কবি ও ইসলামঃঃআসাদ বিন হাফিজ
মানুষের মন বড় অদ্ভুত। কখন যে কি খেয়ালে আসে! আগে কখনো বিষয়টা এভাবে খেয়াল করিনি। কবিদের প্রতি ইসলামের অনুরাগ দেখে আমি বিস্মিত ও অভিভুত হয়েছি।
কবিদের আল্লাহ এতো ভালোবাসেন যে অবাক না হয়ে পারা যায় না। তিনি কবিদের নিয়ে একটা সুরা নাজিল করেছেন 'আশ শোয়ারা'। নামকাওয়াস্তে সুরা নয়, এ সুরায় তিনি কবিদের খুঁটিনাটি নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন। কবিদের দায়িত্ব ও কর্তব্য বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন নাই, কবিরা ব্যর্থতার উপত্যকায় ঘুরে বেড়ায়। বরং যারা কবিদের অনুসরণ করে তারা বিভ্রান্তির উপত্যকায় ঘুরে বেড়ায় বলেছেন। যেমন, খাজা মঈনুদ্দিন চিশতি বা শাহজালাল বিভ্রান্ত ছিলেন না বরং তাদের অনুসরণ করে যারা নানা অনাচারে লিপ্ত বিভ্রান্ত তারা।
অনুসরণ করতে হবে আল্লাহ ও রাসূলের, কোরআন ও সুন্নাহর। এর বাইরে আর কাউকে অনুসরণ যোগ্য মনে করা যাবে না।
এটাই আল্লাহর বিধান।
কবিদের কাজ হলো, ১.আল্লাহর প্রতি ঈমান আনা, ২. সেই ঈমান মোতাবেক আমল করা। এদুটো কাজ সকল মুসলমানের জন্যই ফরজ, মানে করতেই হবে। যদি কেউ এটা না করে তবে সে যেন স্কুলে ভর্তি হলো কিন্তু কোনদিন স্কুলেও গেল না, লেখাপড়াও করলো না। ফলে পরীক্ষায় পাশ করাও তার কপালে ঘটবে না।
কবিদের অতিরিক্ত বা একমাত্র বিশেষ কাজটি হলো অত্যাচারিত হলে তার প্রতিবাদ করা। যেখানে সে অত্যাচার দেখবে সেখানেই ঝলসে উঠবে কবি। অত্যাচারিতদের চোখে আঙুল দিয়ে সে জুলুমের স্বরূপ উদঘাটন করে তাকে এর প্রতিবিধানের জন্য সজাগ করবে।
কবির কাজ বিপ্লবের আগুন জ্বালানো, বিপ্লব করবে বিপ্লবীরা।
এটাকে অনেকটা মুয়াজ্জিনের সাথে তুলনা করা যায়। মুয়াজ্জিন আজান দিলে মুসল্লিরা আসবে, জামাত হবে, তখন ইমাম এসে নামাজ পড়াবে।
যদি মোয়াজ্জিন আজান না দেয়, মুসল্লি আসবে না, জামাত হবে না, ইমাম নামাজ পড়ানোর মুসল্লি পাবে না।
কবিদের কাজ সত্যের স্বপক্ষে আওয়াজ তোলা, জনগণ তাতে সংঘটিত হবে, বিপ্লব ত্বরান্বিত হবে, নতুন সমাজ গঠিত হবে। যে সমাজ হবে সত্য ও সুন্দরের।
এ সুরায় সরাসরি আল্লাহ কবিদের গাইড করেছেন, নির্দেশনা দিয়েছেন। অতএব, আপনি যদি কবি হন, আপনার কোন শিক্ষক দরকার নেই, আপনি সুরা শোয়ারা হাতে নিন, সব নির্দেশনা আপনি সেখানেই পেতে পারেন।
ভাবুন, আল্লাহ কবিদের কতটা ভালবাসলে কবিদের গাইড নিজে হয়ে যান।
বুঝলাম আল্লাহ কবিদের ভীষণ ভালবাসেন। মনে হলো, আল্লাহর মতো নবীও কি কবিদের ভালবাসেন?
আমার জানা নেই, ইসলামের আগে কেউ কবিদের এতো সম্মান দিয়েছেন কিনা? কবিদের রাষ্ট্রীয় খেতাব ও পুরষ্কারের প্রবর্তন করেন রাসুল সা.। শায়েরুন্নবী বা নবীর কবি হিসাবে রাসূল সা. প্রথম কবিদের রাষ্ট্রীয় খেতাব প্রদান করেন। এই খেতাব প্রথম কে পান? এ খেতাব পান আরবের বিখ্যাত কবি হাসসান বিন সাবিত। কে এই সাবিত?
