গাজীপুরের কালিগঞ্জে এক চক্কর : আসাদ বিন হাফিজ

স্কুল মাঠে শৈশবের সতীর্থদের সাথে
গাজীপুরের কালিগঞ্জে এক চক্কর : 
আসাদ বিন হাফিজ

বহুকাল বাড়ি যাই না। স্ট্রোক, বাইপাস, নানা কারণে। এখন অনেকটা সুস্থ। হঠাৎ করেই সুযোগটা এলো। পেনভিশন টিভি আমাকে নিয়ে কালিগঞ্জ বেড়াবার প্রস্তাব দিল। রাজি হয়ে গেলাম। ২ অক্টোবর ২০২১ সকালে তারা এসে আমার বাসায় হাজির। 

চড়ে বসলাম গাড়িতে। টঙ্গী গিয়ে মনে হলো, এ কোন দেশে এলাম? পরিচিত টঙ্গী অচেনা হয়ে গেছে। চারদিকে খোঁড়াখুঁড়ি। বিশাল কর্মযজ্ঞ। তিনশ ফিটের রাস্তারও নাকি একই অবস্থা। 

টঙ্গী অতিক্রম করে সকালের ফুরফুরে হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে সকাল নটার দিকে কালিগঞ্জের কাপাসিয়া রোডের মোড়ে পৌঁছলাম। সবাই মিলে নাস্তা করলাম এক রেস্টুরেন্টে।

ফোনে কথা হলো কালিগঞ্জের সাংবাদিক জিয়াদ হোসেনের সাথে। তার বাড়ি কাছেই, দুর্বাটি। গল্প চলছিল। এ সময় কাছে কোথায় যেন একটা মারাত্মক এক্সিডেন্টের খবর পেয়ে সাংবাদিক ছুটে গেল সেদিকে। আমরা আবার পথে নামলাম।

পেনভিশনের টীম ক্যামেরা রেডি করে প্রথমেই গেল আড়িখোলা রেলস্টেশন। পুরাতন স্টেশন এখনো চালু আছে। নতুন করে বাড়ানো হয়েছে কলেবর। শৈশবে ঢাকা আসতে হলে দশ মাইল পায়ে হেঁটে এখানে আসতে হতো। এখান থেকেও রেলে চড়তাম। তবে বেশিরভাগ সময় নৌকা বা লঞ্চে চড়ে চলে যেতাম ঘোড়াশাল ফ্লাগ স্টেশনে। 

সে আমলে নদীপথ ছাড়া যোগাযোগের মাধ্যম বলতে ছিল এই ট্রেন। সড়কপথ তখনও সেভাবে গড়ে ওঠেনি। 

তারা আমার সে স্মৃতিময় আড়িখোলাকে ক্যামেরা বন্দী করলো। মজার ব্যাপার হলো, তখনই একটা ট্রেন এলো। তারা বললো, আপনি কেমন করে গাড়িতে চড়তেন? আমি ট্রেনে ওঠে ও নেমে তাদের দেখালাম।

আড়িখোলার পাশেই কালিগঞ্জ শ্রমিক কলেজ। আমি কখনো এ কলেজে পড়িনি। তবে ছাত্রাবস্থায় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ভিপি পদে দাঁড়ানো শামসুল হকের নির্বাচনী প্রচারণায় যেতাম। সে এখন এডভোকেট। চেম্বার গাজীপুর। টীম সেখানকার ছবিও ধারণ করলো।

কালিগঞ্জ পাইলট হাইস্কুলে ক্লাশ ফাইভের বৃত্তি পরীক্ষার সীট পড়েছিল। তাদের বললাম সে কথা।তারা বললো, আমরা এটারও ছবি নেবো। আমি নামলাম না সময় বাঁচানোর জন্য। কিন্তু তাতে তেমন কোন লাভ হলো না। স্কুলের সাথেই শীতলক্ষা নদী, আর নদীর পাড়ে ফুটে আছে অজস্র কাশফুল। তারা সে ফুলের প্রেমে পড়ে গেল।

আমার সাথে গিয়েছিল আমার ভাতিজা কথা সাহিত্যিক সালেহ মাহমুদ। বাংলা একাডেমীর তরুণ লেখক প্রকল্পের প্রথম দিকের ছাত্র ছিল মাহমুদ। এসময় তার একটা উপন্যাস যুগলবন্দী নামে ধারাবাহিকভাবে বের হচ্ছে অনলাইন পত্রিকা মোলাকাতে। সে ফোনে তাগাদা দিয়ে ওদেরকে ফিরিয়ে আনলো। সামনে পড়লো কালিগঞ্জ ধানা। তারা তারও একটা ছবি নিল। 

