্পষ্ট করে উল্লেখ করা হয়েছে আল্লাহর দেয়া গাইডলাইন না মানলে কবিদের পরিনতি কি হবে তাও এ সুরায় বর্ণিত  হয়েছে এরপরও একজন ঈমানদার কি করে কাব্যচর্চাকে ফালতু ও বেহুদা কাজ মনে করতে পারেন? আসলে সমাজে ইসলামের শিক্ষাটি ভুলভাবে পরিবেশনের জন্যই আমরা ইসলামের বিপরীত ধারনার শিকার হয়েছিলাম সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের প্রধান কারণ আমাদের এই অজ্ঞতা

কাব্যচর্চার শুরুতে আমরাও প্রচলিত ধারনাকেই সহিহ মনে করতাম, মনে করতাম, সংস্কৃতি চর্চা তেমন জরুরী কিছু নয় ফলে সংস্কৃতি চর্চার গুরুত্ব আমাদের কাছেও অস্পষ্ট ছিল কবি মতিউর রহমান মল্লিক চাচ্ছিলেন,  এ অস্পষ্টতা আমাদের চোখের সামনে থেকে সরিয়ে দিতে তার সহযোদ্ধা হিসাবে তিনি চাইতেন, কোরআন ও সুন্নাহর আলোকে শিল্প সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার গুরুত্ব আমরা উপলব্ধি করি এবং জাতিকে তা জানাই ইসলাম যদি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান হয় তাহলে সাহিত্য সংস্কৃতির ব্যাপারে তার বক্তব্য থাকবেই তিনি সংস্কৃতি চর্চার গুরুত্ব কোরআন হাদিস থেকে জাতির সামনে তুলে ধরতে চাচ্ছিলেন প্রচলিত ধারনার বিপরীত সংস্কৃতি চর্চার ইসলামী গুরুত্ব জাতির সামনে তুলে ধরা ছাড়া সাংস্কৃতিক আগ্রাসন রোধ করা সম্ভব নয়

কোরান ও হাদিস পড়ে আমরা অভিভূত ও বিস্মিত হলাম ইসলামে সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চার অপরিসীম গুরুত্ব দেখে এ ব্যাপারে প্রচুর হাদিস ও দৃষ্টান্ত আমাদের হাতে সংগৃহীত হলো কোরান পড়েই আমরা জানতে পারলাম, শিল্পী সাহিত্যিকদের সাথে কেমন আচরণ ও ব্যাবহার করতে হবে, কবিরা কতটা সম্মানীয় একজন সাধারণ মানুষ ও কবির মধ্যে গুনগত বিরাট পার্থক্য রয়েছে এ ব্যাপারে অনেক দৃষ্টান্তের মধ্যে মাত্র একটা দৃষ্টান্ত এখানে উল্লেখ করতে চাই, যাতে কবির সাথে কেমন আচরণ ইসলাম সম্মত তা ফুটে ওঠেছে

সহীহ হাদিস ও কোরআনে এ বিষয়টি বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করা হয়েছে

আরবের বিখ্যাত কবি হাসসান বিন সাবিতের নাম আপনারা সবাই জানেন তিনি পরবর্তীতে শায়েরুন্নবী বা রাসূলের কবি বলে খেতাবপ্রাপ্ত হয়েছিলেন একজন নবী কোন কবিকে অতীতে বা কখনো খেতাব বিতরণ করতে শুনেছেন? কবিদের এ বিরল সম্মান শুধু আমাদের নবীই দিয়েছেন পৃথিবীর কোনো মসজিদে ইমামের মিম্বরের পাশে কবিতা পাঠ করার জন্য আলাদা মঞ্চ বানাতে শুনেছেন? কিন্তু আমাদের নবী কবিদের জন্য তাও করেছিলেন এর কোন নজিরও আর পৃথিবীতে নাই আমরা যেমন কবিতা শুনে তার ওপর আলোচনা করি নবীও তেমনি হাসসান বিন সাবিতের কবিতার ওপর আলোচনা করতেন নবী তার আলোচনায় হাসসান বিন সাবিতের কাব্যের প্রশংসা করতেন কখনো কখনো সম্পাদনার কাজও করতেন, বলতেন, হাসসান, ওভাবে নয় এভাবে বলো

কে বলছেন? বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম মানুষ, শ্রেষ্ঠ নবী, আল্লাহর হাবীব, আমাদের শেষ নবী এই হাসসানকেই আল্লাহ নবীর মাধ্যমে জীবিত অবস্থায় বেহেশতের সুসংবাদ দিয়েছেন ভাবা যায়, কবিতা লিখে বেহেশতে যাওয়ার সুসংবাদ পাওয়ার কথা!

রাসুল সা যা করেছেন, বলেছেন, সম্মতি দিয়েছেন এর সবকিছুই সুন্নাত

তার মানে--

রাসূল সা কবিতা শুনতেন, তাই কবিতা শোনা সুন্নত

রাসূল সা কবিতা আলোচনা করতেন, তাই কবিতা আলোচনা করা সুন্নত

রাসূল সা কবিতা এডিট করতেন, তাই কবিতা এডিট করা সুন্নত

রাসূল সা কবিতার প্রশংসা করতেন, তাই কবিতার প্রশংসা করা সুন্নত

রাসূল সা মসজিদে কবিতা পাঠের আয়েজন করতেন, তাই মসজিদে কবিতা পাঠের আয়োজন করা সুন্নত

রাসূল সা কবিতা পাঠের জন্য মঞ্চ বানিয়ে দিয়েছিলেন, তাই কবিতা পড়ার মঞ্চ বানিয়ে দেয়া সুন্নত

রাসূল সা কবিদের খেতাব দিতেন, তাই কবিদের খেতাব বা পদক দেয়া সুন্নত

রাসূল সা কবিদের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন, তাই কবিদের পৃষ্ঠপোষকতা করা সুন্নত

একটিমাত্র ঘটনা থেকে প্রিয় নবী এতগুলো সুন্নত উম্মতের পালনের জন্য রেখে গেলেন যা এবাদত হিসাবে গণ্য রাসুলের উম্মত হিসাবে তাঁর এ সুন্নতগুলো পালনের জন্য উৎসাহ দেয়ার অনুভূতি কি কখনো আপনার জাগেনি বা জাগে না? আপনারা নিয়ত করে এ কাজগুলো করার আবেগে কখনো কি সিক্ত হয়েছেন?

না, শুধু এটুকু বলার জন্য এ ঘটনার অবতারনা করা হয়নি এবার মূল কথায় আসি

যদি আপনার দ্বীনদার পরহেজগার প্রিয়তম স্ত্রীর চরিত্র নিয়ে কেউ প্রশ্ন তোলে এবং কোন ঘটনা বর্ণনা করে বাজে ইঙ্গিত দেয় আর তার চরিত্রে মিথ্যা কালিমা লেপন করে তবে আপনার কেমন লাগবে? যদি ওই অভিযোগের কারণে আপনি আপনার স্ত্রীকে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিতে বাধ্য হন আর তাতে সে নাওয়া খাওয়া ছেড়ে দিয়ে পাগলিনীপ্রায় হয়ে যায় আর তা শুনে আপনি অসহ্য যন্ত্রণায় কাতরাতে থাকেন সেই দুঃসহ মুহূর্তগুলোর কথা ভাবুন যদি এভাবেই কেটে যায় দীর্ঘ চল্লিশটা দিন তারপর আপনি  সত্যিটা জানতে পারেন, আপনি জানতে পারেন অভিযোগটি ছিল মিথ্যা ও বানোয়াট, তখন আপনার কেমন লাগবে? আপনি কি অভিযোগকারীকে ক্ষমা করে দেবেন?

তাহলে শুনুন, আরবের মশহুর কবি হাসসান বিন সাবিত এমনি একটি মিথ্যা অপবাদ আনেন মা আয়েশা রা বিরুদ্ধে এতে প্রিয়নবী  সা যারপরনাই বিচলিত ও ভেঙে পড়েন তিনি বুকে পাথর বেঁধে মা আয়েশাকে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দেন কল্পনা করতে পারেন কতবড় জঘন্য কাজ করেছে এ নাদান মা আয়েশার রা চরিত্র নিয়ে মিথ্যা অপবাদ ছড়িয়ে দিয়েছে মক্কার অলিতে গলিতে এ নিয়ে চলছে মুখরোচক আলোচনা একদিন যায়, দুদিন যায়, সপ্তাহ কাটে, মাস কেটে যায়, আলোচনা চলতেই থাকে না, কেন ফয়সালা নেই অবশেষে চল্লিশ দিন পর আল্লাহতায়ালা অহীর মাধ্যমে নবীকে জানান ঘটনার বিস্তারিত জানান, এ অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা ও বানোয়াট

এ আয়াত নাজিলের পর দমবন্ধ মুসলমানরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে মক্কার অলিগলি এ মিথ্যা অপবাদকারীর শাস্তির দাবীতে উত্তাল হয়ে ওঠে নবীপ্রেমিকদের অন্তরে জ্বলে উঠা এ ক্ষোভের আগুন ক্রমাগত বাড়তে থাকলে মা আয়েশা রা মুখ খোললেন বললেন, কবি হাসসান একজন বড় কবি তিনি কবিতার মধ্য দিয়ে ইসলামের ফুল ফোটান এ ফুল মুমলমানের আত্মার খোরাক জোগায় আমি চাই না বিচারের নামে তিনি কোন কঠিন শাস্তির সম্মুখীন হোক মা আয়েশা রা হাসসান বিন সাবিতকে মাফ করে দেন ইসলামে এ এক অনন্য নজির এরকম জঘন্য ও মিথ্যা অভিযোগের পরও কোন মহিলা নিজে থেকে অপরাধীকে ক্ষমা করে দেয়, এমন নজির আমার জানা নেই তিনি যে মহানুভবতা ও উদারতা প্রদর্শন করেছেন,   তা কেবল ইসলামের শিক্ষার ফলেই সম্ভব মানব সভ্যতার ইতিহাসে এ এক বিরল দৃষ্টান্ত ভাবুন, কবিতার প্রতি কতটা ভালবাসা থাকলে, কবির প্রতি কতটা দরদ ও শ্রদ্ধা থাকলে এমন উদারতা প্রদর্শন করা সম্ভব মনের কষ্ট মনের ভেতর কবর দিয়ে রাহমাতুল্লিল আলামিন, প্রিয় নবী সা নিজেও

কবিকে মাফ করে দিয়ে শায়েরুন্নবী হিসাবে কবিকে নিয়োগ দেন (সোবহানাল্লাহ)তিনি কবিতা পড়ার জন্য মনজিদে নববীতে আলাদা মিম্বর বা মঞ্চ বানিয়ে দেন যেহেতু যাদের সাথে অন্যায়কারী অন্যায় করেছেন (নবীজি ও মা আয়েশা রা) তারা তাকে মাফ করে দিয়েছেন সেহেতু আল্লাহও তাকে ক্ষমা করে দিলেন তারপর নবীর মাধ্যমে তিনি কবিকে দিলেন বেহেশতের সুসংবাদ এই হচ্ছে কবিদের সাথে ইসলামের আচরণ একজন কবির সাথে কেমন আচরণ করতে হবে এভাবেই নবী ও নবী পরিবার তার উম্মতকে জীবন্ত উদাহরণ সহকারে শিখিয়ে দিলেন

মা আয়েশার রা আচরণ থেকে আমরা শিখতে পারি কবিদের সাথে কেমন আচরণ করা দরকার

রাসুলের (সা) মনে আঘাত দেয়ার পরও তিনি কবিতার সম্মানে একজন কবিকে ক্ষমা করে দিয়ে উম্মতকে এই ম্যাসেজ দিলেন, কবিদের প্রতি যতটা পারো সদয় হয় এটাও সুন্নতের অংশ

ব্যাক্তির সাথে করা অন্যায় যদি সংশ্লিষ্ট ব্যাক্তি ক্ষমা করে দেয় তবে আল্লাহও  তাকে ক্ষমা করে দেন

কবিকে ক্ষমা করে দেয়ার পর অতীতের অপরাধ স্মরণে না রেখে কবিকে শায়েরুন্নবী  ঘোষণা ও কবির জন্য মঞ্চ তৈরী করে দিয়ে এটাই বুঝালেন, অপরাধ মাফ করে দেয়ার পর সে কথা আর স্মরণ করতে হয় না

নবীর জীবনে এমন ঘটনা একটা, দুটো নয়, অনেক কখনো তিনি কবিতা শুনে খুশিতে তাৎক্ষণিকভাবে গায়ের চাদর খুলে পড়িয়ে দিতেন কবির গায়ে

একজন কবির মৃত্যুদন্ড ঘোষণা হওয়ার কবি ছদ্মবেশে নবীর সাথে দেখা করেন নবী তার অভিপ্রায় জানতে চান তিনি জানান, তিনি নবীকে কবিতা শোনাতে চান নবীর অনুমতি নিয়ে তিনি নবীকে কবিতা শোনান খুশী হন নবী বলেন, হে কবি, বলুন আপনি কি চান কবি তার পরিচয় দিয়ে মৃত্যুদন্ড মওকুফের আবেদন জানান রাসূল সা.  তাকে মাফ করে দেন এই হচ্ছে কবি ও কবিতার প্রতি নবীর মহব্বতের নমুনা এই হচ্ছে কবিদের ব্যাপারে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি

কবি মতিউর রহমান মল্লিক ও আশির কবিরা কবির প্রতি ইসলামের এ অনন্য ভূমিকা আবিষ্কার করেন

তারা আরো জানতে পারেন, মানুষের সৃজন প্রতিভা তার প্রভুর দান তার জন্য এটা তার প্রভুর নেয়ামত বান্দার কাজ হচ্ছে স্রষ্টার দেয়া এই নেয়ামতের শোকর আদায় করা একে যথাযথ কাজে লাগানো বান্দা যদি এই নেয়ামতকে যথাযথ কাজে না লাগায় তবে এ জন্য তাকে জবাবদিহি করতে হবে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে ফলে, কবিতা লেখা আপনার জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে দেয়া অর্পিত ডিউটি আপনি যদি কবিতা না লেখেন তবে আপনি আল্লাহর হুকুম অমান্য করলেন এরপরও কি বলবেন, কবিতা লেখা তথা শিল্পচর্চা করা ইসলাম অপছন্দ করে?

