একটি সূর্যমুখীর গল্পঃ আসাদ বিন হাফিজ


 
একটি সূর্যমুখীর গল্পঃ আসাদ বিন হাফিজ


খাটের পাশের জানালাটা খুললেই

হুড়মুড় করে একসাথে ঢুকে পড়ে

ভোরের বাতাস ও চনমনে আলো।

সেদিন ফজর পড়ে জানালাটা খুললাম। ভোরের হাওয়া ও আলোরা এসে জড়িয়ে ধরলো আমায়। জানালা দিয়ে তাকালাম বাইরে। জানালার পাশে কোত্থেকে যেন

একটা সূর্যমুখী চারা এসে বসত গেড়েছে। 

প্রতিদিনই চারাটির দিকে চোখ চলে যায়।

অল্প কদিনেই কি চমৎকার রেড়ে উঠেছে।

দেখতে দেখতে গাছে ফুল ধরলো।

চোখ তুলে তাকালো ফুলশিশু। বললাম, ভয় নেই। আমি তোর শৈশবের খেলার সাথী। ও খিলখিল করে হাসে।

একদিন বললাম, তুই সারাক্ষণ সূর্যের দিকে তাকিয়ে থাকিস কেনো? 

সুর্যমুখী হাসে। বলে, আলো দেখি। আলো দেখাটা খুব জরুরী। আলো চলে গেলেই অন্ধকার এসে গ্রাস করে আমাদের। অন্ধকারের সাথে আসে শয়তান, আসে পাপ। একদিন সেই পাপে আমরা অন্ধ হয়ে গেলাম। তারপরই ঘটলো সেই ভয়ংকর দুর্ঘটনা।

থামলো সূর্যমুখী। বললাম, থামলে কেন?

বলো, কী সেই দুর্ঘটনা?

ও যেন একটা বড় দীর্ঘশ্বাস ঢেললো। আবারো সূর্যের দিক থেকে মুখ ফেরালো আমার দিকে। বললো, একসময় আমরা তোমাদের মতই মানুষ ছিলাম। না, ঠিক তোমাদের মত না। আমাদের উচ্চতা হতো পনেরো বিশ হাত। আমরা বাঁচতাম কয়েকশো বছর। আমাদের কিছু লোক প্রভুর হুকুম অমান্য করা শুরু করলো। তারা নানা অপকর্মে জড়িয়ে পড়লো। তাদের মধ্যে লোভ ছড়িয়ে পড়লো। তারা একজন আরেকজনকে হত্যা করতেও পিছপা হলো না। তারা জুলুম করতো, অনৈতিক কর্মে জড়িয়ে পড়তো। হেন অপকর্ম নাই যা তারা করতো না।

ক্রমেই এদের সংখ্যা বাড়তে লাগলো। একসময় বলতে গেলে পুরো সমাজই অন্যায় ও পাপ কাজে জড়িয়ে পড়লো।

তখনই শুরু হলো সতর্ক সংকেত। নানাভাবে সাবধান করা হলো আমাদের। কিন্তু অনেকেই তা বুঝলো না, আর যারা বুঝলো তারাও তা কেয়ার করলো না। 

অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, বন্যা, মহামারী, অগ্নিকান্ড, রোগ, ব্যাধি নানা সংকট দিয়ে আমাদের সতর্ক করা হলো। কিন্তু আমরা কোন কিছুই আমলে নিলাম না।

আলেমরা বললো, সাবধান হও! সাবধান হও! নইলে গযব নেমে আসবে।

আমরা সাবধান না হয়ে উল্টো আমরা সেই আলেমদের ধরে হত্যা করলাম। দেশে দেশে ভাল মানুষদের জেলখানায় ঢুকিয়ে তাদের মুখ বন্ধ করে দিলাম। জঘন্যসব অত্যাচার, জুলুম ও নির্যাতন চালানো হলো তাদের ওপর। 

যখন এ অত্যাচার আর সহ্য করতে পারলো না, তারা হাত তুলে ফরিয়াদ করতে লাগলো, হে প্রভু, আমাদের বাঁচাও। রহম করো আমাদের ওপর। 

এরপর এলো ধর্ষণের কাল। ধর্ষণ শেষে ধর্ষিতাকে খুন করা হলো। আরো কত কি!


