মানবতা ও ইসলামঃ একটি তুলনামূলক আলোচনা - আসাদ বিন হাফিজ
"মানবতা"
শব্দটি আজ বহুল ব্যবহৃত। এর দ্বারা উদারতা ও মহানুভবতার সর্বোচ্চ মাপকাঠী বুঝানো হয়।
মানুষ যাতে সংকীর্ণতার উর্ধে উঠে একটি সার্বজনীন চেতনা ধারণ করতে পারে সে অর্থে এর
প্রয়োগ হয়। সমস্ত প্রকার সাম্প্রদায়িকতার উর্ধে উঠে একটি মহৎ ভাবকল্পনা মানুষের মনে
জাগিয়ে তোলার জন্য এর চেয়ে যুৎসই কোন শব্দ এরা খুঁজে পায় না।
এটা সাধারণ জনগণের পারসেপশন।
আরেকদল মানুষ মানবতা শব্দটি
ব্যবহার করে তার অপকর্ম ঢাকার জন্য। তারা যে ভন্ড প্রতারক এটা যেন মানুষ না বুঝতে পারে
সে জন্য তারা মানবতা শব্দটি ব্যবহার করে। এরা এ শব্দের আড়ালে নিজেদের পাশবিকতা ঢাকতে
চায়। তারা আচরণে সংকীর্ণমনা, কিন্তু জনগণকে বুঝাতে চায় তার
চেয়ে মহৎ কেউ নেই। তারা মানবতার বুলি কপচায় আর আনবিক বোমা বানায়। তারা মানবতার কথা
বলে আর দেশে দেশে যুদ্ধ বাঁধায়। তারা মানবতার কথা বলে দেশে দেশে অস্ত্র বিক্রি করে।
তারা মানবতার কথা বলে শিশু হত্যা করে, হাসপাতালে বোমা মারে।এভাবে
তারা কতটা পশু আর নিষ্ঠুর তা ঢাকতে মানবতা শব্দটি ব্যবহার করে।
সাধারণ জনগণ মানবতা শব্দটির
মধ্যে কোন সংকীর্ণতা খুঁজে পায় না। কিন্তু একটু খেয়াল করে দেখলেই তারা বুঝতে পারতো, মানবতা শব্দটি কত সংকীর্ণ। এ সংকীর্ণতা লুকিয়ে আছে খোদ মানবতা শব্দটির মধ্যেই।
"মানবতা"
শব্দটি কেবল মানুষকে ধারণ করে। মানুষের বাইরেও যে একটা বিশাল জগত রয়েছে এ শব্দ মানুষকে
সেদিকে নজর দিতে দেয় না। ফলে, সুবিশাল প্রকৃতি, নানান জীবজন্তু, পাখি ও পতঙ্গকুল এ শব্দটি ধারণ করতে
পারে না। সে জন্য মানুষ বন কেটে উজাড় করে। মানুষের অত্যাচারে বিলুপ্ত হয়ে গেছে প্রাণী
জগতের নানা প্রজাতি। সভ্যতার অভয়ারণ্য ধংস করছে মানুষ। মানবতা শব্দটির মধ্যে মানুষ
ছাড়া আর সবই অপাংতেয়। এই বিশাল বিশ্বজাহান,
আকাশ, পৃথিবী, সাগর,
নদী, চাঁদের সুষমা কোন কিছুরই গুরুত্ব নেই এ মানবতা
শব্দে। সে কেবল মানুষ নিয়েই চিন্তা করে। বিশ্বজাহানের বিপুলায়তনের ব্যাপকতা নাই বলেই
মানবতা এক ধরনের সংকীর্ণতায় ভোগে। সে জন্যই মানবতা শব্দটির মধ্যে আরো উচ্চতর,
আরো ব্যাপকতর, আরো বিপুলায়তন চিন্তা চেতনার অবকাশ
নেই। এখানেই মানবতা শব্দটি সামগ্রিকতাকে ধারণ করতে অক্ষম। এই অক্ষমতা নিয়ে মানবতা শব্দটি
মহত্তর ভাবকল্পনা, উদারতা ও সভ্যতার ব্যাপকতা ধারণ করতে পারে
না।
এখানেই মানবতার চাইতে ইসলাম
ব্যাপকতর, ইসলাম শ্রেষ্ঠ। ইসলাম শুধু মানুষকে নিয়ে ভাবে
না। সে ভাবে সমগ্র সৃষ্টিকুল নিয়ে। এ ভাবনার কারণেই হযরত ওমর রা. বলেন, ফোরাতের কূলে যদি একটি কুকুরও না খেয়ে মরে তবে কাল কেয়ামতে আমি ওমরকে জবাবদিহী
করতে হবে। ইসলাম বলে, তুমি যদি জানো একটু পরেই কেয়ামত হবে তবু
সুযোগ থাকলে একটি গাছ লাগাও। এভাবেই ইসলাম প্রকৃতিরও রক্ষক হয়। এভাবেই ইসলাম প্রাণীকুলের
রক্ষক হয়। সারা পৃথিবীর মঙ্গলচিন্তা যাকে আচ্ছন্ন করে রাখে সে কি করে সংকীর্ণ হবে?