না, ইসলাম আপনার নেতার কথায় চলবে না, পীরের পছন্দে চলবে না, ইসলাম মানে কোরআন ও হাদিসকে মেনে চলা আর কোরআন ও হাদিসের চোখে কব্যচর্চা করা কতটা জরুরী তা আপনি কোরআন ও হাদিসেই পাবেন সেই থেকে আমরা ইসলামী সাহিত্য চর্চায় সর্বশক্তি নিয়োগ করি আমাদের কাজ হচ্ছে মানুষকে আনন্দিত রাখা তাদেরকে সুন্দরের সাথ পরিচয় করানো মানুষকে হতাশা ও দুঃখ গ্রাস করলে তার মনে জাগিয়ে তোলা আশা ও উদ্যম আল্লাহর সৃষ্টি রহস্য আবিস্কার করে তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয়া, তোমরা আল্লাহর কোন কোন নেয়ামতকে অস্বীকার করবে? এই পৃখিবী, তুমি আমি, পৃথিবীর সবকিছু আল্লাহর প্রেমের ফসল প্রেমময় প্রভুর কোন নেয়ামতকে অপছন্দ বা ঘৃণা করার অধিকার নেই তার সৃষ্টির লেখকদের কাজ পৃথিবীময় এ প্রেম ও ভালবাসা ছড়িয়ে দেয়া সেটা হোক কবিতা ও গানে, ছন্দে ও সুরে

আমাদের সৃষ্টি তাই ভালবাসার সৌরভে আমোদিত সুন্দরের জয়গানে মুখরিত প্রভাতরশ্মির মতই আলোকদীপ্ত 

আমাদের এ মিছিলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন কবি মতিউর রহমান মল্লিক এগিয়ে যাক এ আলোর কাফেলা অনাগত সৈনিকরাও প্রেমের সৌরভে মাতিয়ে রাখুক এ বিম্বসভা

১লা সেপ্টেম্বর ২০২০ : ৫টা

যেতে হবে আরো বহু দূরঃ ১৪

কিভাবে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন হয় এটা বুঝানো খুব কঠিন মানুষ তার আচরণ প্রকাশ করে দেহের মাধ্যমে বা দেহের কোন অঙ্গের মাধ্যমে কিন্তু আচরণটা হয় মনের নির্দেশে এই পুরো প্রক্রিয়াটিই সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের ফসল মানুষের মননের ভূমিকা ছাড়া কিছুই হয় না আর মনন গড়ে তোলে সংস্কৃতি অবশেষে মননের নির্দেশটিই পালিত হয় বিভিন্নভাবে

যেমন পর্দা ইসলামে ফরজ এই ফরজ পালনে বাঁধা দান আগ্রাসনের কাজ খৃস্টান নানরা যে পোষাক পড়ে তা নিয়ে কোন আপত্তি হয় না কিন্তু মুসলমান মেয়েরা হিজাব পড়লেই যত আপত্তি মানুষ উলঙ্গ হয়ে সূ   র্যস্নান,  না বলে কৌশলে প্রতিদিন কী পরিমান মানুষকে পাপসাগরে ভাসিয়ে দেন, ভাবতে পারেন? সাংস্কৃতিক আগ্রাসন এভাবেই সারাক্ষণ আমাদের ঈমান ও আমলকে ধ্বংসের দিকে টেনে নিচ্ছে যদি সাংস্কৃতিক কর্মীরা সময়মত বাঁধের এ ফাটলগুলো ভরতে না পারে তবে জাতি পাপের বন্যায় ভেসে যাবে যদি সময়মত বালির বস্তা ও পাথর সরবরাহ করতে জাতি ব্যর্থ হয় তবে এ জন্য কেবল সাংস্কৃতিক কর্মীদের দায়ী করা ঠিক হবে না এ ব্যর্থতা পুরো জাতির

এ দেশে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন যেমন চলছে তেমনি পরিকল্পিতভাবে তা প্রতিরোধ করার কাজও চলছে সাংস্কৃতিক কর্মীদের দু একটা সাফল্য তুলে না ধরলে তাদের প্রতি অবিচার করা হবে

আজ থেকে পনেরো বিশ বছর আগের কথা পহেলা এপ্রিল সারাদেশে খুবই উৎসাহ উদ্দীপনার সাথে এপ্রিলফুল পালন করা হতো আমরাও করতাম কে কাকে ঠকিয়ে বোকা বানাতে পারে তার মহড়া চলতো স্যার ক্লাশে এসেছেন বই চাইলেন আপনি অংক স্যারকে ইংরেজি বই এগিয়ে দিলেন তিনি রাগ করতে পারবেন না, বোকার মত হেসে দেবেন এভাবে একজন আরেকজনকে বোকা বানানোর খেলা চলতো সারাদিন ছেলে বুড়ো সবাই খেলতো

এই উৎসবটা পালন করে খৃস্টানরা এদিন স্পেনে এক মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে মুসলমান ও খৃস্টানদের মধ্যে তুমুল লড়াই চলছে ফার্ডিনেন্ড ও রানী ইসাবেলা খৃস্টানদের নেতা তারা ঘোষণা করলো, মুসলমানরা যদি হাতিয়ার ফেলে মসজিদে আশ্রয় নেয় তবে তাদের কিছু বলা হবে না মুসলিমরা তাই করলো খৃস্টানরা এবার মসজিদে তালা লাগিয়ে বাইরে থেকে আগুন দিয়ে মেরে ফেললো মুসলমানদের বললো, দেখলে মুসলিমরা কেমন বোকা শত্রুর ওয়াদা কেউ বিশ্বাস করে! সেই আনন্দে শত শত বছর ধরে তারা এপ্রিলফুল, মানে এপ্রিলের বোকা উৎসব পালন করে সারাদিন চলে মিথ্যা কথা বলার উৎসব প্রতারণার এ উৎসব একসময় ছড়িয়ে পড়ে মুসলিম সমাজেও আজ কিন্তু সে উৎসব নেই কোথায় গেল সে উৎসব? কেমন করে উধাও হলো? সুস্থ সংস্কৃতি দিয়ে তাকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে, তাই, আজ কেউ তা পালন করে না

আরেকটি ঘটনা বাংলার ঘরে ঘরে ছিল নায়িকাদের ছবি এসব ছবি দিয়ে বানানো হতো ক্যালেন্ডার যাদের ঘরে সেই ক্যালেন্ডার থাকতো না, তাদের বলা হতো গেঁয়ো, বর্বর, অশিক্ষিত সংস্কৃতি মানুষের রুচিকে উন্নত করে দিল মানুষ এখন ঘরে রাখে মসজিদের ছবি, প্রাকৃতিক দৃশ্য, ক্যালিগ্রাফি ইত্যাদি এখন আর কোন ভদ্রলোক ঘরে নায়িকাদের ছবি টানায় না এই যে রুচির উন্নয়ন এটাই সুস্থ ধারার সংস্কৃতির ফসল

আগ্রাসনের ফলে মানুষের বোধ ও বিশ্বাসে আঘাত লাগে চেতনা ক্ষতিগ্রস্ত হয় আজ যেটাকে আপনার মনে হয় অন্যায়, দিনে দিনে তা আর অন্যায় থাকে না, হয়ে যায় সহনীয় পাপকে পাপ মনে হয় না, মনে হয় এটাই স্বাভাবিক এই যে তিলে তিলে হৃদয়ের আলো কমে যায়, সেই বৃক্ষে পানি দেয় সংস্কৃতি ফিরিয়ে দেয় উদ্যম, ফিরিয়ে দেয় সাহস সতেজ করে মন শানিত করে চেতনা মানুষকে বলে, যাও, সেবা করো মানুষের তোমার পরশে আবার লোহা সোনা হোক যে মানুষ পরের সম্পদ লুটে তৃপ্তি পেতো, তাকে বলো মুহাজির ভাইকে দান করে দিতে নিজের অতিরিক্ত স্ত্রী সংস্কৃতির পরশে খুনী হয় প্রেমিক আইয়ামে জাহেলিয়াতের অমানুষগুলোও মানুষ হয়ে যায়

স্বাধীনতা উত্তর সমাজ জীবনে নেমে এসেছিল ধ্বস মানুষের জীবন থেকে খুলে পড়েছিল মানবতার পোশাক হারিয়ে গিয়েছিল সততা ও মূল্যবোধ সেই সমাজে প্রেম ও পূণ্যের বাঁশি বাজালেন যে রাজপুত্র তার নাম মতিউর রহমান মল্লিক তার গান, কবিতা, ছড়া সকল সৃষ্টিতে মানুষকে জাগানোর যে বানী তা তুলনাহীন

তার এমন কোন গান নেই যে গানে ফুলের সৌরভ নেই এমন কোন কবিতা নেই যে কবিতায় সাহসের মন্ত্র উচ্চারিত হয়নি এমন কোন ছড়া নেই যাতে নেই নৈতিকতার আলোকরশ্মি তিনি বলেছেন, সাহসের সাথে কিছু স্বপ্ন জড়াও, তারপর পথ চলো নির্ভীক সাহসের সাথে স্বপ্ন জড়ানোর যে আহবান তিনি দিয়েছেন তা শুনে জেগে উঠলো বাংলার তরুন কিশোর

তিনি সংস্কৃতির দুটো অঙ্গনেই সমানতালে প্রেমের পুষ্প ফুটিয়ে ছিলেন

এক. সাহিত্য দুই. সংস্কৃতি

তার সাহিত্য মেলে দেখুন, প্রতিটি লেখায় আছে জীবনের গান আছে প্রেরণার বাণী তার লেখা পড়লে আপনার মনে জাগবে স্রষ্টাপ্রেম, জাগবে মানুষের প্রতি মমত্ববোধ, সৃষ্টির প্রতি ভালবাসা ঘৃণা, ক্রোধ, লোভ

হিংসা, মিথ্যা এসবের প্রতি আপনার মনে জন্ম নেবে বিতৃষ্ণা এভাবেই পরিশুদ্ধ হবে আপনার ফুল্ল হৃদয়

একই কথা গানের ব্যাপারেও তার প্রতিটি গান হৃদয়ের গভীরে আঘাত হানে তিনি যখন বলেন, আম্মা বলেন ঘর ছেড়ে তুই যাসনে ছেলে আর-- তখন অনেকেই চোখের অশ্রু ধরে রাখতে পারেন না

এ বছর কবি মল্লিকের মৃত্যুর দশ বছর পূর্ণ হলো এ উপলক্ষে তার ভক্তরা বিশ্বব্যাপী কবি মল্লিক স্মরণ ২০২০ আয়োজন করে এতে কবি মল্লিকের প্রচুর গানের সাথে পরিচিত হয় বিশ্ববাসী কিন্তু একটি গান শুনে কাউকে মূল্যায়ন করা যায় না কবির রচনাবলীর প্রথম খন্ড এরই মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে বাকী খন্ডগুলো অচিরেই বেরোবে বলে আশা করা যায়

কবি মল্লিক নেই, আছে তার সৃষ্টি, আছে তার আদর্শ মানুষের জীবনকে সুশোভিত করতে হলে সে আদর্শকে সমাজে বিকশিত করার কোন বিকল্প নেই এ দায়িত্ব এখন আমাদের আমরা যারা তার আদর্শকে ভালবাসি তাদের আশার বিষয়, বাদ্যবিহীন গানের যে সংস্কৃতি তিনি প্রমোট করেছেন

সে বৃক্ষ শুধু বড় হয়নি, সে বৃক্ষের চারা ছড়িয়ে পড়ছে দেশ থেকে দেশান্তরে তবে অশ্লিলতামুক্ত শুদ্ধস্বর সাহিত্যের যে আন্দোলন তিনি শুরু করেছিলেন আশির দশকে, তার বহু মালামাল গোডাউনে পড়ে আছে তার সহযোদ্ধারা বিরতিহীনভাবে শুদ্ধ সাহিত্য আজো সৃষ্টি করে চলেছেন কবি মল্লিককে আশির দশকের শুদ্ধস্বর সাহিত্য গোষ্ঠীর সেনাপতি বলা হয় কিন্তু এই সেনাপতি ও তার সৈনিকদের সৃষ্টি সম্ভার পরিকল্পিত ভাবে প্রকাশিত না হলে কবি মতিউর রহমান মল্লিকের পূর্ণাঙ্গ পরিচিতি ও মূল্যায়ন সম্ভব নয় আশির কাব্য জোস্নার কবিদের শ্রেষ্ঠ রচনাবলী প্রকাশিত হলে আমরা জানতে পারবো এই সেনাপতির বিজয়ের সীমানা কতদূর বিস্তৃত হয়েছে মল্লিকীয় সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন বাংলাদেশের সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে কোনো প্রভাব ফেলেছে কিনা, ফেললে কতটুকু? মল্লিকসহ আশির শব্দসৈনিকদের শ্রেষ্ঠ রচনাবলী প্রকাশ না হওয়া পর্যন্ত তা নিরূপণ করা সম্ভব নয়

প্রায় পঞ্চাশ বছর সাধনা তথা সার, পানি দিয়ে যে বৃক্ষ তিনি বড় করে তুলেছেন, সেই বৃক্ষের ফল দেয়ার সময় হয়েছে দেখা যাক, বৃক্ষের মালিক কতটা সুচারুভাবে ফসল ঘরে তুলতে পারেন

মল্লিকের সৃষ্টি, তার বন্ধুদের মানিক রতন, আশির দশকে শুদ্ধস্বর কবিগোষ্ঠির বিজয় কেতন এবং জ্যোতি জোসনার কবিদের সৃষ্টি সম্ভার আজ জাতির নিত্য পাঠ্য হওয়া উচিত এ জন্য প্রয়োজন, আশির সেই হীরকখন্ডগুলো প্রকাশ করা

ইসলামী সংস্কৃতি কি, এই নিয়ে এক সময় আমাদের বই ছিল কিন্তু আজ তা বাজার থেকে আউট হয়ে গেছে ফলে, আমরা যে দৃঢ়তা নিয়ে সাহিত্য চর্চা করেছি, সেই শক্তি এখনকার অনেকেরই নেই এই প্রত্যয় দৃঢ় করার জন্য দরকার কোরআন ও হাদিসের আলোকে সাহিত্য চর্চা করা যে দৃষ্টান্তমূলক সাহিত্য আশির কবিগোষ্ঠী, কথাশিল্পী ও প্রবন্ধকারগণ উপহার দিয়ে জাতির মেধা মনন ও স্বপ্নে বিপ্লব সৃষ্টি করেছিল, সে সাহিত্য আলোয় না এনে নতুন করে একই কাজে নামা সময় ও যোগ্যতার অপচয়মাত্র আমরা সাহিত্যের বাগান গড়বো কিন্তু তা হতে হবে সুচিস্নিগ্ধ এ জন্য সাহিত্য সংস্কৃতির ব্যাপারে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি কি সেটা আগে উপলব্ধি করতে হবে কবি মতিউর রহমান মল্লিক ও আশির দশক এ ব্যাপারে কোরআন ও হাদিসের নির্দেশনা জাতির কাছে তুলে ধরে সাহিত্য সংস্কৃতির যে প্রয়োজনীয়তা ব্যক্ত করেছেন, তা জাগিয়ে রাখাই হোক আমাদের প্রত্যয় শুদ্ধ সাহিত্য সংস্কৃতি ছাড়া শুদ্ধ জাতি নির্মাণ সম্ভব নয় মানবতার কল্যাণের জন্য কোরানিক সংস্কৃতি গড়ে তোলার কোন বিকল্প নেই সাংস্কৃতিক আগ্রাসন রোধ করে শুদ্ধ সংস্কৃতি গড়ে তোলার যে ব্যাপকতা সেটা বুঝার তওফিক আল্লাহ আমাদের দান করুন

৯ই সেপ্টেম্বর ২০২০ : ৭টা

যেতে হবে আরো বহু দূরঃ ১৫

মরার জন্য কোন মওকা লাগে না মানুষ যে কোন সময় যেকোন কারণে বা বিনা কারণে মরে যেতে পারে মৃত্যুর চাইতে স্বাভাবিক কোন ঘটনা পৃথিবীতে নেই