আমি কালিগঞ্জ এসেছি শুনে থানা গেটে হাজির হয়ে গেল আমার এক ক্ষুদে নাতি। নাম মেহের আফরোজ। থানা গেটের উল্টো পাশে তাদের বাসা। সে বাসায় নেয়ার জন্য আবদার ধরলো। ওর বাবাকে বুঝিয়ে কোন রকমে ছাড়া পেলাম। ও আমাকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানিয়ে একটা বই উপহার দিয়ে বললো, দাদু, কালিগঞ্জবাসীর পক্ষ থেকে।

আমরা এবার চললাম ঘোড়াশালের উদ্দেশ্যে। 

ঘোড়াশাল ব্রীজের পুব পাশে ঘোড়াশাল রেলস্টেশন। আমরা আছি পশ্চিম তীরে। টীম ওখানে যেতে চাইলেও সময়ের দিক বিবেচনা করে গেলাম না। ইচ্ছে করলে শহীদ ময়েজউদ্দিন ব্রীজ পার হয়ে ওখানে যাওয়া যেতো। এই ঘোড়াশালই ছিল বাইরের সাথে আমাদের যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম।

আমরা কখনো সাওরাইদ বাজার থেকে লঞ্চে বা জামালপুর বাজার থেকে নৌকায় ঘোড়ালাল এসে রেলে চড়তাম। টীম ঘোড়াশাল ব্রীজের কয়েকটা ফুটেজ নিয়ে নিল।

শীতলক্ষ্যা নদীর ওপর বিশাল রেলসেতু। নৌকায় বসে প্রথম যখন আমার চাচী এ ব্রিজ দেখে তখন বিস্ময়ে বলে উঠিছিল, ওরে, এ পুল বানাতে কম করে হলেও চল্লিশ টাকা লেগেছে। তার কাছে তখন চল্লিশ টাকাই কোটি টাকা। কৈশোরে আমি বহুবার এ ব্রীজ হেঁটে পার হয়েছি।

আমি বললাম, করোনাকালীন স্কুল। জোহরের আগেই ছুটি হয়ে যেতে পারে। চলো আগে স্কুলে যাই। আমার স্মৃতিবিজড়িত সাওরাইদ স্কুল।


সাওরাইদ প্রাইমারী স্কুলের বর্তমান প্রধান শিক্ষিকা ও শিক্ষকদের সাথে কবি

আমরা চললাম সাওরাইদ স্কুলের দিকে। আমার স্মৃতির সরোবরে ঢেউ উঠলো। তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছি এখানে। নদীর পাড়ে স্নিগ্ধ মনোরম পরিবেশ। পাশেই সাওরাইদ বাজার। বাজারের পশ্চিম মাথায় মসজিদ। উত্তরে সঞ্জিত ও ভূষণদের বাড়ি। স্কুলের পাশ দিয়ে কামিনী ফুলের বাগান। দক্ষিণে নদী। আমরা মাঠে খেলছি। আহ, কী মধুর স্মৃতি।

খবর নিয়ে জানলাম অলি পন্ডিত, আদ্দিস স্যার, মানে আমাদের কোন স্যার এখন বেঁচে নেই। আদ্দিস স্যারের ছেলে এখন এ প্রাইমারীর শিক্ষক। গাড়ী স্কুলের মাঠে গিয়ে থামলো। বন্ধু সোহরাব না থাকলে বিপদেই পড়ে যেতাম। চল্লিশ পঞ্চাশ বছর আগের যে চিত্র মনে খোদাই করা ছিল সেই গ্রাম, হাট, কিছুই আর আগের মত নেই। বাজার কলেবরে অনেক বড় হয়ে গেছে। মাটির ছোট মসজিদ এখন বিরাট ইমারত। আমাদের টিন দেয়া স্কুলঘর এখন বিল্ডিং। 

টিচারদের কেউ কেউ আমাকে চিনলো। আমাদেরকে নিয়ে গেল টিচার রুমে। অন্যরা হা করে তাকিয়ে রইলো। যারা চিনতো তারা সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা মহাখুশী। তিনি তড়িঘড়ি অভ্যর্থনার আযোজন করলেন। আমাকে বললেন, স্যার, আগে জানাবেন না? এখন তাৎক্ষণিক কী করি বলুনতো?

