ইসলামে মাতৃভাষা চর্চার গুরুত্ব - আসাদ বিন হাফিজ
ইসলামে মাতৃভাষা চর্চার গুরুত্ব
কি এটা সম্যক উপলব্ধি না করার কারণে অনেকেই বিশেষ করে আলেম সমাজের একটা বৃহত্তর অংশ
আমাদের আরবী ভাষা চর্চাকেই ইসলাম চর্চা মনে করেন এবং এজন্য বাংলাভাষার ওপর এক ধরনের
আরবী আগ্রাসন চালাচ্ছেন। কিন্তু তারা ভুলে যান, রাসূলকে গালিও দেয়া হতো আরবী ভাষায়।
ইসলাম আরবীভাষীদের দ্বারা কম নির্যাতীত হয়নি। আবু সুফিয়ান, আবু লাহাবদের
ভাষাও ছিল আরবী। ফলে আরব জনগোষ্ঠীর জন্য আরবীই ছিল তাদের মাতৃভাষা। রাসূলের মাতৃভাষাও
ছিল আরবী। তাই কোরআন আরবী ভাষাতেই নাজিল হয়েছে।
মনে রাখতে হবে, পৃথিবীর
প্রতিটি ভাষাই আল্লাহ বিশেষ নেয়ামত। বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর জন্য তিনি বিভিন্ন ভাষা সৃষ্টি
করেছেন। প্রতিটি জনগোষ্ঠী মাতৃভাষায় যতটা সহজে ভাব আদান প্রদান করতে পারে এবং স্বচ্ছন্দবোধ
করে অন্যভাষায় তা পারে না।
পবিত্র কোরআনে সুরা আর রাহমানে
আল্লাহ ঘোষণা করেন,
" পরম দয়ালু আল্লাহ। তিনি কালাম শিক্ষা দিয়েছেন। মানুষকে সৃষ্টি
করেছেন এবং তাকে কথা বলা শিখিয়েছেন।" আল্লাহ রাব্বুল আলামীন এখানে স্পষ্ট ভাষায়
ঘোষণা করেছেন, তিনিই মানুষকে কথা বলা শিখিয়েছেন। আর মানুষ প্রথম কথা বলা শেখে মাতৃভাষাতেই। ফলে, মাতৃভাষা
আল্লাহর বিশেষ নেয়ামত। আল্লাহর অসংখ্য নেয়ামতের মধ্যে ভাষার এ নিয়ামত দিয়ে তিনি মানব
জীবনকে মহিমান্বিত করেছেন। এ নিয়ামত তিনি দান করেছেন ভিন্ন ভিন্ন জনগোষ্ঠীর জন্য আলাদা
করে। ফলে প্রত্যেক জনগোষ্ঠীই আপন আপন মাতৃভাষায় সমৃদ্ধ হতে পেরেছে।
মাতৃভাষা হচ্ছে মায়ের ভাষা। সন্তান যে ভাষা প্রথম তার মায়ের কাছ থেকে শিখে সেটাই তার মাতৃভাষা। সে ভাষার চর্চা ও সমৃদ্ধি ঘটানোই তার দায়িত্ব। কারণ, আল্লাহ পছন্দ করেই তাকে সে ভাষার জনগোষ্ঠীর মাঝে সৃষ্টি করেছেন। সবাই স্বীকার করবেন, যদি মানুষ কথা বলতে না জানতো তবে কখনোই জ্ঞানবিজ্ঞানের এ অগ্রগতি সাধিত হতো না। সভ্যতার যে বিকাশ সে বিকাশে মাতৃভাষা চর্চার গুরুত্ব অপরিসীম। ভাষাহীন কোন বিশ্ব আমরা কল্পনা করতে পারি না। আর এ ভাষা আমরা পেয়েছি স্রষ্টার পক্ষ থেকে। ফলে, মাতৃভাষাকে অবজ্ঞা করা সৃষ্টির স্বাভাবিক বিকাশকে অবজ্ঞা করারই নামান্তর।
রাসূল সা. বিদায় হজ্জের ভাষণে
বলেছেন, আরবের ওপর অনারবের যেমন কোন শ্রেষ্ঠত্ব নেই তেমনি অনারবের ওপরও আরবের কোন শ্রেষ্ঠত্ব
নেই। অর্থাৎ ভাষা বা ভৌগলিক অবস্থানের কারণে কেউ শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে পারে না। শেষ্ঠত্ব
নির্ভর করে তাকওয়ার ওপর। ফলে, আরবী চর্চা মানে ইসলাম চর্চা নয়, এটি আমাদের
ভালভাবে বুঝতে হবে।
সুরা কাহাফের ১০৯ নম্বর আয়াতে
আল্লাহ বলেছেন,
"হে মুহাম্মদ, বলো, যদি আমার
রবের মহিমা লেখার জন্য সমুদ্রকে কালিতে পরিনত করা হয় তাহলে সমুদ্র নিঃশেষ হয়ে যাবে