পৃথিবীর কোনকিছুই নিশ্চিত করে বলার উপায় নেই যে কোন সময় পরিস্থিতি বদলে যেতে পারে মরতে মরতে কেউ বেঁচে যেতে পারে, আবার স্বপ্নের মত চোখের সামনে কেউ মরে যেতে পারে

রাস্তায় আমরা তখন অনেক মানুষ মুক্তিযুদ্ধের সমাপ্তি ঘটেছে চলছে বিজয় উল্লাস আমার সামনে দশবারো হাত দূরে এক যুবক কাঁধে রাইফেল মাথায় লম্বা লম্বা ঝাকড়া চুল বিজয়ী বীর হঠাৎ বিকট আওয়াজে কেঁপে উঠলো মাটি দেখলাম, লোকটি ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল তার সেই বিপর্যস্ত দেহটা আমাদের চোখের সামনে দশপনেরো হাত উপরে উঠে গেল আমরা হতবিহ্বল টুকরোগুলো একসময় মাটিতে পড়লো জানা গেল, তার পকেটে গ্রেনেড ছিল বন্ধুদের সাথে সেও নেমে এসেছে বিজয় মিছিলে উত্তেজনায় কখন হাত গিয়ে  পকেটের গ্রেনেডের পিন খুলে ফেলেছে সে হয়তো টেরই পায়নি এরকম আকস্মিক মৃত্যুর ঘটনার নানা রকম স্মৃতি নানাজনের আছে

আমি নিশ্চিত করেই আপনাদের বলতে পারি, আমি মারা যাবো আমার মৃত্যুর দিন ক্ষণ নির্ধারিত হয়ে গেছে আমি আরো নিশ্চয়তা দিতে পারি, আপনিও মারা যাবেন তবে কখন আপনি মারা যাবেন সেটা আমার জানা নেই আমি জানি, আপনারও জানা নেই কারোরই জানা নেই কিন্তু আমাদের মরণ যে কেউ ঠেকাতে পারবে না সে ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত

মানুষের জীবনে কিছু কিছু সময় আসে যখন মরণের কথা খুব মনে হয় কিন্তু কিছুই করার নেই আপনার একাত্তুর সালে আমি স্কুল পড়ুয়া এক ছেলে থাকি ঢাকা শহর সে বছর সারা দেশে কত যে লোক মারা গেছে তার কোন ইয়ত্তা নাই কিন্তু আমি মরি নাই এতে আমার কোন কৃতিত্ব নাই

তারপর এলো চুয়াত্তুর রাস্তার পাশে কত যে লোককে মরে পড়ে থাকতে দেখেছি বলার মত না কিন্তু আমি মরি নাই আমি যে বেঁচে গেছি সে জন্য যে শোকর আদায় করতে হবে মৃত্যুর ঘোরে সে কথাটাও স্মরণ করতে পারি নাই

বড় হলাম কত জ্ঞানীগুণী মানুষের সাথে পরিচয় হলো কাউকে বাঁচাতে পারলাম না সবাই মরে গেল আমরা তাদের জানাযা পড়লাম হয়তো ভাগ্যে থাকলে কেউ না কেউ আমাদেরও জানাযা পড়বে এইতো ইতিহাস

একদিন এনজিওগ্রাম করে দেখা গেল আমার ব্লক খুব বেশী রিং পরালে কোন লাভ হবে না ওপেনহার্ট করতে হবে পরিবারের লোকজন নিয়ে গেল হাসপাতালে ওপেনহার্ট করার জন্য নিয়ে গেল অপারেশর থিয়েটারে চারদিকে ডাক্তার ও নার্স ফকফকা বাতি জ্বলছে মাথার ওপর ডাক্তার বলল, কেমন লাগছে, ভয় পাচ্ছেন? আমি হাসলাম বললাম, বেশ রোমাঞ্চকর মনে হচ্ছে বেঁচে গেলে নতুন একটা অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হতে পারবো

আর যদি মরে যান?

কি যে বলেন মৃত্যুর মালিক কি আপনি? মৃত্যু যার হাতে তিনি ছাড়া তো কেউ মৃত্যু দিতে পারে না কেউ কাউকে বাঁচাতেও পারে না অতএব, ভয় কি? যাবার সময় হলে চলে যাবো থাকবে কে বলুন? আর যদি বেঁচে যাই অভিজ্ঞতার ঝুড়িতে নতুন অভিজ্ঞতা যুক্ত হবে

শুনেছি, আটঘন্টা পর আমাকে ওখান থেকে বের করা হয় বাইরে তখন সবাই দোয়া দরুদ পড়ছিল মুশকিল হলো, সে আট ঘন্টার কোন স্মৃতিই আমার মনে নাই

না সেদিনও মরি নাই কিন্তু তাতে কি? একদিন আমাকে মরতেই হবে

একদিন ফজরের নামাজ পড়ে খুব ঘামছিলাম বেগমকে বললাম একটু পানি দিতে তিনি পানি দিলেন এরপর তার কি মনে হলো, তিনি বোরকা পরে রেডি হয়ে পেন্টটা আমার দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বললেন, পরো বললাম, কেন?

চলো, একটু ডাক্তারের কাছ থেকে ঘুরে আসি গেট থেকে বেরিয়েই পরিচিত রিকসা পেলাম আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো মগবাজার কমুনিটি হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে বেডে নেয়ার পর পরই নাকি স্ট্রোক করি আমার তেমন কিছু মনে নেই শুধু এতটুকু মনে আছে, আমি বেডে বসেছিলাম তারপর কি হলো, দুজন নার্স আমাকে ধরে শুইয়ে দিল আমার শরীর অবশ হয়ে গেল মনে হলো চেতনাও অবশ হয়ে গেল আমি কিছুই করতে পারছি না ডাক্তার জানালো আমার স্ট্রোকের কথা বলল, তাড়াতাড়ি এম্বুলেন্স ডেকে ওনাকে শেরবাংলা নিয়ে যান কয়েক মিনিটের মধ্যে চলে এলো নোমান এলো এম্বুলেন্স আমাকে নিয়ে যখন যাত্রা করলো, মনে হলো আমি আকাশ পথে ভেসে যাচ্ছি

এ যাত্রাও বেঁচে গেলাম কেন বাঁচলাম? এখন এ প্রশ্নটাই আমার কাছে বড় হয়ে দেখা দিচ্ছে

আল্লাহ যেমন বিনা কারণে কিছু সৃষ্টি করেন না, তেমনি প্রয়োজন না থাকলে কাউকে বাঁচিয়েও রাখেন না তাহলে আমি বেঁচে আছি কেন? তখনি মনে হলো, আমার সম্পর্কে কিছু কথা লিখে যাওয়া দরকার, যা না বললে ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি হতে পারে

এ আমার বিনয়ও নয়, অহংকারও নয়, নিরেট কিছু সত্য উচ্চারণ যা আপনাদের বলবো বলে আমি স্থির করে ফেলেছি

২০শে অক্টোবর ২০২০

যেতে হবে আরো বহু দূরঃ ১৬

আমাকে নিয়ে কিছু ভুল তথ্য এরই মধ্যে জনারন্যে দেখলাম আমার পরিচিতিতে কেউ কেউ আমাকে প্রখ্যাত অনুবাদক বলেও উল্লেখ করেছেন কিন্তু বাস্তবে আমি কোন অনুবাদক নই একমাত্র বাংলা ভাষা ছাড়া পৃথিবীর আর কোন ভাষাই আমি তেমনভাবে জানি না, যেমনটা জানলে অনুবাদের সাহস করা যায়

নসীম হিজাযীর সম্ভবত দশটা বইয়ের অনুবাদের আমি সম্পাদনা করেছি কথাটা এ জন্য বললাম যে, নসীম হিজাযীর কোন বই-ই আমি পড়িনি মানে, মূল বই পড়িনি মূল বই তিনি উর্দুতে লিখেছিলেন আমি উর্দু জানি না আমার এ অক্ষমতা ও অজ্ঞতা আমি অকপটে স্বীকার করছি

পৃথিবীর সব কিছুই যে আমার জানতে হবে এমন কোন কথা নেই না জানাটা অপরাধ নয়, অপরাধ হচ্ছে না জেনেও জানার ভান করা

আলহামদুলিল্লাহ আল্লাহ আমাকে যা দিয়েছেন তাতেই আমি সন্তুষ্ট এর কৃতজ্ঞতা প্রকাশেরই ভাষা আমার জানা নেই তাঁর দেয়া মেধা, যোগ্যতা, প্রজ্ঞা, হায়াত এসব পেয়ে আমি তৃপ্ত আমার কি শক্তি আছে, এসবের শোকর জানাই আমি শুধু কায়মনে তাঁর দয়া ও রহমত চাই

আমি নসীম হিজাযীর সাথে পরিচিত হই বাংলাদেশ কো অপারেটিভ বুক সোসাইটি প্রকাশিত সৈয়দ আবদুল মান্নান অনুদিত বইগুলো পড়ে ছাত্রবয়সে খুনরাঙা পথ বা মরণজয়ী পড়ে আমি এতটাই আপ্লুত হই যে, আমি তার একতরফা প্রেমে পড়ে যাই যত পড়ি ততই পিপাসা বাড়ে কিন্তু কোঅপারেটিভ বুক সোসাইটি উপযুক্ত অনুবাদকের অভাবে বেশী দূর অগ্রসর হতে পারেনি কোঅপারেটিভ প্রকাশিত জনৈক আবদুল হক অনূদিত মোহাম্মদ বিন কাসিম বইটি পড়লেই বিষয়টা সকলে বুঝতে পারবেন বইটি পড়ে আমি আহত হই আবেগের বশে অনেককে অনুরোধ করি নসীম হিজাযীর বই অনুবাদ করার এক সময় বুঝতে পারি, পৃথিবীর কোন কাজই প্রেম ছাড়া হয় না যোগ্যতা অভিজ্ঞতা খুবই মূল্যবান জিনিস, কিন্তু কোন কাজ উত্তমভাবে সম্পন্ন করতে হলে আসল সম্পদ হলো প্রেম আমি কারো মাঝেই আমার এ প্রেমের বীজ বুনতে পারলাম না

ছাত্রজীবনে কোনদিন নসীম হিজাযীর বই নিয়ে পাগলোর মত মেতে  উঠবো ভাবিনি ছাত্র জীবনে কল্পনায় কত রাজা উজির মেরেছি সে সব কথা মনে হলে আজো  হাসি পায় কিন্তু কখনোই ভাবিনি বাংলাভাষী পাঠকদের হাতে আমার তত্বাবধানে অনুবাদ করানো এবং সম্পাদনা করে এতগুলো বই তুলে দিতে পারবো আর এটাও বুঝিনি, পাঠকরাও ভালবাসার অঞ্জলি দিয়ে এতটা আপন করে নেবে হে প্রভু, এর সব পরিকল্পনা তোমার তোমার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে যদি কোন ভুল করে থাকি নিজগুণে ক্ষমা করে দিও

কেমন করে এ অসাধ্য সাধিত হলো? বলছি সে কাহিনী বিয়ের পর একমাত্র জামাই আদর আপ্যায়ন একটু বেশীই পাই জায়গাটা মীরপুর চৌদ্দ নম্বর কলোনী যে মসজিদে পাঞ্জেগানা নামাজ পড়ি তার ইমাম  একজন অল্পবয়সী হুজুর প্রথম দিনই তিনি নামাজের পর আমার সাথে দেখা করে বললেন, আসাদ ভাই, আমি আপনার ও মল্লিক ভাইয়ের ভক্ত সাইমুমের গান আমার খুর ভাল লাগে

আস্তে আস্তে ওনার সাথে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে নামাজের সময় ছাড়া বাকি সময় হুজরাখানায় কাটান মুসল্লিরা আসেন আড্ডা হয় এলাকার পোলাপানও আসে

আমার শ্বশুর যে বিল্ডং এ থাকেন তাতে ফ্লাট  মোট বত্রিশটা আমিই তাদের প্রথম জামাই শালাশালীর অভাব নাই শ্বাশুরিরা ব্যস্ত জামাই আপ্যায়নে শালীরাও এত ছোট যে, পর্দা করার বয়স হয় নাই কারো

শ্বশুর থাকেন তিন তলায় দোতলায় একটা ফ্লাট খালি হলো উনি বললেন, চলো, এটা আমরা ভাড়া নিয়ে নেই আমি তখন বাসা খুঁজছিলাম অল্প পয়সায় পেয়ে গেলাম, তাই নিয়েও নিলাম

ইমাম সাহেবের নাম আবদুল হক দুদিনেই তিনি হয়ে গেলেন হক ভাই, আমিও আসাদ ভাই আমাকে বলতে পারেন, কর্মপাগল অলস মানুষ মানে, যদি কোন কাজের সাথে আমার প্রেম হয়ে যায়, তার সাথে দিনরাত থাকতেও আমার আপত্তি নেই নইলে দেখবেন আমি শুয়ে শুয়ে লেজ নাড়ি

এমনি একদিন শুয়ে শুয়ে লেজ নাড়ছি, আর ভাবছি, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ানো ছাড়া তো ইমামদের কোন কাজ নাই, সারা দিন আড্ডা আর আড্ডা এদের সময়কে কিভাবে কাজে লাগানো যায়? তখনি চিন্তাটা  মাথায় এলো আমার কালেকশনে তখন নসীম হিজাযীর বেশকিছু উর্দু বই ছিল জামাতে যাওয়ার সময় একটা বই হাতে নিলাম নামাজ শেষে হুজরাখানায় ঢুকলাম তিনি হাতে বই দেখে বললেন, এটা কি বই আসাদ ভাই আমি তো এটাই চাচ্ছিলাম বইটা এগিয়ে দিলাম তিনি পড়লেন, শাহীন, নসীম হিজাযী

এরপর বইয়ের পাতা উল্টাইতেই কি যে হলো, গপ্পোবাজ হুজুর একদম চুপ চোখ ঘুরছে লাইনে লাইনে এতক্ষণ যাদের সাথে আড্ডা হচ্ছিল, তারা বললো, কি হলো হুজুর? হুজুর চুপ আরো কয়েকজন হুজুরকে জাগাতে গিয়ে রণে ভঙ্গ দিয়ে কেটে পড়লো হুজুর বললেন, আসাদ ভাই, এ তো দারুণ বই

আমি বললাম, কেমন?

তিনি বইয়ের ভেতরের কাহিনীর কিছুটা অংশ আমাদের বুঝিয়ে বললেন তিনি থামলে আমরা বললাম, তারপর?