তিনি দ্রুত নাস্তা আনালেন। ফুলের তোড়ার ব্যবস্থা করলেন। ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকদের সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে বললেন, স্যার, আপনাকে আরেকবার  ঢুকতে হবে।

কী আর করা। আবার ঢুকতে হলো। হাততালি ও শ্লোগান দিয়ে আনুষ্ঠানিক বরণ করা হলো আমাকে। ভাবলাম, হায়রে নিজের স্কুল। এখানেও আনুষ্ঠানিকতা। মনে তখন স্মৃতির ঝড়। এ স্কুলেরই এক পিচ্ছি ছাত্র ছিলাম আমি। আজকে যারা হাততালি দিচ্ছে তাদেরই মত।

 শিক্ষকমন্ডলীর পক্ষ থেকে ফুলের তোড়া তুলে দিলেন প্রধান শিক্ষিকা। এরপর ফুল দিল দুটো শিশু। অল্প সময়ের মধ্যেই এক আনন্দ সরোবরে ডুবে গেলাম আমরা। প্রধান শিক্ষিকাসহ শিক্ষকরা বক্তৃতা করলেন। আমাকেও কিছু বলতে হলো।

ইতিমধ্যে খবর ছড়িয়ে গেল এলাকায়। ছুটে এলো আমার শৈশবের বন্ধুরা। বক্তব্য রাখলেন বন্ধু হাছেন আলী, ভূষণ মাষ্টার, সোহরাব হোসেন।

আমরা সবাই সকলকে অবাক হয়ে দেখছি। চোখেমুখে চিকচিক আনন্দ।

হাছেন আলী এক গরীব মাঝির ছেলে। কিন্তু অসম্ভব ব্রিলিয়ান্ট। তাকে ভালোও বাসতাম আবার তাকে হারানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টাও করতাম। ক্লাশের সবচে ভাল ছাত্র হিসাবে পরিচিত চার পাঁচজন জোট বাঁধলাম। কিন্তু থ্রি, ফোর, ফাইভ কোন ক্লাশেই তার ফাস্ট হওয়া থেকে আটকাতে পারলাম না। আমি, সঞ্জিত, ভূষণ, ফখরুল ঘুরেফিরে আমরা দুই থেকে পাঁচের মধ্যে গড়াগড়ি খেতাম।

অতি কষ্টে জীবন কেটেছে তার। সে আমাকে বলছিল, তোমার আব্বা টাকা না দিলে আমার বৃত্তি পরীক্ষাই দেয়া হতো না। আমরা যখন এসি রুমের হাওয়া খেতে খেতে গল্প করছি, সে তখন কাঠফাটা রোদে কাজ করছে মাঠে।

 কিন্তু সবদিন সমান যায় না কারো। তার দুই ছেলে এখন বিদেশে। মেয়ে উচ্চশিক্ষিত। ছেলেদের পাঠানো টাকায় সে এখন বিল্ডিং তোলার চেষ্টা করছে।

যে ভূষণের কথা বললাম, সে এখন সাওরাইদ হাইস্কুলে  মাস্টারী করে। তার হাতের লেখা ছিল দেখার মত। সে ছিল আমাদের ক্ষুদে পন্ডিত। এখন আর ক্ষুদে নেই। এলাকায় এখন সে ভূষণ মাস্টার হিসাবেই পরিচিত। খবর পেয়ে সে চলে এলো প্রাইমারী স্কুলের অফিস কক্ষে।

আমরা আমাদের কাজ করছি, পেনভিশন করছে তাদের কাজ। এর ওর সাক্ষাৎকার নিচ্ছে। এই ফাঁকে নদীর পাড়ে সবুজ ঘাসের জাজিমে বসে গেলাম বন্ধুদের সাথে আড্ডার মেলায়।

কিন্তু এ আড্ডা দ্রুতই শেষ হয়ে গেল। কারণ মসজিদ থেকে জোহরের আযান ভেসে এলো। আমরা বন্ধুরা শিক্ষকদের নিয় মসজিদে চলে গেলাম। ভূষণ মাষ্টার বিদায নিয়ে গিয়ে ঢুকলো ক্লাশে।

টীমলিডার বলেছিল, কোথাও দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করতে। আমি বললাম, না, যেখানে রাত সেখানেই কাত। এখন গ্রামবাংলা আর আগের মত নেই। সব জায়গায় হোটেল আছে। কোথাও খেয়ে নেযা যাবে।