তার কাছে প্রতিটি প্রাণীর জীবন মূল্যবান। বনবনানী মূল্যবান। প্রকৃতি
ও নিসর্গ মূল্যবান। এই যে মানুষকে ছাপিয়ে সমগ্র সৃষ্টিকুলকে নিয়ে চিন্তা করে সে কি
মানবতা শব্দের চাইতে মূল্যবান নয়? ইসলামের ব্যাপকতা ও বিশালতার
মধ্যে যে উদারতা ও মহত্তর ভাবকল্পনা লুকিয়ে আছে মানবতা শব্দ দিয়ে কি তার মোকাবেলা করা
সম্ভব?
মুসলমান কি শুধু মুসলিমদের
নিয়েই চিন্তা করে? কোরআন মুসলমানকে শিখিয়েছে পৃথিবীর সব মানুষ
এক আদমের সন্তান। অতএব, মানুষ, সে যে দেশের
হোক, ধর্মের হোক, সম্প্রদায়ের হোক,
সে তোমারই ভাই। ভাই হিসাবে তার রয়েছে অনন্য মর্যাদা। সে মর্যাদা ও অধিকার
সে তোমার কাছে পাওনা। তোমাকে আল্লাহর খলিফা হিসাবে নিযুক্ত করা হয়েছে। সে হিসাবে আল্লাহর
সমগ্র সৃষ্টিজগতের দেখভালের দায়িত্ব তোমার। সব ধর্মের লোকদের দেখভালের দায়িত্ব তোমার।
সব দেশের লোকদের দেখভালের দায়িত্ব তোমার।
আফসোস, আজ মুসলমানদের মনেও এ বিশালতার ধারণা বিলুপ্ত। ইসলামের কথা বলতে গিয়ে অনেকেই
হীনমন্যতায় ভোগে।
মনে রাখতে হবে, ইসলাম কোন ধর্মের নাম নয়। ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। জগতের কল্যাণ ও
মঙ্গলই এ বিধানের মূল কথা। মানুষও সে কল্যাণের অংশীদার। এ কল্যাণের জন্যই প্রকৃতি রক্ষা
করতে হবে। সভ্যতা রক্ষা করতে হবে।
মানুষ যদি এ বিধান মেনে চলে
তবে কোন বিপর্যয় তাকে স্পর্শ করবে না। কোরআন শুধু মুসলমানের জন্য আসেনি, এসেছে বিশ্বের কল্যাণের জন্য। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম কি চমৎকার
করেই সে কথা বলেছেন।
"কেবল মুসলমানের
জন্য আসেনিকো ইসলাম।"
মানুষ সে কল্যাণ পাবে তার
কর্ম ও আচরণের মাধ্যমে। কোরআনে সে আচরণের বিশদ
বর্ণনা রয়েছে। সে আচরণ বা কর্ম (আমল) করেই তোমাকে সে কল্যাণ লাভ করতে হবে।
কোরআনে বার বার "ইয়া
আইউহান্নাস" "হে মানব সম্প্রদায়" সম্বোধন করে আয়াত নাজিল করা হয়েছে।
ফলে, কোরআন মানব সম্প্রদায়ের সম্পদ। এটা কোন গোষ্ঠী, দেশ, সম্প্রদায় বা জাতির একক সম্পদ নয়। এই যে সামগ্রিকতা
এটা কেবল ইসলামই ধারণ করতে পারে, মানবতা শব্দ দিয়ে এই বিশালতা
প্রকাশ করা সম্ভব নয়।
মুহাম্মদ সা.কে বলা হয়েছে,
"রাহমাতুল্লিল আলামীন" " বিশ্ব জগতের রহমত। তিনি কেবল