তিনি বললেন, এখনো তো পড়িনি

আমার সাথে যারা বসেছিল তারা অধিকাংশই কিশোর বললো, তাহলে বসে আছেন কেনো, পড়ুন

তিনি আরো দুটো পৃষ্ঠা পড়ে আমাদের অনুবাদ করে শোনালেন দেখলাম সাহিত্যের রস তিনি ভালই ধরতে পেরেছেন মাগরিব পড়ে আমরা যার যার ঘরে চলে এলাম রাতে তিনি বেশ অনেকদূর পড়ে ফেললেন পরদিন আমার আদরের শ্যালক বাহিনী আবার গিয়ে হুজুরকে পাকড়াও করলো নাছোড়বান্দা তারা হুজুর বাধ্য হলেন তাদের সে কাহিনী একটু একটু করে শোনাতে আমি কোন কোন দিন শুনি আর  তামাশা দেখি ঐ পিচ্ছি বাহিনীর এভাবেই তিনি একবার পুরো বইটা মৌখিক অনুবাদ করলেন

আমি বললাম, হক ভাই, আমি আপনার অনুবাদ মাঝে মাঝে শুনলেও পুরো কাহিনী সাজিয়ে বুকে গাঁথতে পারিনি আপ১নি যদি বইটা অনুবাদ করেন তবে বাংলা সাহিত্য একটা চমৎকার উপন্যাসে সমৃদ্ধ হবে তিনি বললেন, কিন্তু আমি তো বাংলা সেভাবে জানি না

আমি বললাম, বাংলা আপনার মাতৃভাষা মায়ের দুধ খাওয়ার জন্য যেমন ওস্তাদ ধরা লাগেনি তেমনি ভাষা শিখতেও ওস্তাদ লাগবে না আপনার বাংলা যথেষ্ট সুন্দর আর দরকার হলে আমি তো আছি

সাহসে ভর দিয়ে শুরু করলেন তিনি বিচ্ছু বাহিনীকে লাগিয়ে দিলাম তাগাদা দেয়ার কাজে এখন আর তিনি আড্ডার সময় পান না দরজা লাগিয়ে সারাদিন সারারাত লেখেন এদিকে পিচ্ছি বাহিনীর সময় কাটে না বলল, আপনি শুয়ে শুয়ে বলেন, আমরা লেখি তাতে আমাদের লেখার গতি বাড়বে লেখা আরো সুন্দর হবে সেভাবেই চলল রাতে তিনি নিজে লেখেন,  দিনে লেখেন দলবল নিয়ে

একদিন তৈরী হয়ে গেল আজকের সীমান্ত ঈগল বইয়ের পান্ডুলিপি ওটা জমা পড়লো আমার হাতে

সব ভাষারই একটা আলাদা বিহেব আছে, আচরণ আছে ইংরেজীর ইউ কোথায় তুমি হবে আর কোথায় আপনি হবে সেটা অনুবাদককে কেউ বলে দেবে না এখানেই অনুবাদকের সৃজনশীলতা প্রয়োগ করতে হবে আপনি কালেমার অনুবাদ বাংলায় সজহেই বলতে পারেন, আল্লাহ ছাড়া মাবুদ নাই কিন্তু পিওর অনুবাদ করলে আপনাকে বলতে হবে, নাই কোন মাবুদ, আল্লাহ ব্যতীত অনুবাদ করতে হলে ভাষার এ চলনকে বুঝতে হবে

দুুটো ভাষা ভালভাবে রপ্ত না থাকলে শুধু শব্দার্থ দিয়ে অনুবাদ হয় না গরুটি পথে মারা যাওয়ায় লোকটি মাঠে মারা গেল এখানে প্রশ্ন হচ্ছে, গরুটি পথে মারা যাওয়ার পর লোকটি মাঠে কেন মরতে গেল? ভাষার এসব প্যাঁচ না বুঝলে অনুবাদ হয় প্রাণহীন, মরা লাশ মাত্র

একবার আমার অনুবাদকের সাথে আমার মতের অমিল হয় ওয়ান ইউনিট বুঝাতে এক বললেই হয় প্রতি বললেও এক বুঝায়তিনি লিখলেন, একদিন ছেলেটি বাড়ি আসিল আমি বললাম, এখানে একদিন হবে না, হবে প্রতিদিন তিনি জোর দিয়ে বললেন, না, একদিনই হবে প্রতি মানেও তো এক, সিঙ্গেল ভাষায় শব্দ বসে বাক্যের ব্যাবহার গুণে বাক্যে এলে অনেক সময়ই শব্দের অর্থ পাল্টে যায় ভাল করে পড়ে দেখেন, এখানেও তাই হয়েছে

আমি যেহেতু উর্দু জানি না, ফলে এরচে বেশী কিছু বলা সঙ্গত মনে করলাম না তিনি উর্দু অভিধান ঘেটে বার বার কাহিনী পড়ে বললেন, আসাদ ভাই, আপনিই ঠিক এখানে শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে এভরিডে অর্থে কিন্তু আপনি বুঝলেন কেমনে? আমি বললাম, এটা কোন ব্যাপার না কিছুদিন লেগে থাকেন, আপনিও বুঝে যাবেন

আমি ওনার অনুবাদটি পড়লাম বিভিন্ন স্থানে মার্ক করে রিরাইট করতে বললাম অমা, উনি কোন রকম গাইগুঁই না করে সুবোধ বালকের মত অতগুলো পৃষ্ঠা পুনরায় লিখলেন আমি ওনার ধৈর্য দেখে বিমোহিত বুঝলাম এর মাঝে প্রেম আছে উনাকে দিয়েই হবে এরপর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি উনি বুঝে গেছেন অনুবাদের বেসিক যেটুকু হাত লাগানোর দরকার তা দিয়ে একে একে অনেকগুলো বই বের করে আনলাম এই গুণী অনুবাদকের হাত দিয়ে আল্লাহ তাকে এর উসিলায় বেহেশত নসীব করুন

আবারো বলছি, আমি অনুবাদক নই, তবে এতে একটা সুবিধা হয়েছে, অনুবাদের বইতে ভাষায় একটু আড়ষ্ঠতা থাকে মূলের কাছাকাছি থাকার একটা চেষ্টা থাকে সে চেষ্টা করার সুযোগ ছিল না বলে আমি কাহিনীর মধ্যে একটা গতি আনার চেষ্টা করেছি, ভাষার মধ্যে একটা দ্যুতি আনার চেষ্টা করেছি কতটুকু সফল হয়েছি জানি না, তবে পড়ে আমার ভাল লেগেছে ধন্যবাদ আপনাদের সবাইকে ভাল থাকুন

২৩শে অক্টোবর ২০২০

যেতে হবে আরো বহু দূরঃ ১৭

আলহামদুলিল্লাহ আপনাদের দোয়া এবং ভালোবাসা আমার জীবনের পরম প্রাপ্তি আপনাদের এতো ভালবাসা কেন যে পেলাম সেটাই আজ শুয়ে শুয়ে ভাবছি আমি না জানি গান, না জানি অভিনয়, না জানি আবৃত্তি করতে, না জানি সুর করতে, তবু এককালে আমার চারপাশেই ছিল তারার মেলা জমিদার বাড়িতে প্রতিদিনই ভাল ভাল রান্না হয় সে খাবার জমিদার ও মেহমানরা তো খায়ই, কাজের লোকেরাও খায়

আমার সৌভাগ্য হয়েছিল আমি এক মহা তারকার সেক্রেটারী হিসাবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেছি আমার যোগ্যতা না থাকলেও তার যোগ্যতার কোন অভাব ছিল না তিনি গান লিখতে পারতেন, সুর করতে পারতেন, গাইতে পারতেন, কবিতা লিখতে পারতেন, আবৃত্তি করতে পারতেন, কী পারতেন না তিনি?

বলুন তো তার নামটি কি? হ্যাঁ, মতিউর রহমান মল্লিক কবি মতিউর  রহমান মল্লিক সবাই ভাবে তার স্নেহ সেই বেশী পেয়েছে, যেমনটি আমি ভাবি কারণ, আমি তার শুধু স্নেহই পাইনি, বন্ধুত্বও পেয়েছিলাম

আমাকে তিনি কতটা ভালবাসতেন চিন্তা করুন, কোন গায়ক না হওয়ার পরও তিনি আমাকে সাইমুম শিল্পীগোষ্ঠীর দায়িত্বশীল বানিয়েছিলেন সাইমুমের দায়িত্বশীলকে এখনো পরিচালকই বলা হয় তিনি সেই ব্যক্তি, যিনি আমার সময় পরিচালককে অফিসিয়ালি সভাপতি করে সাইমুমের ইতিহাসে ব্যতিক্রম সৃষ্টি করেছিলেন কী অদ্ভুত কথা সাইমুমের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ও পরে সভাপতি মল্লিক ভাই ছাড়া সাইমুমের একমাত্র সভাপতির নাম আসাদ বিন হাফিজ তাও সেই  সময়, যখন সারাদেশে সাইমুমই একমাত্র সাংস্কৃতিক সংগঠন ছিল কথাটা ইতিহাসের অংশ বলেই বললাম, নইলে আমি এমন কেউ নই, যার বিষয় এত গুরুত্ব দিয়ে উল্লেখ করতে হবে

আসলে কিছু কিছু মানুষ থাকে না ভাগ্যবান, যোগ্যতা নয় ভাগ্যগুণে যারা ইতিহাসের অংশ হয়, আমার ভাগ্যটাই ছিল ওরকম যার জীবনটা কেটেছে তারকা মেলায়,  তারকাদের সান্বিধ্যে

আমি যখন সাইমুমের সভাপতি সে সময়ের শিল্পীদের নাম শুনলেই আপনারা বুঝতে পারবেন আমি ছিলাম তারকা পরিবেষ্টিত

আমাদের তখন শিল্পীদের দুইটা গ্রুপ ছিল একটা বড়দের একটা ছোটদের বড়দের গ্রুপটায় কারা কারা ছিল সবার নাম এখন মনে নেই এক ভাই ছিলেন আবদুল হালিম, যিনি থাকতেন নারায়ণগঞ্জ, ছাত্রজীবন শেষ করে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ডাইরেক্টর হয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র লোকমান হোসেন, শিল্পী তোফাজ্জল হোসেন খান, পুরাণ ঢাকার হাসান আকতার, কমলাপুরের জাহিদ হোসেন এবং আরো কয়েকজন অবশ্য সবাই ছাত্রজীবন শেষ করে বিদায়ের তালিকায় ছিলেন ফলে এই গ্রুপটার সাথে বেশীদিন কাজ করার আমার সুযোগ  হয়নি শিল্পী হাসান আখতার ও তোফাজ্জল হোসেন খান ছাড়া সবাই সাইমুম ছেড়ে চলে যায়

আমাকে প্রধানত নির্ভর করতে হয় ছোটদের ওপর এদেরই এক গ্রুপকে বড় ও এক গ্রুপকে ছোট ধরে এগিয়ে যেতে হয় এরা যে কি পরিমান টেলেন্ট ছিল তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না এরাই পরবর্তীতে সাইমুমের গুরু দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে এগিয়ে যায় আজকে তারা সবাই প্রতিষ্ঠিত ও গুণী তারকা আমার সৌভাগ্য, আমি এই তারকামন্ডলীর সাথেই জীবনের একটা উল্লেষযোগ্য সময় অতিবাহিত করতে পেরেছি

আগের বড় গ্রুপের ছোট দুই সদস্য হাসান আখতার ও তোফাজ্জল হোসাইন খান এসে ছোটদের সাথে মিলিত হয় ছোটদের গ্রুপ থেকে উঠে আসে গণসঙ্গীত শিল্পী আবুল কাশেম,বর্তমানের প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন মাওলানা তারেক মনওয়ার, প্রফেসার সাবের ছেলে নোমান আল আযামী, অধ্যাপক সাইফুল্লাহ মানছুর, আবুল হোসাইন মাহমুদ, শহীদুল্লাহ মাসুদ, কামরুল ইসলাম হুমাউন এবং আরো অনেকে তাৎক্ষণিক যাদের নাম বলতে পারিনি কেউ তাদের নাম সংযোজন করলে খুশী হবো ছোটদের গ্রুপে ছিল আকরাম মুজাহিদ, সালমান আল আযামী ও আরো অনেকে এদের মধ্য থেকে অনেকেই (অর্ধডজনেরও বেশী) সাইমুমের পরিচালকের দায়িত্ব পালন করে ভাবা যায়? মনে হলেই এখনো ভালো লাগে আমি এতগুলো পরিচালকের পরিচালক ছিলাম? তাও সাইমুমের স্বর্ণউজ্জল দিনের পরিচালক

সবার মত আমারও মনে হয় আমার সময়ই সাইমুম একটি স্বর্ণালী সময় কাটিয়েছে অনেক স্মৃতিময় ঘটনার মধ্য দিয়ে পার করেছে ব্যস্ততম সময় দুএকটা স্মৃৃতিচারণ করি

তাফাজ্জল ভাই ও সাইফুল্লাহ ভাইয়ের রক্তে ভেজা সাইমুমঃ

ইসলামী সংস্কৃতির জন্য রক্তদানের সবচে বড় ঘটনাটি আমার সময়ই সংঘটিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনে ডাকসুর নির্বাচনী সভা চলছে সভা শেষে শুরু হলো বিশাল মিছিল প্রথম সারিতে নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী কেন্ডিডেটগণ ও নেতৃবৃন্দ আমিও আছি সে সারিতে ঠিক মনে নেই এটা এনাম কাদের পরিষদ নাকি তাহের কাদের পরিষদ ছিল ডাকসুর সাহিত্য সম্পাদক পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছি আমি আমার প্রতিপক্ষে লড়ছেন দুই জাদরেল কবি একজন তসলিমা নাসরিনের প্রথম স্বামী প্রয়াত রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ অন্যজন ঢাকা কলেজে আমার সহপাঠী কবি মোহন রায়হান আমরা একই ক্লাশে পড়তাম এবং দুজনেই কবিতা লিখতাম ঢাকা কলেজে আমরা দুজনই ভিপি পদে নির্বাচন করি এবং দুজনেই পরাজিতও হই ডাকসুতে এসে আবার আমরা মুখোমুখি হই

এ সময়ের কথা

নেতৃবৃন্দের পরের সারিতে ছিল সাইমুমের শিল্পীগণ মিছিলটি বিভিন্ন হল প্রদক্ষিণ করে যখন এফ রহমান হলের সামনে আসলো তখন কোনদিক থেকে যে গ্রেনেড এসে আমাদের আঘাত হানলো বুঝে  উঠার আগেই দেখি পিচঢালা রাজপথ রক্তে রঞ্জিত এক নয়, একাধিক গ্রেনেড ফেটেছিল, তবে কয়টা বলতে পারি না গ্রেনেডগুলো ফাটে নেতৃবৃন্ধের সারি পার করে মূল মিছিলের আগে, যেখানে সাইমুমের শিল্পীরা অবস্থান করছিল গ্রেনেডের স্প্লিন্টার শিল্পীদের শরীর ঝাঁঝরা করে দিল অনেকেই রক্তাক্ত পড়ে আছে পিচের ওপর কিছু স্প্লিন্টার মূল মিছিলের প্রথম সারিতে যারা ছিল তাদের আহত করলো, কিছু নেতৃবৃন্দকেও আমি দেখলাম কিছু স্প্লিন্টার আমার পেন্ট ফুটো করে গোশতের ভেতর গিয়ে বসে আছে কিন্তু তেমন ব্যথা অনুভব করছি না আহতদের ধরে ধরে মেডিকেলের ইমার্জেন্সিতে নেয়া শুরু হলো