আমরা নামাজ পড়ে যখন খেতে গেলাম তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল। এতগুলো লোকের খাবার কারো কাছেই নেই। বন্ধুরা তাদের বাসায় নিতে চাইল। একজন দুজন হলে কথা ছিল। কিন্তু দশ বারো জনের একটা টীম হুট করে কারো বাসায় যাওয়া মোটেই সমীচিন নয়।

আমি বললাম, নো টেনশন। আমরা দুই হোটেলে ভাগ করে বসে গেলাম। টাটকা সবজি, ডাল, ভাত, বিভিন্ন রকমের ভর্তা, ছোটমাছ দিয়ে মিষ্টিলাউ, ম্যানেজারের পক্ষ থেকে ফ্রি আলু ও শুটকির ভর্তা, বেশ ভাল জমলো খাবার। দু একজন মাছ নিলেও গোস্তের ধারেকাছেও গেল না কেউ। 

এ বাজারে দোকানদারী করছে এমন অনেকেই আমার ক্লাশমেট ছিল। বিশেষ করে বাতেন মুন্সী ও মনোরঞ্জন ধরের ছিল পারিবারিক ব্যাবসা। কিন্তু না, প্রচন্ড ইচ্ছে থাকলেও তাদের সাথে দেখা না করেই পথে নামতে হল।

কারণ আড্ডার সময় নেই। যেতে হবে বাড়ি। যেতে হবে স্মৃতিবিজড়িত বড়গাঁও। মক্তর, প্রাইমারী স্কুল, ছাড়াও যেতে হবে ইয়াতীমখানায়। দীর্ঘদিন এর সভাপতি ছিলাম আমি। যেতে হবে সেই বাজারে, যেখানে ছিল আমাদের নিত্য যাতায়াত। সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ির পথ ধরলাম।

আমার বাড়ি এখান থেকে মাইল দেড়েক পশ্চিমে বড়গাঁও গ্রাম। রাস্তা মনে হয় কার্পেট বিছানো। পিচঢালা পাকা  সড়ক। আমি যখন এ স্কুলে পড়তাম তখন এর কিছুই ছিল না। কাঁচা রাস্তা দিয়ে হেঁটে স্কুলে যেতাম।  বৃষ্টিতে ভিজে যখন বাড়ি ফিরতাম তখন চেহারা হতো দেখার মত। পাকা সড়ক মাড়িয়ে পাকা ব্রিজ দিয়ে ধলি বিল পার হলাম।

এই বিলে ছিল আমাদের প্রচুর জমি। প্রথমে এটা ছিল বাঁশের সাঁকো। তারপর হলো কাঠের ব্রিজ। ব্রিজ থেকে লাফিয়ে বর্ষার বিলে কি এখনো শিশুরা হুটোপুটি করে? গামছা দিয়ে পুটি মাছের ঝাঁক তাড়িয়ে বেড়ায়? 

আব্বা আমাদের একটা ক্ষেতের মাটি দিয়ে পাড় বেঁধে জমিটাকে সবচে নিচু জমি বানিয়ে ফেলে। ফলে সারা বিলের মাছ এসে এ ক্ষেতে জমা হতো। মাছের ওপর মাছ, ক্ষেতের জমি দেখা যেতো না। হাতে না ধরে সে মাছ বাটি দিয়ে তুলতে হতো। ডেক ভরে গেলে সে ডেক নিয়ে উঠোনে ঢেলে দেয়া হতো। মা বোনেরা সেখান থেকে জিয়ল মাছ বেঁছে মাটির বিশাল মটকাতে রেখে দিতো। শিং, মাগুর, কৈ, শোল কত কত মাছ।

বিল পার হলেই আমাদের বাড়ি। বাড়ির পাশে গজারীর বন। বাড়িতে নানা ফলের বাগান। পেয়ারা, আতা, ডালিম, বেল, আনারস আরো কত ফল। ছিল লিচুর বাগান, আমের বাগান, কাঠাল বাগান। ধনপুরের যে গজারীর বনে এখন মানুষ সখে সময় কাটাতে যায়, তার লেজ এসে মিশেছে আমাদের বাড়ির পাশে।

টীমকে বাড়ি দেখালাম। বললাম এর সাম্প্রতিক হালের কথা। এ বাড়ি একদিন বানিয়েছিল আব্বা। তিনি ছিলেন এলাকার গন্যমান্য ব্যক্তি। আমরা দেখেছি তখনকার জৌলুস। আব্বা সম্পন্ন গৃহস্ত। কিন্তু আমাদের সব ভাইকে বানালেন উচ্চ শিক্ষিত। ফলে আমরা হয়ে গেলাম সাহেব। যতদিন মা বাবা ছিলেন ততদিন ঠিকই বাড়ি আসা হতো। উনারা চলে গেলে আগ্রহে ভাটা পড়লো। বছরে দু একবার কবর জিয়ারতের জন্য আসা হয়। কখনো লিচু কাঠালের জন্য। থাকা হয় না। গাড়ি করে আসি, দিনে দিনে চলে যাই।