আপনাদের মনে থাকার কথা, একবার মা আয়েশার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলেন এক কবি। শহরময় ছড়িয়ে পড়ে একথা। কথা যায় নবীর কানেও। নানা লোকের নানা কথায় অতিষ্ঠ হয়ে যান নবী।
বিয়ষটি নবীর মনে দারুণ ক্ষতের সৃষ্টি করে। তিনি প্রিয়তমা স্ত্রীকে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দেন। স্ত্রী জানেন, কেন এ বিচ্ছেদ। তার নামে মিথ্যা অপবাদ শুনে নবীও কি তাকে ভুল বুঝলেন?
নাওয়া খাওয়া ছেড়ে দিলেন তিনি। বুকে অথৈ ব্যথায় পাগলিনী প্রায়। নবীও বেকারার। একি শুনলাম? ছটফট করেন নবী, ছটফট করেন নবীপ্রেমিক মুমীনগণ। একদিন নয়, দুদিন নয়, সপ্তাহ নয়, মাস নয়, দীর্ঘ চল্লিশ দিন এ মর্মযাতনায় অতিবাহিত করেন নবী ও তার প্রাণপ্রিয় আয়েশা রা.।
এ কষ্ট সইতে পারলেন না মহান আল্লাহ। তিনি আয়াত নাজিল করে সব রহস্য জানালেন নবীকে। তিনি জানতে পারলেন, এ অপবাদ মিথ্যা ও বানোয়াট। মেঘ কেটে গেল। স্বামীর ঘরে ফিরে এলেন মা আয়েশা রা.।
এ বেদনাদায়ক ঘটনাটি যিনি ঘটিয়েছিলেন তিনি একজন কবি। কবি হোন আর যেই হোন এ অপরাধের শাস্তি সবাই চাইবে। অথচ কি ঘটলো?
এতবড় কষ্টের পরও তাকে মাফ করে দিলেন মা আয়েশা রা., এবার নবীও তাকে মাফ করে দিলেন।
মজার ব্যাপারটি হচ্ছে, আল্লাহ তাকে মাফই করলেন না, নবীর মাধ্যমে তাকে বেহেশতের সুসংবাদও জানিয়ে দিলেন।
নবী মুহাম্মদ সা. তার হৃদয়ে ক্ষত সৃষ্টিকারী এ কবির প্রতি যে কোন বিদ্বেষ পোষণ করেননি, তাঁকে ইসলামী রাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় কবি খেতাব প্রদানের মাধ্যমে এটাই প্রমান করলেন।
বিষয়টি একটু ভাবুন। ইসলাম কবিদের কতটা সুনজরে দেখে এটা তার এক জ্বলন্ত প্রমাণ।
কবিদের সাধারণ ভুলত্রুটি মাফ করে দেয়া সুন্নত কি না জানি না, তবে নবী যে ঘোরতর অপরাধও মাফ করেছেন এ ঘটনা তারই প্রমাণ।
শুধু কি তাই? হাদীসেই এসেছে মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত কবি রাসুলকে কবিতা শুনিয়ে মাফ চাইলে রাসুল তার দন্ড মওকুফ করে দেন। কবিতা শুনে নবী তাঁর গায়ের চাদর খুলে কবিকে উপহার দিয়েছেন এ মশহুর ঘটনা সবারই জানা। মুজাহিদ ছাড়া কেউ গনীমতের মাল পায় না, কিন্তু কবিদের রাসূল গনীমতের মাল দিতেন অর্থাৎ কবিতা লেখাই কবির জন্য জেহাদ। আর কি সম্মান চান কবিরা?
আমরা বিশ্বাস করি, আল্লাহ যাদের ভালবাসেন তাদের দোয়া কবুল করেন। সেই আশাতেই আমরা পীর ও আলেমদের কাছে যাই। কিন্তু তাদের দোয়া আদৌ আল্লাহ কবুল করেন কিনা আমার জানা নেই।
কিন্তু আপনারা জানেন, আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম মসজিদের পাশে তার কবরের জন্য প্রার্থনা করেছিলেন এবং আল্লাহ তার আশা পূরণ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে তার কবরের ব্যবস্থা করেন।
কবি আল মাহমুদ, যিনি বলেছেন জেহাদ করার জন্যই তার দুনিয়ায় আগমন, তিনি কোন এক শুক্রবারে তার মরণ চেয়েছেন। আল্লাহর কি মহিমা পবিত্র শুক্রবারেই তিনি মারা যান। বিষয়টি আগে খেয়াল করিনি। এখন খেয়াল করে দেখলাম, কবিদের দোয়া আল্লাহ কবুল করেন।
তার মানে কবিরা আল্লাহর প্রিয়, রাসুলের প্রিয় এবং আল্লাহর নেক বান্দাদেরও প্রিয়। কোরআন ও হাদীস এটাই আমাদের সামনে স্পষ্ট করে তুলে ধরে।
আল্লাহ আমাদেরকেও তাঁর প্রিয় কবিদের তালিকায় শামিল করুন।
২২/১২/২২। বাদ ফজর।
No comments