প্রথমেই যারা গুরুতর আহত তাদের পালা তোফাজ্জল ভাই, আজিজ সাইফুল্লাহ ও আরো কয়েকজনকে নিয়ে যাওয়া হলো তখনো অনেকেই কাতরাচ্ছে আমি উঠে দাঁড়ালাম দেখলাম আমার সবচে কাছে আকরাম মুজাহিদ নোয়াখালীর মাস্টার শফিকুল্লাহ সাহেবের ছোট ছেলে শিল্পী তারেক মনওয়ারের ছোট ভাই তখনো সে স্কুলের ছাত্র আমি তাকে কোলে তুলে নিলাম একটা রিকসা ডেকে ছুটলাম হাসপাতালে আমি তাকে জাপটে ধরেছিলাম আর সে বলছিল, আসাদ ভাই, সরেন, সরেন আপনার কাপড়ে রক্ত লাগবে

সেই ঘটনায় অনেক রক্ত ঝরেছে কিন্তু ত্যাগের এ পরীক্ষায় এগিয়ে গেলেন দুজন মানুষ একজন, যাকে আমরা ওস্তাদ তোফাজ্জল হোসেন খান বলে চিনি তিনি ছিলেন সাইমুমের অগ্রসেনানীদের একজন তার একটি পা হাটু থেকে কেটে ফেলতে হয়

আর অপরজন ছিল ঢাকা কলেজে আমার প্রিয় কর্মী আজিজ সাইফুল্লাহ আমি যখন ভিপি কেন্ডিডেট ছিলাম তখন দেখেছি কি পরিশ্রম তারা করেছে তারও একটি পা কেটে ফেলতে হয়

সেই গ্রেনেড বিষ্ফোরণের ঘটনায় অনেক রক্ত ঝরেছে আহত হয়েছে প্রায় অর্ধশত তরতাজা তরুণ কিন্তু আলহামদুলিল্লাহ সে ঘটনায় কেউ শাহাদাত বরণ করেনি  এবং দুজন ছাড়া আর কারো অঙ্গহানিও হয়নি চিকিৎসার পর সবাই সুস্থ হয়ে যায়

এ ঘটনায় জীবনের মত পঙ্গু হয়ে যান দুজন মানুষ, একজন তোফাজ্জল হোসেন খান ও আজিজ সাইফুল্লাহ না, তাদের এ ত্যাগ সংগঠন ভুলে যায়নি, তোফাজ্জল ভাইয়ের চাকরী হয়ে যায় ইসলামী ব্যাংকে আর আজিজ সাইফুল্লাহ ভাইয়ের ইবনে সীনায় আমরা আশাবাদী ও দোয়া করি  তাদের এ ত্যাগ আল্লাহও ভুলে যাবেন না আল্লাহ তাদের জন্য উত্তম পুরষ্কার নিয়ে অপেক্ষা করছেন

২৫শে অক্টোবর ২০২০

যেতে হবে আরো বহু দূরঃ ১৮

ও গান, তুমি কার?

অধুনা সারা দুনিয়ায় অভুতপূর্ব একটি ইসলামী জাগরণের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে প্রতিটি সেক্টরই যেন নড়াচড়া দিয়ে জানান দিতে চাচ্ছে, লাব্বাইক, লাব্বাইক, আমি হাজির, আমি হাজির এ ক্ষেত্রে আলেম ওলামা যেমন সঠিক ইসলামকে তুলে ধরতে এগিয়ে এসেছেন, তেমনি শিল্প সাহিত্যেও সুস্থ সংস্কৃতি তুলে ধরার জন্য একদল নিবেদিতপ্রাণ যুবক উম্মার সামনে আশার আলোক হয়ে দেখা দিয়েছে আল্লাহ এ প্রচেষ্ঠা কবুল করুন যারা এ ক্ষেত্রে এগিয়ে এসেছেন তারা যথেষ্ট প্রতিভাবান সবদিক চোখ কান খোলা রেখেই তারা এগুবেন এ প্রত্যাশা উম্মার প্রতিটি সদস্যই কামনা করেন সেই সাথে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা ও দোয়া করাও সবার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে

আমাদের মধ্যে এসেছে মানসম্মত গীতিকার, সুরকার ও শিল্পী এদের সবার অন্তরে একটাই স্বপ্ন, তারা তাদের এ আমলের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তোষ কামনা করে

কিন্তু নিয়তের সাথে সাথে সময়ের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে যথাযথ কর্মপন্থা গ্রহণ করতে না পারলে কাঙ্খিত সফলতা থেকে বঞ্চিত হতে হয়

প্রাথমিকভাবে গানের এ কর্মযজ্ঞ শুরু হয় গীতিকার থেকে গীতিকারের বানীকে সুরকার সুর দিয়ে এর দ্বিতীয় ধাপ সম্পন্ন করেন কিন্তু জনতার সামনে তুলে ধরেন শিল্পী গানটি তখন জনমনে আলোড়ন তোলে এরপর যদি কিছু প্রফেশনাল লোক এ গানকে প্রফেশনালী প্রমোট করার উদ্যোগ না নেয় তবে তা একটা নির্দিষ্ট গন্ডিতেই আটকে থাকে এর জন্য প্রফেশনালিজম খুবই দরকার

সবারই জানা, ইংরেজরা যখন এ দেশে চায়ের প্রচলন করে তখন মাগনা চা খাওয়াতো এখন কিন্তু বাঙালি মাত্রই চা খোর একেই বলে বাজারজাত করণ কবি মতিউর রহমান মল্লিক  যখন বিল্লালের গজলকে ইমলামী গানের পর্যায়ে নিয়ে আসেন তখন ইসলামী গানকে কেবল মাগনা দিলেই হতো না সঙ্গে খরচপাতিও করতে হতো এরপর এর চাহিদা বাড়লে শির্ল্পীদের পক্ষে যাতায়াত ভাড়া ম্যানেজ করার প্রশ্ন দেখা দেয় তখন থেকেই সীমিত আকারে এর সাথে অর্থ জড়িয়ে পড়ে আস্তে আস্তে চাহিদা বাড়ে গান ক্যাসেট করার দরকার হয়, স্টুডিও লাগে আস্তে আস্তে খরচ বাড়ে আস্তে আস্তে বাজারও বড় হতে থাকে এখন ইসলামী গান একটি জনপ্রিয় প্রোডাক্ট নানা ভাবেই এর বাজার ক্রমেই বাড়ছে সেই সাথে বাড়ছে মানসম্মত গানের চাহিদা বাড়ছে গীতিকার, সুরকার, শিল্পীদের সম্পৃক্ততা যতো সময় যাচ্ছে ততোই এর ব্যাপকতাও বাড়ছে মার্কেট বাড়ছে, লেনদেন বাড়ছে, জটিলতাও বাড়ছে এটাই স্বাভাবিক

এ ক্ষেত্রে একটি নীতিমালা এখন জরুরী হয়ে পড়েছে এ নীতিমালা কী হবে এর সাথে যারা জড়িত তারাই ভাল বলতে পারবেন আমি জানিনা, কোন নীতিমালার ভিত্তিতে এ অঙ্গন চলছে কি না চললে ভাল, না চললে বিষয়টি নিয়ে ভাবা দরকার বলে আমি মনে করি

কোন পন্য উৎপাদনে ও বিপননে অন্তত দুটি পক্ষ থাকেই একদল মালিক, অন্য পক্ষ বাজারজাতকারী ব্যাবসায়ী এদের প্রত্যেকের হক নিশ্চিত করা ইনসাফের দাবী

গানের প্রাথমিক মালিক তিন জন

গীতিকার

সুরকর

শিল্পী

উৎপাদন খরচ বাদ দিয়ে যে গানের যেমন ইনকাম হয় আমার বিবেচনায় তার লভ্যাংশ মাস বা বছরান্তে পাঁচ ভাগে ভাগ  হতে পারে

গীতিকার ১

সুরকার ১

শিল্পী ১

উদ্যোক্তা বা ব্যবসায়ী ১

বিজ্ঞাপন, হিসাব ও মার্কেটিং খরচ ১

এতে করে কোন পক্ষই বঞ্চিত হবে না সবাই তার মেধা মূল্যের ভাগ পাবেন

যদি এমন হয় যে, যিনি সুরকার তিনিই শিল্পী তাহলে ১+১= ২ ভাগ তিনি পাবেন যদি তিনি উদ্যোক্তা হন + ১= ৩ ভাগ পাবেন, যদি তিনি মার্কেটার হন আরো এক ভাগ বাড়বে যদি তিনি গীতিকারও হন তাহলে পুরো লাভ তিনিই পাবেন

গীতিকার বলুন, সুরকার বলুন আর শিল্পীই বলুন, এক সময় তিনি আর মেধা দিয়ে ইনকাম করতে পারেন না দুস্থশিল্পীদের জন্য বার বার ফান্ড গঠনের দাবী ওঠে কিন্তু এটা হয়ে ওঠে না যে শিল্পীর সুরটা তিরিশ বছর পরও বাজারে চলে, তিনি কেন হাত পেতে সাহায্যের আশায় বসে থাকবেন? আমার গান আপনি বাজারজাত করে লভ্যাংশ খেতেই থাকবেন আর আমি হাসপাতালের বেডে লেখক শিল্পীর এ অবস্থার অবসান হওয়া দরকার নিজেদের মধ্যে এতটুকু সততা ও ইনসাফ কায়েম করতে না পারলে আল্লাহর কাছে আমরা কি নিয়ে দাঁড়াবো?

আপনি যদি ব্যাবসা করতে জানেন, আপনি প্রকাশক না হয়েও দেশের সেরা বিক্রেতা হয়ে উঠতে পারেন আজ রকমারি ডটকমে সবাই বই দেয়ার জন্য পাগল সততার সাথে ব্যাবসা করলে ইসলামী গানের সাথে যারা জড়িত সকলেই ভালভাবে জীবন যাপন করতে পারবে আল্লাহর রহমতে তাদের সমস্যা তারাই সমাধা করতে পারবে

দ্বিতীয় আরেকটি বিষয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই ইউটিউবে গান সার্চ দিলে প্রতিটি গানেরই একটা টপহেড আসে সেখানে গানের পরিচিতি ও শিল্পীর নাম বা ছবি থাকে বিষয়টা আমার কাছে খুব বেখাপ্পা লাগে কারণ যিনি গাইছেন তাকে আমরা চিনি এবং সরাসরি তিনি গাইছেন আমরা দেখতেই পাচ্ছি তার নাম বা ছবি না দিলেও শিল্পীকে আমাদের চিনতে অসুবিধা হচ্ছে না কিন্তু গানটি কে লিখেছে, কে সুর করেছে জানার আগ্রহ অনেকের থাকে কিন্তু সবসময় শ্রোতারা তা জানতে পারে না  এ ক্ষেত্রে ইনসাফের দাবী হচ্ছে, যদি ওখানে কারো নাম বা ছবি ব্যাবহার করতেই হয় তাহলে প্রথমেই যাবে গীতিকারের নাম, তারপর সুরকারের নাম, তারপর শিল্পীর নাম ছবির ক্ষেত্রেও তাই

এটা বলছি এ জন্য যে, আল্লাহ পবিত্র কালামে সত্যকে প্রকাশ করতে বলেছেন, গোপন করতে নিষেধ করেছেন নাম গোপন করা সরাসরি আল্লাহর হুকুম অমান্য করার নামান্তর অথচ আমরা অবলীলায় এটা করছি, এবং এটা যে অন্যায় সে ফিলিংসটাও আমাদের নাই আমি ইউটিউবে গান শুনতে গিয়ে বেশ কিছু গান পেয়েছি, যেগুলোতে আমার নাম নাই কোন কোন গানে আমাকে সুরকার বলা হয়েছে  কিছু গানে দেখলাম আমার গান আমার পরিবর্তে অন্যের নামে চালিয়ে দেয়া হয়েছেএতে আমার কোন অসুবিধা নাই নাম প্রচারের জন্য আমি গান  লিখিও নাই কিন্তু যে বন্ধুরা এসব করছেন কাল কেয়ামতে তারা কি জবাব দেবেন শুনেছি, কারো অধিকার হরণ করলে তার কাছ থেকে মাফ

না নিলে আল্লাহও নাকি সে পাপ মাফ করেন না আমি আমার প্রিয় ভাইদের অনুরোধ করবো, আপনার দ্বারা যদি এমন কিছু ঘটে থাকে, দয়া করে কারেকশন করে ফেলুন

আরো মজার ঘটনা হচ্ছে, একাধিক মিডিয়া দেখলাম যারা জনপ্রিয় ইসলামী গান ছেড়েছে কিন্তু সে গানগুলোর কোন সুরকার, গীতিকার নেই সার্বিক ব্যাবস্থানায় অমুক মিডিয়া

যারা বোদ্ধা লেখক তারা গুছিয়ে লেখেন

১২ই নভেম্বর ২০২০ : ২টা

যেতে হবে আরো বহু দূরঃ ১৯

আলহামদুলিল্লাহ আলহামদুলিল্লাহআলহামদুলিল্লাহ হে মালিক, হে মুনিব,  হে রাব্বুল আলামীন, সমস্ত প্রশংসা তোমার আমাকে মাফ করে দাও তোমার প্রশংসা করবো, সে ভাষা আমার জানা নেই তুমি আমাকে পরম আদর ও যত্নে সৃষ্টি করেছো, সে জন্য যে কৃতজ্ঞতা জানাবো, সে ভাষাও আমার জানা নেই এই যে এতটা বছর বেচে আছি, তুমি দয়া করে আলো দিচ্ছো, ছায়া দিচ্ছো, বিনামূল্যে অক্সিজেন দিচ্ছো, কোনটা রেখে আমি কোনটার জন্য শোকর জানাবো? হাস্নাহেনার ঘ্রাণের জন্য, নাকি ঘ্রাণ উপভোগ করার জন্য যে নাক দিয়েছো তার জন্য? নাকি এ আনন্দ উপভোগ করার জন্য যে মন দিয়েছো তার জন্য? প্রভু, আমি এসব কিছুই জানি না, জানতে চাইও না আমি শুধু জানি, আমি তোমার এক নগন্য গোলাম, তোমার প্রিয় হাবীবের আমি গোননহগার উম্মত, আমাকে তুমি ক্ষমা করে দাও আমার অপূর্ণতা, আমার  অক্ষমতার জন্য যদি কৈফিয়ত চাও, তাহলেই আমি আটকে যাবো

প্রভু, সত্যি আমি জানি না কেমন করে তোমার শোকর আদায় করবো? এই যে নখের নিচ দিয়ে মোটা সুঁইটা ঢুকিয়ে দিল, পৃথিবীর কয়জন জানে তার কষ্ট? আল্লাহ, দোযখের আযাব কি এরচে কঠিন? এর চেয়ে কষ্টকর? মাবুদ, কেমন করে সইবো তা? না না মাবুদ, আমি পারবো না, আমাকে মাফ করে দাও প্রভু, আমি কেমন করে তোমার শোকর আদায় করবো? আমার কি সাধ্য আছে, আঙুলের মাথায় নখের যে মরা অংশটি আছে, আমি তার কৃতজ্ঞতা আদায় করি? আমার জন্য মানুষের যে ভালবাসা ও দোয়া, তাতো তুমি তাদের দিয়েছো, মানুষের কি সাধ্য আছে তার শোকর আদায় করে? তাহলে? তাহলে তুমি বুঝতে পারছো, আমি কত অধম? তুমি মাফ না করলে কেউ আমাকে মাফ করতে পারবে না