সেই আম্মুর আমল থেকেই বাড়িতে মার জন্য ছিল কাজের মানুষ। আব্বু বাড়ির কাজের জন্য বছর চুক্তিতে লোক রাখতেন। মার কাজের লোক হিসাবে একসময় থাকতো খালাতো বোন। ওর বিয়ে হয়ে গেলে একটি কটি মেয়েকে বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। নাম শেফালী।  বয়স আমার কাছাকাছি হলেও আমাকে ভাই বলে ডাকতো, আমিও ওকে দেখতাম ছোট বোনের মত।  

একদিন আমাদের তিন ভাইকে ডেকে মা বললেন, তোদের তো কোন বোন নাই। শেফালি তোদের বোনের মতই। কিন্তু শরিয়ত মতে সে তোদের কোন সম্পত্তির অংশীদার হবে না। ও এতীম। আমি ওর মায়ের মত। আমি চাই আমি বেঁচে থাকতে তোরা ওকে থাকার মত ভিটা ও ফসল করার জন্য একটু জমি লেখে দিবি। 

না, এটা মার নির্দেশ ছিল না, ছিল এক ধরনের আকুতি। আমরা মার সে আকুতি ফেলতে পারিনি। তাকে একটু জমি ও একটু ভিটা লেখে দিলাম।

মা বাবা মারা যাওয়ার পর পুরো বাড়িই তার হয়ে গেল। আমরা তিন ভাইয়ের কেউ বাড়িতে থাকি না। সে আমাদের পক্ষ থেকে আমাদের বাড়ি পাহারা দেয়। আমরা তার জন্য একজন ঘরজামাই আনলাম। স্বামী সন্তান নিয়ে তার দিন ভালই যাচ্ছিল। ছেলেরা বড় হলে তাদের জন্যও বউ আনা হলো।

একদিন সে এসে বলল, ভাই, সারাটা জীবনতো আমাকে টানলেন। এখন বউ এসেছে, নাতিপুতি আসবে, ভাবছি বড় ছেলেকে বিদেশ পাঠিয়ে বলি, এবার নিজের পায়ে দাঁড়া। কিন্তু কিভাবে পাঠাবো? টাকা পাবো কই?

ভেবে দেখলাম, যদি নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে তবে আমাদেরই তো বোঝা কমবে। বললাম, দেখ, পারলে পাঠানোর ব্যবস্থা  কর। অবশেষে একদিন তাকে মালয়েশিয়া পাঠিয়ে দেয়া হলো। টাকার ব্যবস্থা করতে হলো আমাকেই।

দিন ফিরে গেল তাদের। সে তার ছোট ভাইটাকেও নিয়ে গেল। একদিন তাকে যে ভিটা দিয়েছিলাম সেখানে ঘর তুলে নাতি নাতনি নিয়ে নিজের সংসার গড়ে তুললো শেফালী। 

আমাদের পুরনো ঘরে পড়লো তালা। ভাতিজারা এলেও ওর বাসাতেই খায় আর মুঠ ভরে বকশিশ দেয়। আমি টীমকে শেফালীর ঘর দেখিয়ে দিলে ওরা ওর সাক্ষাৎকার নিল। 

আমি তালা খুলে নিজের ঘরে ঢুকলাম না। মন চাইলো না। ছাড়াবাড়ির যা অবস্থা হয়। ধুলোমাখা ঘরে কোথায় গিয়ে বসবো?

