শাহ আলম নূর-এক কিংবদন্তী নাট্যজনঃ আসাদ বিন হাফিজ

 


প্রিয় নাট্যজন শাহ আলম নূর। জানি, আর কোনদিন আমাদের দেখা হবে না। দেখা হবে না আপনার মন ভুলানো হাসি। শোনা হবে না আপনার তীর্যক বুদ্ধিদীপ্ত কথা।
জীবনের অনেকটা সময় আমরা একসাথে কাটিয়েছি। অনেকবার আপনার বাসায় গিয়েছি। অনেক কথা হয়েছে। কিন্তু সবই ছিল ইসলামী সাহিত্য ও সংস্কৃতি নিয়ে। ব্যক্তিগত সুখ দুঃখ কখনো আমাদের তাড়িত করেনি।
ইসলামী অঙ্গনে নাটক এখনো অবহেলিত। যে কোন বিচারেই আপনি এ অঙ্গনের পাইওনিয়ার। আমাদের সমস্যা অনেক। আমরা সাফল্যের শর্তাবলী পড়েছি। আমরা জানি, পূঁজি বিনিয়োগ করলেই লাভের আশা করা যায়। পূঁজি যদি সিন্দুকে ভরে রাখা হয় তবে তা কখনো ডিম পাড়ে না। সিন্দুকের পূঁজি কখনো লাভ দেয় না। লোকসানের ভয়ে যে পূঁজি বিনিয়োগ করে না, সে কখনো লাভের আশা করতে পারে না।
তবু আমরা আমাদের ছেলেরা বাইরের অঙ্গনে মেলামেশা করুক এটা ভাল চোখে দেখি না। আবার বাইরের কাউকে ব্যবহার করতেও আমরা ভয় পাই। ফলে উপযুক্ত অভিনেতা, কলাকুশলী, স্ক্রিপ্ট, ফান্ড না থাকায় আমরা নাটকের মাধ্যমে ইসলাম বিস্তারের ক্ষেত্রে আজো পিছিয়ে। আপনি এ অচলায়তন ভেঙ্গে দিয়েছেন। খলিলুল্লাহ খান, আরিফুল হক, ইলিয়াস কাঞ্চনসহ (সব নাম এখন মনে আসছে না) বহু গুণী শিল্পীকে আপনি কাজে লাগিয়েছেন। চলচ্চিত্র অঙ্গনের অনেক কলাকুশলী, শিল্পী, ও মঞ্চ আপনি ব্যবহার করেছেন ইসলামের জন্য। স্ক্রিপ্টের অভাব দূর করেছেন নিজে নাটক লেখে। নাটকের ক্ষেত্রে সুস্থধারা নির্মাণের আপনি ছিলেন পথিকৃত। একটি অবহেলিত ক্ষেত্রকে চাষ করে আপনি যে ফসল ফলিয়েছেন নিশ্চয় আল্লাহ তার জাযা দেবেন।
আপনি নাট্যকর্মীদের সংগঠিত করেছেন। তাদের ট্রেনিং দিয়ে পরিপক্ক করে তুলেছেন। নাটককে নিয়ে গেছেন বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কাছে। আজ তাই একদল প্রশিক্ষিত নাট্যকর্মী এ অঙ্গনে কাজ করার জন্য উঠে দাঁড়িয়েছে। চর্চার মধ্য দিয়েই এর পরিপক্কতা, দক্ষতা, শিল্পকুশলতা বাড়বে।
গানের জগতে বিস্ময়কর কাজ করে যেমন বেঁচে আছেন কবি মতিউর রহমান মল্লিক তেমনি যদি আপনার হাতে তৈরী শিল্পীরা নতুন উদ্যমে আঁকড়ে ধরে নাটক তবে আপনিও স্মরিত বরিত হবেন। সবচে বড় কথা, আপনার কাজ আপনার জন্য সদকায়ে জারিয়া হয়ে আপনার পূণ্যকে আরো বহু গুণ বাড়িয়ে তুলবে।
শূন্য থেকে কি করে একটি চারা ও বৃক্ষ জন্ম দিতে হয় আপনি তার জ্বলন্ত প্রমান। "কেউ না করুক আমি করবো কাজ" এই শপথ ছাড়া এবং শপথের ওপর অনড় অটল থাকা ছাড়া কারো পক্ষেই কোন বড় অর্জন করা সম্ভব নয়। আপনার সাথে চলে এ শিক্ষাটা আমি ভালভাবেই রপ্ত করেছি।
আরো শিখেছি, হাল চাষের জন্য গরু লাগে। ছাগল দিয়ে বা হাতী দিয়ে হাল চাষ করা যায় না। নিজের গরু না থাকলে ধার করে গরু জোগাড় করে তবে ক্ষেতে চাষ দিতে হয়। গরু নাই বলে হাত ধুয়ে বসে থাকলে ক্ষেতে চাষ দেয়া হবে না। ফসলও ঘরে উঠবে না।
আজ (২ সেপ্টেম্বর ২২) ফজর নামাজ পড়েই আপনার আকস্মিক মৃত্যু সংবাদটা পেলাম। আপনাকে নিয়ে নতুন করে আরো বড় স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলাম আমরা। হঠাৎ এ খবর আমাদের স্বপ্ন চুরমার করে দিল। জানি না কে হাল ধরবে পলাশ থিয়েটারের। কে নতুন করে স্বপ্ন দেখাবে আমাদের। কেন যেন হাতপা অবশ হয়ে গেল খবরটা শুনে।
ভেবেছিলাম জানাযায় আসবো। কিন্তু শরীরকে কিছুতেই রাজি করাতে পারলাম না।। মাথা চক্কর দিচ্ছে। শরীরের ব্যালেন্স ধরে রাখতে পারছি না। একা বেরোতে সাহস হলো না। বিছনায় শুয়ে কান্না ও দোয়া ছাড়া আর কিইবা করতে পারি। আমি তো এমন কেউ না যে, কোন সহৃদয় ব্যক্তি আমাকে ধরে নিয়ে যাবে লাশের পাশে।
হয়তো অচিরেই আমিও না ফেরার দেশে চলে আসবো। তখন হয়তো মল্লিক, গোলাম মোহাম্মদ, আল মাহমুদসহ আপনারা যারা আগেই চলে গেলেন তাদের সাথে দেখা হবে। দেখা হবে কি? জানি না আল্লাহ কার ভাগ্যে কি লিখে রেখেছেন।
এ সুযোগে একটি নিবেদন না রেখে পারছি না। আমি বরাবরই কম কথা বলা মানুষ। এটাকে কেউ কেউ ভুলভাবে নিতে পারেন ভেবে আমি শংকিত। কেউ কেউ ভাবতে পারেন আমি দেমাগ বা অহংকারবশে ভাব নেই। কিন্তু বিষয়টি একেবারেই ভুল। হাসতে গেলে যে শক্তি লাগে সে শক্তিটুকুও এখন পাই না। কথা বলার এনার্জি নাই। আর যদি দেখা না হয়, আর যদি কথা বলার সুযোগ না পাই, আপনারা আমার কথায়, আচরণে যদি কেউ ব্যথা পেয়ে থাকেন নিজ গুণে ক্ষমা করে দেবেন। আমার যারা আপনজন, বন্ধু, ভাই, আমার হয়ে অন্যদেরও বলবেন আমার জন্য একটু দোয়া করতে। হে প্রভু, আমাদেরকে তোমার দ্বীনের জন্য কবুল করো আর আমাদের তুমি মাফ করে দাও।
২ সেপ্টেম্বর ২২।

No comments

Powered by Blogger.