আমি এখন কবি লোকে তাই জানে ও বলে কিন্তু আমি কি কবিতার একটি শব্দও লিখেছি? সবই তো তোমার দান আমার ভাব, ভাষা, শব্দ, উপমা, চিত্রকল্প, অলংকার কিছুই আমার নয় আমার পূর্ণতা অপূর্ণতা  সবটুকুই তোমার রহমত

মানুষ পূর্ণতা বুঝে,অপূর্ণতা যে রহমত হতে পারে সেটা বুঝে না মানুষ আমাকে বলে কবি, ছড়াকার, অনুবাদক, গীতিকার কত কি কিন্তু আসল সত্য তো শুধু তুমিই জানো, আর কেউ জানে না এমনকি আমিও না

আমি কি জানতাম, আমাকে মুর্খ রাখার পেছনে তোমার পরিকল্পনা কি? এটাও যে তোমার নেয়ামত, সেটা এখন বুঝি

আলহামদুলিল্লাহ আমি সব সময় আমার প্রভুর ওপর সন্তুষ্ট ছিলাম কোনদিন অপূর্ণতায় ভুগিনি কেন ভুগবো? একদিন তো আমি নিজেই ছিলাম না আল্লাহর রহমতে এলাম দুনিয়ায় ভাল কিছু হলে সুখী হই মন্দ কিছু ঘটলে সবর করি ভাবি, এখানেও শিখার কিছু থাকতে পারে

আমার বাড়ি অঁজ পাড়াগাঁ গজারি বনের ভেতর বাড়ির চারদিকে কাঁঠাল বাগান, আমবাগান, লিচুবাগান, পেয়ারা বাগান আনারসের ঝোঁপ, বিশাল কচুক্ষেত এরপর ধানক্ষেত গজারির বন  কোথাও কোথাও বেল গাছ, জাম গাছ

কত বন্য ফল যে শৈশবে খেয়েছি তার ইয়ত্তা নাই এক জামেরই কত রূপ কালো জাম, গোদা জাম, আরো কিকি নাম আনহই গোটা, বনহই গোটা, দাতই গোটা, বাসক ফুলের মধু, বেতফল, আমলকি, জলপাই, তালের আঁটি, ঢেপ, শালুক, বরই, নানা রকম কলা, পেঁপেঁ, আখ, কত কি দলবেঁধে বনে বনে ঘুরতাম আর খেতাম আহ, কই গেল সে দিন

বাড়ির পাশে তখন বড় সড়ক ছিল না, খাল ছিল না ছিল বিল ধলি বিল সেই বিলে থাকতো কই, শিঙ, মাগুর, পুটি, টেংরা, বইচা, ইচা, শোল, বোয়াল, চান্দা, বাইম, টাকি, ভেদা, কাইক্কা,গুতুম কত রকম মাছ রুই, কাতলা বর্ষা কালে কদাচিৎ পাওয়া যেতো মানে, আমি নিরেট এক গাঁইয়া পোলা

এখনতো পোলাপানে টাকা পেলেই ছুটদোকান থেকে চকলেট, চানাচুর, আইসক্রীম কত কিছু কিনে খায় আমাদের সে সুযোগ ছিল না তেল, সাবান দরকারী যা কিছু লাগে সাপ্তাহিক হাট থেকে আনতে হতো আব্বাও সপ্তাহিক বাজার থেকেই আমাদের জন্য মজা কিনে আনতেন মজা মানে নানা রকম কটকটি, বিস্কিট, বাতাসা, তিলা এইসব মা পোটলাটা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলতেন, এগুলো তোর বৈয়ামে তুলে রাখ এ সপ্তাহে আর হাট নাই, সারা সপ্তাহ খেতে হবে

আমি তখন সেই খাবার সাত ভাগ করতাম সেই সাত ভাগ সাতদিনের জন্য তারপর ঠিক করতাম সকালে কি খাবো, রাতে কি খাবো কিছু সঞ্চয়ও রাখতাম, যদি হঠাৎ দরকার হয়ে পড়ে এভাবেই মা আমাকে মিতব্যয়ী হতে শিখায় আজো অপব্যয় আমি পছন্দ করি না কিন্তু যখন কিছু কিনি সেরাটা কিনতে চেষ্টা করি আর সামর্থ অনুযায়ী প্রয়োজনীয় খরচ করতেও আমার আপত্তি নেই আমার চাহিদার পূর্ণতা এভাবেই আসে আল্লাহ খুশি হয়ে যখন যা দেন হাত পেতে নেই, কোনকিছু না পেলে হায় আফসোস করি না কারণ আমি জানি, আমার ভাগ্যে যা আছে তা আসবেই, কেউ ফিরাতে পারবে না

বলছিলাম অপূর্ণতা বা না পাওয়াও একরকম রহমত আমি কখনোই বলিনি, আল্লাহ, তুমি আমাকে এটা দাও, ওটা দাও বলেছি, আমার জন্য যা কল্যাণকর, মঙ্গলজনক, তুমি আমার জন্য যা ভাল মনে করো তাই দাও এবং আমাকে শোকরগুজার বানাও আলহামদুলিল্লাহ, আমি এতটাই পেয়েছি, যা আমি একদিন কল্পনাও করতে পারতাম না

আমি শুদ্ধভাবে কোরআন তেলাওয়াত শিখেছি মোস্তফাগঞ্জ হাফেজিয়া মাদ্রাসা থেকে একাত্তুরে শাহাদাত বরণকারী আমার বড় ভাই হাফেজ মুহাম্মদ ইউনুস আলী এখান থেকেই হাফেজি শেষ করেন তার সাথেই আমি এখানে আসি আমরা সদরঘাট থেকে লঞ্চে উঠতাম এবং তালতলা বাজারে গিয়ে নামতাম তালতলা থেকে যে রাস্তা ইছাপুর বাজারের দিকে গেছে সেপথে এগিয়ে গেলেই রাস্তার পাশে আমাদের মাদ্রাসা তখন রাস্তায় মাত্র মাটি ভরাট হয়েছে, যানবাহন চলাচল শুরু হয়নি আমরা তালতলা থেকে হেঁটে মাদ্রাসায় যেতাম

আমার মায়ের সন্তান ছিল দশজন পাঁচ ছেলে, পাঁচ মেয়ে মেয়েরা বিয়ে হওয়ার আগেই মারা যায় ভাইদের মধ্যে মারা যায় একজন ফলে আমরা ছিলাম চার ভাই হাফেজ ভাই যখন কুমরাদি মাদ্রাসায় আলেম পাশ করে ফাজেল পড়ছিলেন তখন ছিল একাত্তুর সাল লোক রটনা, মাদ্রাসা থেকে বাড়ি আসার পথে তিনি পথিমধ্যে শাহাদাত বরণ করেন যদিও সঠিক কোন খবর আমরা আজও পাইনি তার লাশ দেখেছে এমন কারো সাক্ষাৎ আমরা পাইনি মাদ্রাসা থেকে জানা যায়, মাদ্রাসা থেকে তারা চারবন্ধু একসাথে বাড়ির পথে রওনা দেয়, কিন্তু কেউ আর বাড়ি ফিরেনি আমার মা মরার আগ পর্যন্ত তার হাফেজ সন্তানের জন্য কেঁদে প্রায় অন্ধ হয়ে গিয়েছিল

যাই হোক, সেই থেকে আমরা হয়ে গেলাম তিন ভাই

আমার বড় ভাই অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউসুফ আলী পাকিস্তান আমলে ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজ (বর্তমান কবি নজরুল কলেজ) থেকে বোর্ডে প্রথম হয়েছিলেন মেজো ভাই প্রিন্সিপ্যাল ইদ্রিস আলীও বোর্ডে স্ট্যান্ড করেন যে ভাই শাহাদাত বরণ করেন তিনিও আলেমে মাদ্রাসা বোর্ডে  ষষ্ঠস্থান অর্জন করেছিলেন আমি যদিও তাদের মত ভাল ছাত্র ছিলাম না কিন্তু মাস্টার্সেও মেধা তালিকাতেই নাম ছিল কথাটা এজন্য বললাম, একেবারেই যে গর্দভমার্কা ছাত্র ছিলাম না তা বুঝানোর জন্য কিন্তু এরপর যে কথাটা বলবো তা শোনার জন্য যে আপনারা কেউ প্রস্তুত না তা আমি হলফ করে বলতে পারি কেউ বলতে পারেন, বিনয় করছি, কেউ বলবেন ঢং কিন্তু বন্ধুরা, ঢং না, যা বলছি এটাই সত্যি বিশ্বাস করুন, একবর্ণ মিথ্যা বলছি না

আপনারা জানেন, উর্দু সাহিত্যের জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক নসীম হিজাযীর সবচেয়ে বেশী বই অনুবাদ করিয়ে সম্পাদনা করে বের করেছি আমি আমার প্রকশনা প্রতিষ্ঠান অধুনালুপ্ত প্রীতি প্রকাশন থেকে আমার হাত দিয়েই বেরিয়েছে সীমান্ত ঈগল, আঁধার রাতের মুসাফির, কায়সার ও কিসরা, হেজাযের কাফেলা, ইউসুফ বিন তাশফিন, আলোর পরশ, ইরান তুরান কাবার পথে, কিং সায়মনের রাজত্ব, সুলতান মাহমুদসহ প্রায় ডজন খানেক বই এটা কোন সহজ কাজ ছিল না বইগুলো একেবারে ছোট নয় এর মধ্যে তিনশ চারশ পৃষ্ঠার বইও আছে

আমার প্রায় পাঁচ হাজার পৃষ্ঠার তিন খন্ডে প্রকাশিত ক্রুসেড সমগ্র, আগে যেটা পেপারব্যাক হিসাবে ক্রুসেড সিরিজ নামে তিরিশ খন্ডে প্রকাশিত হয়েছিল এর মূল কাহিনী ছিল আলতামাসের দাস্তান ঈমান ফারোশ আমার হাত দিয়ে মূলত তাঁরই একটা বাংলা সংস্করণ বের হয়

এরপর খালিদ বিন ওলিদের জীবন কাহিনীর একাংশ যেখানে তিনি সত্য অন্বেষণে ব্যাপৃত ছিলেন সেটা গার্ডিয়ান পাবলিকেশন্স থেকে দুর্গম পথের যাত্রী নামে বের হয়, যদিও  এটা একসময় মাসিক কিশোরকন্ঠে ধারাবাহিকভাবে বের হওয়ার সময়ই পাঠকের মন টেনে নেয় এরও মূল কাহিনী উর্দু থেকে নেয়া অথচ আপনারা কি জানেন, আমি এক লাইন উর্দু পড়তে পারি না, অনুবাদ করা তো পরের কথা

না পাওয়াটা যে আল্লাহর রহমত এটা কি আপনারা বুঝতে পেরেছেন? বুঝেননি তাহলে শুনুন আমি তো শৈশবে মাদ্রাসাতেই ভর্তি হয়েছিলাম আরবী শেখার পর উর্দুতে সবকও নিয়েছিলাম শুধু এতটুকু মনে আছে, বর্ণমালা শেখার পর "আজকা কাম কালপর না ঢাল" মানে আজকের কাজ আগামী কালের জন্য আটকে রেখো না, এ পর্যন্ত শিখেছিলাম এরপর আল্লাহ আমাকে আর অগ্রসর হতে দেননি

মাদ্রাসায় থাকলে আমি কি কোন ছোটখাটো আলেমও হতে পারতাম না? কিন্তু আল্লাহর ফয়সালা ছিল না বলে আমি সে পথে অগ্রসর হতে পারিনি তার বদলে তিনি আমাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় এম এ পাশ করালেন বুঝলাম, আমার একটা এম এ পাশ সার্টিফিকেট দরকার কিন্তু বাংলায় কেন? আমার বড় ভাই কেউতো বাংলায় পড়েনি, এমনকি  আমার বংশেরও কেউ না তাহলে  আমি কেন বাংলা পড়লাম? কারণ এটাই ছিল আল্লাহর ফয়সালা বান্দার কি সাধ্য আছে আল্লাহর ফয়সালা পরিবর্তন করে?

এরপর আপনাদের বলবো, উর্দু না শেখায় কি লাভ হয়েছে? তবে আজ নয়, আরেকদিন যদি আল্লাহ তৌফিক দেন এ এক আজব কাহিনী

১৪ই নভেম্বর ২০২০ : ৬টা

যেতে হবে আরো বহু দূরঃ ২০

মানুষ মনে করে পাওয়ার মধ্যেই কল্যাণ কিন্তু না পাওয়ার মধ্যেও য়ে কল্যাণ থাকতে পারে সেটা মানুষ জানে না একবার আমার ঢাকা আসার খুব দরকার আমরা তখন রেলে ঢাকায় যাতায়াত করি আমার বাড়ি থেকে ঘোড়াশাল রেলস্টেশন পাঁচ ছয় মাইল দূর কিছু পথ হেঁটে কিছু পথ রিক্সায় আসতে হয় সকাল নটায় দুধের গাড়ি ধরার জন্য আমি বাড়ি থেকে বের হলাম গাড়ি মিস করতে পারি এ আশঙ্কায় একটু জোরেই হাঁটছিলাম পথে এক মুরুব্বীর সাথে দেখা বললেন, এমন তাড়াহুড়ো করে কই যাও? তোমার সাথে আমার একটা জরুরী কথা ছিল

বললাম, ঢাকা যাবো, ফিরে এসে দেখা করবো

উনি বললেন, তার দরকার হবে না জাস্ট এক মিনিট

আমি উনাকে একটা মিনিট সময় দিলাম

আমি দূর থেকেই দেখলাম, স্টেশনে ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে দৌড় দিলাম স্টেশনে ঢুকার যে গেট ওটাও পার হলাম কিন্তু গাড়ি চলতে শুরু করলো আমি দৌড়াচ্ছি কিন্তু গাড়ি ধরতে পারলাম না আমাকে না নিয়েই আমার চোখের সামনে দিয়ে গাড়িটা চলে গেল আমি তখন হাপাচ্ছি আমার কাছেই সিমেন্টের বেঞ্চে বসে আছে এক বুড়ো লোক তিনি বললেন, বাবা, বসো আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন

আমার এমন রাগ হলো, ইচ্ছে করলো লোকটাকে চড় মারি কিন্তু নিজেকে সংযত করলাম

তার দুইঘন্টা পর পরবর্তী ট্রেন আমার কিছু করার ছিল না অগত্যা বসে রইলাম আমার মনের তখনকার অবস্থা বুঝতেই পারছেন  ভেসে গেল আমার জরুরী কাজ

সব রাগ গিয়ে পড়লো সেই একমিনিট মুরুব্বীর ওপর পরে শুনলাম, আগের গাড়িটি এক্সিডেন্ট করেছিল, অনেক লোক হতাহত হয়েছিল এখনো আমার মনে সেই সেই বুড়োর কন্ঠই ভেসে আসে "আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন"

এই ঘটনা মা শোনার পর মাও বললেন, আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন আপনাদের কি মনে হয়?

আগের ট্রেন ফেল করা আমার জন্য লাভজনক না ক্ষতিকারক  হয়েছে?