হাতে সময় ছিল কম। ইচ্ছে ছিল বিল দেখাতে নিয়ে যাবো। বলবো শাপলা তোলা ও পুটিমাছ ধরার কাহিনী। সময় পেলাম না। পারলাম না গজারীর বনে নিয়ে যেতে। পারলাম না আরো অনেক কিছুই দেখাতে।

আছরের আজান হয়ে গেছে। একটু পরেই সূর্য ডুববে। ওদেরকে দেখালাম বাপ চাচাদের বানানো মক্তব ও মসজিদ। বাড়ির ভিটার সাথে লাগোয়া  এ মসজিদ মাটি দিয়ে গড়ে তুলেছিলেন তারা। পরে, বড় ভাই অধ্যাপক ইউসুফ আলী কুয়েতী ফিনান্সে মসজিদটিকে পাকা ও বড় করেন।

ওদেরকে দেখালাম মসজিদের পাশেই বড় ভাইয়ের কবর, মা বাবার কবর, ভাবীর কবর, মানে আমাদের পারিবারিক গোরস্থান।

এখনো দেখানো হয়নি আমার লেখাপড়ার হাতেখড়ি গ্রামের সেই প্রাইমারী স্কুল, গ্রামের হাট, বড় ভাইয়ের গড়া বড়গাঁও বায়তুল উলুম আলিম মাদ্রাসা, ইয়াতীমখানা, মসজিদ। বাড়িতে সময় নষ্ট না করে ছুটলাম সেদিকে। 

বাজারের মসজিদে আসরের নামাজ পড়লাম। ওখানেই দেখা হয়ে গেল ইয়াতীমখানা কমিটির সদস্যদের সাথে। আমাকে হঠাৎ অযাচিতভাবে পেয়ে কমিটির সেক্রেটারী আমাকে কমিটির মিটিংয়ে দাওয়াত দিল। গেলাম। 

বড়ভাই মারা যাওয়ার পর দীর্ঘদিন এ কমিটির সভাপতি ছিলাম আমি। এখন সভাপতি এলাকার সাবেক মেম্বার আমার ছোটবেলার বন্ধু ও মামাতো ভাই আবদুল হেকিম (হেকিম মেম্বার), সেক্রটারী আমারই ভাতিজা মাজেদুল ইসলাম। গ্রামের প্রায় সব গন্যমান্য ব্যক্তি এ কমিটির সদস্য।

মাজেদুল অকপটে বললো, চাচা কবি আসাদ বিন হাফিজ এ কমিটির সভাপতির দায়িত্ব যেভাবে হস্তান্তর করেছিলেন তা ছিল অসাধারণ ঘটনা। তিনি দলমত নির্বিশেষে গ্রামের সকল মুরুব্বীকে নিয়ে বসে সবাইকে কনভিন্স করে এ কমিটি গঠন করে দিয়েছিলেন। তার গড়ে দেয়া কমিটি আজো সম্মানের সাথে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে। তিনি আমাদের গর্ব, দেশের গর্ব। আরো বক্তব্য রাখেন মাওলানা আমিনুল ইসলাম। সভাপতি ঢাকা থাকায় তার সাথে দেখা হলো না।

আমি সবাইকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে চা খেয়ে বিদায় নিলাম। মজার ব্যাপার হচ্ছে, প্রাইমারী স্কুল, ইয়াতীমখানা, আলিম মাদ্রাসা সব একই ক্যাম্পাসে। আমি টীমকে দেখিয়ে দিলাম কোনটা কি। দেখালাম এর পাশ দিয়ে গড়ে ওঠা আমাদের প্রিয় গ্রাম্য বাজার।

এই বাজার ও ক্যাম্পাসের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকা বিশাল বকুল গাছটি দেখে সত্যি আমি অবাক হলাম। গাছটির এখন যে অবয়ব, আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে আমরা যখন এ প্রাইমারীতে পড়তাম তখন এর অবয়ব আরো অনেক বড় ও ঝাঁকড়া ছিল। গাছটির ডালপালা বার বার বিক্রি করে ফেলা হলেও সে পরাজয় মানেনি, আবার মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। একদিন এ বকুল ফুল কুড়াতাম আমরা আর এখন এ গাছের ফুল কুড়ায় আমাদের নাতিপুতিরা।

মাগরিবের সময় প্রায় হয়ে এসেছিল, বাজারে কিছুক্ষণ আড্ডা হলো পুরাতন বন্ধু এলাকার লোকের সাথে। মসজিদে নামাজ পড়ে ফিরে চললাম  ঢাকা।

দোলান বাজার ও ফুলদী পার হয়েে আবারও কাপসিয়া রোডের মোড়। চা কফি পান করে তিনশ ফিটের রাস্তা ধরে বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত দশটা।

ধন্যবাদ পেনভিশনের প্রিয় দেলোয়ার ভাই, মাহবুব মুকুল ভাই ও পেনভিশনের সুদক্ষ ও আন্তরিক টীম।

১৩/১০/২১। বাদ মাগরিব।

ছবিঃ ২/১০/২১ সাওরাইদ প্রাইমারী স্কুল।

No comments

Powered by Blogger.