একদিন মধ্যরাতে পাড়ার কুকুরগুলো ডেকে উঠলো। তাদের চিৎকারে ঘুম ভেঙ্গে গেল আমাদের। আমরা এ কান্নার কোন মানে বুঝলাম না। এ ওর মুখের দিকে তাকাতে লাগলাম। পর পর কয়েকদিন একই ঘটনা ঘটলো। 

আলেমরা বললেন, হে মানুষ, সাবধান হও। তওবা করো। নইলে ধ্বংস অনিবার্য।


তারপরও আমরা সাবধান হলাম না। যে যার মতই রয়ে গেলাম। তখন এক রাতে ঘটলো সেই ঘটনা। প্রথমে তুফান শুরু হলো। বাতাস   অতি ঠান্ডা। মনে হলো, বরফের পাহাড়  ভেঙ্গে নেমে আসছে সাপের নিঃশ্বাস।

 জীবন্ত মানুষগুলো জমে বরফের পাথর হয়ে গেল। এক সময় থামলো সে ঝড়। পুরো শহর জুড়ে বরফের মানুষ। সবাই স্থির, অচঞ্চল। কিন্তু অবাক কান্ড হচ্ছে, এ তুফান মানুষ ছাড়া আর কাউকে স্পর্শ করলো না। না কোন প্রাণী, না বৃক্ষলতা।

পুরো এক সপ্তাহ এভাবেই পড়ে রইলো। কোন প্রাণী এদের স্পর্শ করলো না। এমন কি সূর্যের তাপ, বাতাসও তাদের স্পর্শ না করেই চলে গেল।

এক সপ্তাহ পরে আবার ঝড় শুরু হলো। এবার ভিন্ন রকম ঝড়। আগুনের ঝড়। এ আগুনও কোন সাধারণ আগুন না। মনে হলো, সরাসরি দোযখ থেকে আসছে। বরফের লাশগুলো নিরেট কালো পাথর হয়ে গেল।

কোন অস্ত্র না, গোলা বারুদ না, স্রেফ একটু বাতাস, নাই হয়ে গেলাম আমরা।

তারপর? তারপর কি হলো? কেমন করে তুমি সূর্যমুখী হলে? ব্যাকুল হয়ে জানতে চাইলাম আমি।

সূর্যমুখী আবারও একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। বললো, সে কাহিনী অনেক লম্বা। শুনতে হয়তো আপনার ভালো লাগবে না। শুধু শুধু বিরক্ত হবেন।

আমি বললাম, না, বিরক্ত হবো না। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছে, তুমি কি করে সূর্যমুখী হলে?

সূর্যমুখী বললো, তাহলে শুনুন।

আমরাতো শেষ হয়ে গেলাম। আমাদের আত্মাগুলো আল্লাহর দরবারে গিয়ে কান্নাকাটি শুরু করলো। বললো, প্রভু, আমাদের ভুল হয়ে গেছে। মাফ করে দাও আমাদের।

প্রভু বললেন, না, তা হয় না। তোমাদের তওবার সময় পার হয়ে গেছে। যখেষ্ঠ সময় তোমাদের দেয়া হয়েছিল। আমার প্রিয বান্দা, যাদের ওপর তোমরা অত্যাচার করছিলে, তাদের সহ্যের সীমা শেষ হয়ে গিয়েছিল। তারা কান্নাকাটি করছিল, বলছিল, তিনি তো রহমান শুধু নন, তিনি কাহহারও। আমাদের ওপর তিনি এতটাই অসন্তুষ্ট হয়েছেন যে, আমাদের কোন দোয়াই তার দরবারে কবুল হচ্ছে না। কিন্তু আমরা আর কি করতে পারি। 

তারপরও আমি তোমাদের ওপর চুড়ান্ত গযব নাজিল করিনি। অবকাশ দিয়েছি, যেন শোধরাতে পারো। তোমরা সে সুযোগও কাজে লাগালে না, এখন আর তওবার সময় নেই।

আপনাকে আগেই বলেছি, আমরা কিছু লোককো হত্যা করেছিলাম। কাউকে গুলি করে, কাউকে ফাঁসি দিয়ে। পরে জানলাম, সে লোকগুলো মরেনি, শহীদ হয়ে গেছে। 

আমাদের আত্মাগুলো নিরাশ হয়ে তাদের কাছে গেলো। ক্ষমা চেয়ে পেশ করলো নিজেদের আর্জি। তারা আর্জির বিষয় তাদের নবীকে জানালো। নবী বিষয়টি তোললেন আল্লাহর দরবারে। বললেন, এদের দুনিয়ায় পাঠানোর কি কোন উপায় নাই?

জানি না তারপর কি হলো। একদিন শুনি, কেউ চিৎকার করে বলছে, ওহে, অভিশপ্ত আত্মার দল, মন দিয়ে শোন, তোমরা সত্য ও আলো থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলে। তোমরা নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিলে। সম্মানিত শহীদদের অনুরোধে এবং তাদের নবীর সুপারিশে অবশেষে তোমাদের আবার দুনিয়ায় পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। তোমরা সেখানে যাবে, তবে মানুষ নয়, সূর্যমুখী হয়ে। আলো থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়ার জন্য তোমাদের এই নামকরণ করা হয়েছে। তোমরা যতদিন বাঁচবে সারাদিন সূর্যের দিকে তাকিয়ে থাকবে। সেই থেকে আমরা সূর্যমুখী।

আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। বাইরে তখন ফজরের আজান হচ্ছে।

২২/৪/২০। ৯ঃ০০ টা।

No comments

Powered by Blogger.