আমি তো মাদ্রাসায় ভর্তি হয়েও উর্দু শিখতে পারলাম না আমাদের দেশে হাজার হাজার মাদ্রাসা আছে, হাজার হাজার আলেম আছে কিন্তু নসীম হিজাযীর উপন্যাসগুলো অনূদিত হয় নাই অথচ এ উপন্যাস আমাদের মাঝে ইসলামের প্রতি অপরিসীম আবেগ ও ভালবাসা তৈরী করে আল্লাহ এ কাজটি কোন আলেমকে দিয়ে অবশ্যই করাতে পারতেন তার পরিকল্পসা বান্দার পক্ষে সত্যি বুঝা ভার

আপনারা জানেন, যিনি অনুবাদ করেন তিনি সবসময়ই চান অনুবাদটা যেন মূলানুগ হয় আর ওটা করতে গিয়ে তিনি এমনসব শব্দ ব্যবহার করেন, যাতে মূল লেখকের কাছাকাছি যায় কিন্তু একেক ভাষায় রস পরিবেশনের স্টাইল ভিন্ন বাজার থেকে গরুটি কিনে নিয়ে বাড়ি যাওয়ার পথে গরুটি মারা গেল আর লোকটি মাঠে মারা গেল এর মাঠ মানে ফিল্ড লেখলে অনুবাদ হয়তো হবে কিন্তু সাহিত্যের রসটা থাকবে না একই শব্দের অনেক অর্থ থাকে, আপনার যেটা প্রয়োজন সেটা নেবেন যেমন প্রতিজনে একটা, মানে একজনে একটা প্রতিজনকেই দিতে হবে, মানে সবাইকে দিতে হবে এখানে প্রতি মানে সবাই কোন শব্দের কি মানে তা নির্ধারিত হয় বাক্যের ভাব অনুযায়ী মূলানুগ অনুবাদ হলে এক ভাষার শব্দ অন্যভাষায় ভিন্ন অর্থে চলে আসতে পারে যেমন, একজন অনুবাদ করলো, প্রতিদিন ছেলেটি দুধ নিয়ে যাওয়ার সময় মেয়েটিকে বারান্দায়  দেখতে পায়, আরেকজন লেখলো, একদিন ছেলেটি দুধ নিয়ে যাওয়ার সময় মেয়েটিকে বারান্দায়  দেখতে পায় একই বাক্যের অনুবাদে দুজন দুরকম লিখলো দুজনকেই বললাম, কি হলো? তারা বললো, স্যার, প্রতি  মানেই তো ইউনিট, এক  এবার আপনারাই বলুন, প্রতিদিন আর একদিন কি একই অর্থ বহন করে? এখানে একজন তো অবশ্যই ভুল করেছেকেন করেছে? কারণ তারা দুজনই মূল শব্দের অর্থ জানে কিন্তু যিনি মূল শব্দ জানেন না, তিনি কিন্তু ভুল করতে পারবেন না তিনি কাহিনীর গতিধারা দেখবেন, বুঝবেন, প্রতিদিন দেখাদেখি হতে হতেই একজন আরেকজনের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েছে

এই লাভটাই আমার হয়েছে আমি উর্দু না জানার কারণে আমার ভুল করার সুযোগ ছিল না আমি কাহিনীর গতিধারা নির্মাণ করতে গিয়ে বাংলা ভাষায় যেখানে যে শব্দ ভাল মনে করেছি ব্যবহার করতে পেরেছি উর্দুভাষার শব্দ, স্টাইল, বাগধারা কোনকিছুই আমাকে স্পর্শ করতে পারেনি যেহেতু আবদুল হক সাহেবের অনুবাদ ভাল ছিল, ফলে ওটা এডিট করার পরই কাহিনী দাঁড়িয়ে গেছে কিন্তু বহু জায়গায় শব্দ, বাক্য, গ্রন্থনা পাল্টাতে হয়েছে

অনুবাদক জানেন, সম্পাদনায় আমার নামটা ব্যাবহার করা কতটা যুক্তিযুক্ত হয়েছে আমি আদৌ অনুবাদের সম্পাদনা করেছি কিনা বইয়ের মূল লেখক বইটি লিখেছেন উর্দুতে বাংলায় অনুবাদ করেছেন আবদুল হক উপন্যাসটিকে সুখপাঠ্য উপন্যাস করার দায়িত্বটা আমাকেই পালন করতে হয়েছে ভাষায় গতি আনা, সাধ্যানুযায়ী যথার্থ শব্দ ব্যবহার, এবং কাহিনী বিন্যাসে বাঙালি স্টাইল এনে এটিকে মৌলিক উপন্যাসের মত গতিময় আমি এ জন্য করতে পেরেছি, কারণ আমি উর্দু জানি না আমি বাংলা ছাড়া পৃথিবীর আর কোন ভাষাই তেমন জানি না ফলে, বাংলা কাহিনী আমাকে  বাংলার মতই সাজাতে হয়েছে কম জানার লাভ এখানেই

নসীম হিজাযীর মুহাম্মদ বিন কাসেম বইটি অনুবাাদ করেছেন জনাব আবদুল হক বের করেছে কোঅপারেটিভ বুক সোসাইটির মত প্রাচীন প্রকাশনী সে অনুবাদ মূলানুগ হয়তো হয়েছে কিন্তু উপন্যাসটি যথেষ্ট গতিময় হয়নি তিনি মুল লেখাটির গতি  ও আবেগ ধরে রাখতে পারেননি এই সমস্যাটি হয়েছে উর্দু জানার কারণে লাইন বাই লাইন তিনি আক্ষরিক অনুবাদ করতে গিয়ে তালগোল পাকিয়ে ফেলেছেন আমি যদি উর্দু জানতাম আমারও তাই হওয়ার সম্ভাবনা থাকতো

আমি বাংলা ছাড়া আর কোন ভাষা না জানার কারণে কোন ভেজাল দেয়ার সুযোগ আমার রইলো না ফলে, ঝরঝরে বাংলায় বইগুলো জাতির সামনে আমি হাজির করতে পেরেছি এ জন্য মহান আল্লাহর শোকর আদায় করি

আপনাদের জানা থাকা ভাল, আমি কোরআন পড়তে পারি, কিন্তু একপৃষ্ঠা আরবী  থেকে অনুবাদ করতে পারি না আমি প্রাচ্যের অক্সফোর্ড ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন গ্রাজুয়েট কিন্তু একপৃষ্ঠা ইংরেজী অনুবাদ করতে পারি না আমি নসীম হিজাযীর দশটি উপন্যাস অনুবাদের সম্পাদনা করার পরও একপৃষ্ঠা উর্দু অনুবাদ করতে পারি না কাশ্মীর থেকে দিল্লীর লালকেল্লা বা ফারাক্কাবাঁধ ও পলাশীর আম্রকানন, রাজস্থান, মুর্শিদাবাদের নবাব সিরাজদৌল্লার সমাধি, আজমীর শরীফ, তাজমহল, জয়পুরের পিংকসিটিসহ ভারতের বিভিন্ন রাজ্য ঘুরতে পারলেও একপৃষ্ঠা হিন্দী অনুবাদ করতে পারি না তার মানে, কোন ভাষা থেকেই একপৃষ্ঠা অনুবাদ করার যার যোগ্যতা নেই, তিনি কোনভাবেই নিজেকে অনুবাদক বলে পরিচয় দিতে পারেন না তাই আমি জ্ঞানত কোথাও কোন বইতে নিজেকে অনুবাদক বলিনি আমাকে যারা মহাপন্ডিত ভেবে বসে আছেন তাদের একটু কষ্ট হলেও সত্যটা যে আমাকে বলে যেতেই হবে

আমার জ্ঞানগরিমা ততটুকুই যতটুকু আল্লাহ আমাকে দিয়েছেন আমি আমার প্রভুর এ দানে মহা খুশী বেশী প্রতিভাবান হওয়ার চাইতে শোকরগুজার বান্দা হওয়া ভাল তাই আমার কোন অভাব নেই

আমি মাঝে মাঝেই বলি, আল্লাহ পৃথিবীতে বিচিত্র ধরনের লোক সৃষ্টি করেছেন একদল লোক আছেন যারা কখনোই খুশী হতে জানেন না যাদের জীবরভর  শুধু দুঃখ আর কষ্ট অভাব আর অতৃপ্তি কোটি টাকার মালিকও এ অভাবে পড়তে পারে, পারে মধ্যবিত্ত, এমন কি পথের ফকিরও কিছু লোকের মনে মেঘ বৃষ্টির মত সুখ দুঃখ আসা যাওয়া করে তারা ক্ষণে হাসে ক্ষণে কাঁদে আর কিছু লোক আছে যাদের কখনো দুঃখ কষ্ট স্পর্শ করতে পারে না তারা সারাজীবন সুখের সাগরে হাবুডুবু খায়

আমি হচ্ছি শেষোক্ত দলের শুধুই আনন্দ সাগরে ভাসি দুঃখ কিসের? দুঃখ আছে বলেই তো মানুষ অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারে একেকটা নতুন অভিজ্ঞতা একেকটা অর্জন যা অতীতে আপনি একটু টেস্ট করারও সুযোগ পাননি করলা কত তিতা তাও আমরা যত্ন করে খাই কেন খাই? কারণ, এর মাঝেও আমরা টেস্ট পাই জীবনকে আনন্দময় করার কৌশল জানতে হয় এক ঈদের সময়  আমি নতুন ব্যবসায়ী প্রীতি প্রকাশন বইয়ের ব্যবসা কিন্তু ঈদের সময় মানুষ গরু কিনা বাদ দিয়ে কি বই কিনবে দেনাদাররা কেউ পয়সা দেয় না কিন্তু পাওনাদার বাড়তেই থাকে  দৈনিক যা আয় হয় ব্যয় বেড়ে যায় তারচে বেশি ঈদের আর একদিন বাকী এখনও একমাত্র কর্মচারীর বোনাস বেতন বাকী নিজের বাজার সদাইও ভাবনায় পড়ে গেলাম মনটা কেমন খারাপ হয়ে গেল এককেজি সেমাই কিনবো সে সুযোগও নেই আমার সামনে সমস্যা এলেই বলতাম, ভেবো না, ব্যবস্থা একটা হয়েই যাবে এবারও তাই বলে যাচ্ছি দোকানের কর্মচারী তারিক বললো, কাকা, কালকে বাড়ি যেতে চাচ্ছিলাম আমি বললাম, যাও ও ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো আস্তে বলল, টাকা? আমার কাছে তো টিকেট কিনার টাকাও নাই

আমি বললাম, দেখা যাক না এক ব্যবস্থা হয়েই যাবে মুখে বললাম, কিন্তু মনে তেমন ভরসা পেলাম না

মাগরিব পর্যন্ত কিছুই হলো না মনটা ভাল নেই ছেলেমেয়ের বায়না, বউয়ের বাজার, তারিকের বেতন কিছুই কি হবে না? আমি তাকাই কর্মচারীর দিকে, কর্মচারী আমার দিকে মাগরিব পড়ে তারিককে বল্লাম, তুমি থাকো, আমি বাসায় যাই

বাসায় গিয়ে ছেলেমেয়েকে বললাম, আয় লুডু খেলি দুঃখ তাড়ানিয়া খেলা  ব্যস, কমে গেল দীলের পেরেশানী, মনের কষ্ট এশার একটু আগে তারিক বাসায় এলো বললো, কাকা, এক লোক এসেছে আপনার সাথে দেখা করতে চায় কিসের খেলা, কিসের কি বললাম, চলো

গিয়ে দেখি এক ভদ্রলোক, তেমন চিনি নাউনি বললেন, আমি অমুক কলেজের প্রিন্সিপ্যাল কাল বার্ষিক পুরষ্কার বিতরনী সভা শিক্ষক থেকে শুরু করে সব কর্মচারীকে পুরস্কার দেয়া হবে এখানে দশহাজার টাকা আছে প্রতি ইভেন্ট তিনটা করে পুরষ্কার হবে আপনি সব গুছিয়ে রাখবেন আমি দশটায় আসবো আমি বল্লাম, কিন্তু  -----

তিনি বললেন, কোন কিন্তু নয় আপনি পারবেন আমি জানি

লোকটি চলে গেল আমি আর তারিক সারা রাত সে বইয়ের প্যাকেট করলাম

 সকালেই তিনি এলেন ওনাকে বিদায় দিয়ে তারিকরেও বিদায় দিলাম তাবপর বাসায় এসে জমে গেলাম ঈদ আড্ডায়

এ স্মৃতিচারণটুকু করলাম এ জন্য যে, আনন্দ বেদনা মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ পৃথিবীতে হায়াতের অধিক আপনি আমি কেউ বাঁচবো না মনের ভেতর কষ্টটা পুষে রেখে লাভ কি? কেউ কষ্ট দিলে বলবেন, ভাই, আমার কাছে কষ্ট রাখার জায়গা নেই আপনি যা দিতে চাচ্ছেন তা দয়া করে ফেরত নিয়ে যান

১৬ই নভেম্বর ২০২০ : ১০টা

যেতে হবে আরো বহু দূরঃ ২১

অনেকদিন আগের একটা ঘটনা দিয়ে শুরু করি আমি তখন প্রীতি প্রকাশনে ক্রুসেড সিরিজ নিয়ে ব্যস্ত ইতোমধ্যে ক্রুসেডের বেশ কয়েকটা খন্ড বেরিয়ে গেছে আপনারা যারা সে সিরিজ পড়েছেন তারা জানেন, প্রতি মাসে একটা খন্ড বের করার ইচ্ছা থাকলেও তা আর হয়ে উঠছিল না কখনো কখনো দুমাস তিনমাসও লেগে যেতো কিন্তু পাঠকের তর সইছিল না প্রতিটি বই কমবেশী ১৬০ পৃষ্ঠার দিনরাত লিখেও আপনাদের তৃপ্তি দিতে পারছি না তাগাদার পর তাগাদা ফোনের পর ফোন আপনাদের এই ফোনে এটেন্ড করতে গিয়ে কাজ আরো পিছিয়ে যাচ্ছিল এভাবেই মে ১৯৯৭ প্রথম খন্ড বের করি আর আগস্ট ২০০৬ শেষ খন্ড মোট ত্রিশ খন্ডে কাহিনীর ইতি টানি

তখন আটদশ খন্ড বেরিয়েছে হঠাৎ একটা ফোন এলো সালাম বিনিময়ের পর তিনি জানতে চাইলেন আমি আসাদ বিন হাফিজ কিনা আমি সম্মতি জানিয়ে জানতে চাইলাম, আপনি কে?

উত্তরে তিনি বললেন, আপনার একজন ভক্ত বললাম, কোত্থেকে বলছেন? তিনি বললেন, মানিকগঞ্জ থেকে এরপর তিনি নিজে থেকেই বিস্তারিত পরিচয় দিলেন বললেন, লোকে আমাকে অন্ধ হাফেজ বা অন্ধ পীর বলেও ডাকে ঢাকার মীরপুরে আমার একটা আস্তানা আছে, তবে থাকি মানিকগঞ্জেই মাসে এক সপ্তাহের জন্য ঢাকা যাই

আমি জানতে চাইলাম, আপনি কি জন্মান্ধ? তিনি হ্যাঁ সূচক জবাব দিলেন এবার বিস্ময়ের পালা আমার বললাম, আপনি কি সত্যি কোরানে হাফেজ? আপনি কি মুরীদ বানান? তিনি বললেন, আপনাদের দোয়া সব প্রশংসা আল্লাহর

আমার বিস্ময়ের ঘোর কাটতেই চায় না একজন মানুষ, যিনি জন্মান্ধ, তিনি কি করে পবিত্র কালামের পুরো ত্রিশ পারা মুখস্ত করলেন? একজন অন্ধ মানুষের এমন কি গুণ থাকতে পারে, যা থাকলে মানুষ তার মুরীদ হয়? লোকটাকে একনজর দেখার লোভ জাগলো আমার মনে

আমি বললাম, এবার বলেন তো কি মনে করে ফোন করলেন?