মুসলমানের জন্য রহমত স্বরূপ আসেননি। এসেছেন জগতের রহমত হয়ে। ফলে, ইসলাম যে ব্যাপকতা ধারণ করতে পারে "মানবতা" দিয়ে তা প্রকাশ করা আদৌ
সম্ভব নয়। এ বিবেচনায়, মানবতা একটি সংকীর্ণ চেতনার ধারক। সে কেবল
মানুষকে ধারণ করতে পারে, সৃষ্টি জগতকে নয়। ইসলামের কাছে যে উদারতা
আছে, মনবতায় তা নেই।
আফসোস, অমুসলমান তো ইসলামকে সংকীর্ণ মতবাদ বলেই জানে, সেই সাথে
মুসলমানরাও ইসলামের এ ব্যাপকতা বুঝতে অক্ষম বা যারা বুঝেছেন, তারা এ অমূল্য সম্পদে মুসলিম ছাড়া অন্য কাউকে ভাগ দিতে নারাজ। এই কুপমন্ডুকতা
থেকে বেরিয়ে আসতে হবে মুসলমানদের। বক্তৃতায় নয়, বাস্তবেও মুহাম্মদ
সা.কে রাহমাতুল্লিল আলামীন মেনে মুসলমানদের জন্য কুক্ষিগত না করে ছেড়ে দিতে হবে সবার
জন্য। কোরআনকেও মানব সম্প্রদায়ের জন্য উন্মুক্ত করে দিতে হবে। তাহলেই কেবল মানুষ জানতে
পারবে, মানুষকে সম্বোধন করে কোরআন কি বলেছে। মুসলমানদেরকে কোন
বিশেষ সম্প্রদায়ের কল্যাণ চিন্তা না করে "আল্লার খলিফা" হিসাবে দায়িত্ব পালন
করতে হবে। আর তখনি ইসলাম কেবলমাত্র একটি ধর্মীয় সম্প্রদায় না হয়ে মানুষের জীবন বিধানে
পরিনত হবে।
মানুষ তখন বুঝতে পারবে, মানবতার চাইতে ইসলাম কতো ব্যাপক ও বিশাল। ইসলামই শ্রেষ্ঠ, মানবতা নয়। মানুষ তখন মানবতা নিয়ে গর্ব না করে ইসলাম নিয়ে গর্ব করবে। মানবতার
কল্যাণের জন্য কাজ না করে মানুষ ইসলামের কল্যাণের জন্য কাজ করবে। মানুষ বুঝতে পারবে
যেখানে ইসলাম, সেখানেই শান্তি। ভন্ডদের ভন্ডামীর হাতিয়ার মানবতাবাদ
ছুঁড়ে ফেলে মানুষ এসে আশ্রয় নিবে ইসলামের ছায়াতলে। পৃথিবীতে ফিরে আসবে সুখ ও শান্তি। দূর হয়ে যাবে জালিমের জুলুম। খুলে যাবে প্রতারকদের
মুখোশ।
আসুন, আজ থেকেই আমরা এমনি এক সোনালী দিনের স্বপ্ন দেখতে শুরু করি। পৃথিবীর কল্যাণের
জন্য মানবতাবাদ নয়, চাষ করতে শুরু করি ইসলামের। ইসলাম সকল প্রকার
সংকীর্ণতার উর্ধে উঠে যে মহত্তর ও উদার মানসিকতার জন্ম দেয় তাই কল্যাণকর। সভ্যতার সমৃদ্ধি
ও কল্যাণের জন্য ইসলামের কোন বিকল্প নেই। পুঁজিবাদ, সমাজবাদ,
মানবতাবাদ মানুষকে যে সংকীর্ণতায় ঢুকিয়ে দেয় সেখান থেকে বেরিয়ে আসার
একমাত্র পথ ইসলাম। ইসলামই শ্রেষ্ঠ, ইসলামই মহত্তর জীবন বিধান।
২৮/২/২৩। বাদ ফজর।
No comments