তিনি বললেন, আমি আপনার ক্রুসেডের ভক্ত ইতোমধ্যে পাঁচ নম্বর খন্ড শেষ করেছি এখন ছয় নম্বর পড়ছি যত পড়ছি ততোই অবাক হচ্ছি আপনার লেখার মুন্সিয়ানায় ইচ্ছে করছে আপনাকে দেখার আমি প্রতি মাসেই ঢাকা আসি আপনার প্রকাশনীর ঠিকানা দেখলাম মগবাজার আপনি কি মগবাজারেই থাকেন? অনুমতি দিলে আপনাকে একবার দেখতে আসবো

 আমি বললাম, প্রীতি প্রকাশনই আমার ঠিকানা আপনি আসতে চাচ্ছেন, এ তো খুব আনন্দের কথা আমারও লোভ হচ্ছে আপনাকে দেখার ঢাকায় আপনার আস্তানা কোথায়? তিনি বললেন,  মীরপুর ফার্মগেট থেকে মীরপুর দশ নম্বর যেতে হাতের বা পাশে এক কাজ করুন না, আপনি আমার দাওয়াত নেন আমার আস্তানাও দেখে গেলেন, কথাও হলো তিনি আমাকে তার পুরো ঠিকানা দিয়ে বললেন, এ মাসে ঢাকা এসে আপনাকে ফোন দেবো আপনি এলে আমি খুবই খুশী হবো সেই থেকে অন্ধ হাফেজ দেখার প্রচন্ড আগ্রহ নিয়ে সময় কাটাতে লাগলাম

একদিন সে কাঙ্খিত ফোন এলো পীর সাহেব জানালেন, তিনি ঢাকা এসেছেন সপ্তাহখানেক থাকবেন পরদিন আমি গেলাম তার আস্তানায় দুই ভক্তের সম্মিলন ঘটলো সে এক মধুময় স্মৃতি অন্তরঙ্গ পরিবেশে অপার মুগ্ধতা নিয়ে দেখলাম পরষ্পরকে আমি দেখলাম দুচোখ ভরে এক অনন্য মানুষ তিনি আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন অন্তরের চোখ মেলে

অন্ধ হাফেজের চোখের গর্ত আছে, চোখ নেই অন্ধরা চোখে কেন কালো চশমা পরে আমি আজো সে রহস্য উদ্ধার করতে পারিনি

বললাম, মোহতারাম, আমার লোভ হচ্ছে আপনার তেলাওয়াত শোনার তার  যাদুময় তেলাওয়াত আমাকে মোহাচ্ছন্ন করলো বললাম, আপনি কি করে এ অসাধ্য সাধন করলেন?

তিনি বললেন, যে আল্লাহ আপনাকে যাদুময় লেখার শক্তি দিয়েছেন, সে আল্লাহই আমাকে হাফেজ বানিয়েছেন মানুষ কোন কিছু করার ইচ্ছা করলে, এবং সে ইচ্ছা যদি হয় আন্তরিক তবে আল্লাহ তা মঞ্জুর করেন আল্লাহ কারো ইচ্ছা মঞ্জুর করলে তা সমাপ্ত করার ব্যবস্থা তিনিই করে দেন আপনার কাজ শুধু প্রাণ খুলে আল্লাহর কাছে চাওয়া আপনি যদি চাইতে পারেন আল্লাহ আপনাকে নিরাশ করবে না আল্লাহ পারেন না এমন কোন কাজ নেই তিনি আপনার আমার কল্পনার চাইতে ক্ষমতাবান, মহান

তিনি কথা বলছিলেন, আর আমি তন্ময় হয়ে শুনছিলাম

এই অন্ধ হাফেজের আল্লাহভক্তি আমার মনে নতুন প্রেরণা সৃষ্টি করলো বুঝলাম, মানুষের ইচ্ছা ও আকাঙ্খা এক অপরিমেয় শক্তির নাম সে চাওয়ায় থাকতে হবে পরিপূর্ণ আবেগ ও ভালবাসা আল্লাহ যদি সে চাওয়া মঞ্জুর করেন তবে তা পূরণ হবেই

তিনি আমার লেখার বিষয় জানতে চাইলেন আমি বললাম, আমি স্কুলে থাকতে স্কুল লাইব্রেরী থেকে নসীম হিজাযীর মরণজয়ী নামে একটা উপন্যাস পড়ি বইটি অনুবাদ করেছিলেন সৈয়দ আবদুল মান্নান বইটি পড়ে আমি বিমোহিত হয়ে যাই খুঁজতে থাকি নসীম হিজাযীর আর কি বই আছে ওখানেই পাই ভেঙ্গে গেলো তলোয়ার নামে আরেকটি বই এ দুটি বই আমাকে নসীম হিজাযীর ভক্ত বানিয়ে ফেলে

এখানে একটি কথা বলে নেয়া ভাল, আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় মাস্টার্স করার কারণে বাংলা কিছুটা জানলেও পৃথিবীর আর কোন ভাষাই তেমনটা পারি না না ইংরেজী, না উর্দু না আরবী, না ফার্সী এসময় আমি হাতে কিছু নসীম হিজাযীর উর্দু বই পাই বইগুলো উল্টেপাল্টে দেখি আর ভাবি, ইস, যদি পড়তে পারতাম কিন্তু ওই পর্যন্তই বইগুলো পেয়ে আমার তৃষ্ণা আরো বেড়ে যায় বইগুলোতে কি আছে জানার আগ্রহ প্রচন্ড রকম বেড়ে গেলে আল্লাহই ব্যাবস্থা করে দেন

আমি তখন মাস্টার্স পাস করা সদ্য বিবাহিত যুবক শ্বশুরের বাসা মীরপুর চৌদ্দ নম্বর স্টাফ কোয়ার্টারে শ্বশুরবাড়ির আদরযত্ন বলে কথা ওখানেই প্রচুর সময় কাটাই পাশের মসজিদের ইমাম সাহেবের নাম আবদুল হক সদ্য মাদ্রাসা ফারেগ আলেম বিয়েশাদী করেননি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ানো ছাড়া তেমন কাজ নেই থাকেন মসজিদ সংলগ্ন হুজরাখানায়

নামাজ পড়তে গিয়ে তরুণ এ ইমামের সাথে খাতির হয়ে যায় হুজরাখানায় বসে আড্ডা মারি সম্পর্কটা বন্ধুত্বে রূপ নেয় বুদ্ধিটা তখনই মাথায় আসে বলি, হক ভাই, আপনি উর্দু কেমন পারেন? তিনি বললেন, পারি মোটামুটি কেন? আমি বললাম, আমিতো উর্দু পারি না আমার কাছে কিছু উর্দু উপন্যাস আছে আপনি যদি পড়ে আমাদের শোনান তবে খুব ভাল হয় তিনি বইগুলো দেখতে চাইলেন দেখালাম তিনি সেখান থেকে শাহীন নামের একটা উপন্যাস নিয়ে কয়েক পৃষ্ঠা দেখলেন বললেন, বাহ, মজার তো

এরপর তিনি একটু একটু পড়েন আর আমি ও আরো কিছু যুবক বসে বসে শুনি এতে আমরা খুবই মজা পাচ্ছিলাম একসময় বলি, হক ভাই, আপনি এটি অনুবাদ করে ফেলুন তিনি একটু চিন্তিত হলেন বললেন, কি যে বলেন আসাদ ভাই অনুবাদ! আমি!

বললাম, কেন নয় আপনি শুধু মূল ভাবটা বাংলায় এনে দেন, বাংলাটা আমি ঠিক করে দেবো

সেই শুরু তিনি আক্ষরিক বাংলাটা করেন আর আমি সম্পাদনা করে উপন্যাসের গতিময়তা সৃষ্টি করি এভাবেই চললো আমাদের ভাষান্তর খেলা অনুবাদ ও সম্পাদনা শেষ হলে পড়ে দেখলাম ভালোই হয়েছে বইয়ের নাম করলাম সীমান্ত ঈগল  হকভাই বললেন, আপনি সীমান্ত পেলেন কই? শাহীন অর্থ তো ঈগল

আমি বললাম, সাহিত্য শুধু শাব্দিক অনুবাদে সীমাবদ্ধ রাখা যায় না সাহিত্য অনুবাদে শব্দের সাথে ভাবের দ্যোতনাও সৃষ্টি করতে হয় এখানে শাহিন শব্দটি লেখক পাখি অর্থে ব্যবহার করেননি, বরং সীমান্ত বিপ্লবীর ক্ষিপ্রতাকে শাহিনের সাথে প্রতিকায়িত করা হয়েছে শুধু শাহীন বা ঈগল দিলে মনে হবে এটা কোন পাখির গল্প এভাবে অনেক জায়গায়ই অনুবাদকের সাথে নতুন উপমা, উৎপ্রেক্ষা যুক্ত করে ভাষায় একটি সাবলীল গতি আনা হয় হক ভাই বললেন, এটাতো যৌথ অনুবাদ হয়ে গেল অনুবাদক হিসাবে দুজনেরই নাম দিন আমি বললাম, না, ওটা ফেয়ার হবে না অনুবাদ আপনি করেছেন, তাই অনুবাদক হিসাবে আপনার নামই যাবে তিনি বললেন, কিন্তু কাজটাতো আমরা দুজন মিলে করেছি একজনের নাম যাবে আরেকজনের নাম যাবে না, এটা হতে পারে না অবশেষে ঠিক হলো, অনুবাদে উনার নাম যাবে আর সম্পাদনায় যাবে আমার নাম, যা সত্যের খুব কাছাকাছি হয়

এভাবেই উর্দু না জেনেও নসীম হিজাযীর বেশকিছু উর্দু উপন্যাসের অনুবাদের সম্পাদনায় যুক্ত হয়ে গেল আমার নাম যখন দেখলাম পাঠকরা এ সম্পাদনা আগ্রহের সাথে গ্রহণ করেছে তখন আমার সাহস ও উদ্দীপনা আরো বেড়ে গেল আমি আর হক ভাই মিলে আন্ধেরি রাত কা মুসাফির বাংলায় আনলাম আঁধার রাতের মুসাফির নামে কাফেলায়ে হেজায করলাম হেজাযের কাফেলা কায়সার আওর কিসরা রয়ে গেল কায়সার ও কিসরা নামে সফেদ জাযিরার অনুবাদ করলাম কিং সাযমনের রাজত্ব ইউসুফ বিন তাশফীনের নাম রয়ে গেল অপরিবর্তিত সিলেটের গৌরগোবিন্দের পতনের কাহিনীকে বদরে আলম সাহেব করলেন তেত্রিশ কোটি দেবতার দেশে আর আমরা করলাম আলোর কুসুম পাকিস্তান সে দিয়ারে হারাম তককে আমরা করলাম ইরান তুরান কাবার পথে

অন্ধ হাফেজ বললেন, একেই বলে আল্লাহ কা ফয়সালা এ দেশে মাদ্রাসা ও উর্দু জানেওয়ালা আলেমের অভাব নেই কিন্তু আল্লাহ উর্দু সাহিত্যের সেরা সম্ভারগুলো বাংলায় আনালেন এমন একজনকে দিয়ে যিনি নিজে মুখে অকপটে স্বীকার করলেন, তিনি উর্দু জানেন না এটা কি আল্লাহর মোজেযা নয়?

আমি বললাম, কোন আলেম করলেই কি ভাল হতো না

পীর সাহেব বললেন, ভালমন্দ বিচার করার আপনি আমি কে? কোনটা ভাল আর কোনটা মন্দ এটাতো কেবল তিনিই জানেন, যিনি এ জগতের মালিক

আপনার বিষয়টিই ধরুন, আপনি মনে করছেন কোন আলেম বা উর্দু অভিজ্ঞ লোক এ কাজটি  করলে ভাল হতো আপনি জানেন, প্রতিটি ভাষারই আলাদা গতি আছে ক্রিয়াপদ ব্যবহারের বিশেষ প্যাটার্ন আছেঅনুবাদ মানেই মূলকে অনুসরণ করা কিন্তু সৃজনশীল অনুবাদে যে ভাষায় অনূদিত হচ্ছে সে ভাষার গতি ও ক্রিয়াপদের সাবলীল ব্যবহার কাম্য যিনি দুটি ভাষাই জানেন, তাকে সব সময় দুটি ভাষার গতিই আকর্ষণ করবে ফলে তার অনুবাদে জটিলতার একটা স্কোপ থাকে কিন্তু আপনার ক্ষেত্রে সে আশঙ্কা নেই দ্বিতীয়ত, ভাষার বিবর্তনও একটা প্রভাব ফেলতে পারে অনুবাদে এক সময় ইনকিলাব খুবই চালু একটি শব্দ ছিল শব্দটা উর্দু ও হিন্দিতে এখনো বহুল ব্যবহৃত এমনকি বামপন্থীদেরও শব্দটি অতি প্রিয় যারা উর্দু জানেন তাদের কাছে শব্দটি এখনো যথেষ্ট ওজনদার কিন্তু বাংলায় এ শব্দটির ব্যবহার অনেক কমে গেছে তার বদলে ব্যবহৃত হচ্ছে বিপ্লব যিনি উর্দু জানেন না, তার কাছে   ইনকিলাবের চেয়ে বিপ্লব শব্দটি বেশী প্রিয় হবে পক্ষান্তরে উর্দু ও হিন্দি বোদ্ধাদের কাছে ইনকিলাবটিই বেশী পছন্দের থাকার কথা বাংলা ভাষায় বিপ্লবী কাফেলা যতটা সাবলীল ইনকিলাবী কাফেলা ততোটা যুৎসই নয় ফলে, যিনি উর্দু জানেন না, তার লেখায় শব্দ প্রেম নয়, ভাষার গতিপ্রেম অধিক গুরুত্ব পাবে ফলে উর্দু না জানাটা আপনার জন্য সমস্যা নয়, সম্ভাবনা তৈরী করবে এদিকটি কি আপনি ভেবে দেখেছেন? আমি পীর সাহেবের কথায় আবারো চমৎকৃত হলাম কী সুন্দর কথাভালমন্দের কি অপূর্ব বিশ্লেষণ

তিনি বললেন, আল্লাহর ফায়সালাকে নেয়ামত মনে করুন আর সে নেয়ামতের শোকরিয়া আদায় করুন এতেই আপনার জন্য রয়েছে মঙ্গল

তারপর তিনি জানতে চাইলেন ক্রুসেড প্রসংগে সে কাহিনী  না হয় আরেকদিন বলবো

২৬শে জানুয়ারী ২০২১

No comments

Powered by Blogger.