কিন্তু আমার রবের মহিমা শেষ হবে না, বরং যদি এ পরিমান কালি আবারও আনা
হয় তাহলে তাও যথেষ্ট হবে না।" এই লেখালেখি
করার জন্যই আল্লাহ বিভিন্ন জনগোষ্ঠী ও ভাষার জন্ম দিয়েছেন।
শুধু মানুষ নয়, প্রতিটি
প্রাণীরই মাতৃভাষা রয়েছে,
তারা সে ভাষায় কথা বলে এবং ভাবের আদান প্রদান করে। আমরা তাদের
ভাষা বুঝি না, কিন্তু সোলায়মান (আঃ) পশুপাখি ও জীবজন্তুর ভাষা বুঝতে পারতেন। এই যে প্রতিটি প্রাণীর
আলাদা ভাষা ওটাই তাদের মাতৃভাষা। পশুপাখিও মাতৃভাষাতেই ভাব বিনিময় করে। মাতৃভাষা ছাড়া
দুনিয়া অচল। ইসলামে মাতৃভাষা চর্চার গুরুত্ব তাই অপরিসীম।
সুরা রুমের ২২ নম্বর আয়াতে
মাতৃভাষার গুরুত্ব তুলে ধরে বলা হয়েছে, " আর তাঁর নিদর্শনাবলীর মধ্যে রয়েছে
আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র। এতে জ্ঞানীদের জন্য
অবশ্যই বহু নিদর্শন রয়েছে।" মানুষের চেহারা ও গঠন প্রকৃতি ও বর্ণের পার্থক্য আর
ভাষার পার্থক্য আল্লাহর সৃষ্টিবৈচিত্রেরই নিদর্শন। এ বৈচিত্রকে অস্বীকার ও অবজ্ঞা করা
কোন মুমীনের জন্য জায়েয নয়। প্রত্যেক জনগোষ্ঠী মাতৃভাষা চর্চার মাধ্যমে আল্লাহর এ নেয়মতকে
ধারন করবে এটাই ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি।
ইসলাম মাতৃভাষা চর্চার গুরুত্ব
তুলে ধরে সুস্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছে, " আমি নিজের বানী মানুষের কাছে পৌঁছানোর
জন্য যখনই কোন রাসূল পাঠিয়েছি, সে তাঁর নিজ সম্প্রদায়ের ভাষায় তা বিবৃত করেছে যাতে মানুষ তা
পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারে।" এটাই দ্বীনী দাওয়াত পৌঁছানোর মূলনীতি। মানুষ যাতে সহজে
দ্বীনকে বুঝতে পারে সেজন্য এই মৌল নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে অবোধগম্য, অপ্রচলিত
ও জোর করে বিদেশী ভাষা চাপিয়ে দেয়া একধরনের আগ্রাসন। যে ভাষা স্বাভাবিক, সহজ সরল
সেখানে জটিল ভাষা আমদানী আল্লাহর এ চিরায়ত নীতি পদ্ধতির বিপরীত গর্হিত কাজ। মুসলমান
এ গর্হিত কাজ থেকে বিরত থাকুক এটাই আল্লাহ চান। নিজস্ব ভাষায় কোন শব্দ না থাকলে বিদেশী
ভাষা থেকে শব্দ আমদানী করে ভাষাকে সমৃদ্ধ করা যায়, কিন্তু বিনা প্রয়োজনে অন্য ভাষা থেকে শব্দ আনাটা বাহুল্য কাজ, এটা ইসলামী
দৃষ্টিভঙ্গির অন্তরায়। এ কাজ থেকে বিরত থাকার জন্য এ আয়াতে স্পষ্ট নীতিমালা পেশ করা
হয়েছে।
আরবী যদি ইসলামী ভাষা হতো
তবে সব আসমানী গ্রন্থ আরবীতেই নাজিল হতো। কিন্তু তা কখনো হয়নি। ইসলাম প্রচারে আল্লাহ
যে নীতিমালা দিয়েছেন তাই সর্বোত্তম। এ নীতিমালা বর্জন করে নতুন কোন উপায় উদ্ভাবন করা
সুস্পষ্টভাবে ইসলাম বিরোধী। আল্লাহ নিজে কখনো তা করেননি এবং কেউ তা করুক তাও আল্লাহ
পছন্দ করেন না। সেজন্যই তিনি যখন যে জনগোষ্ঠীতে নবী পাঠিয়েছেন সেই জনগোষ্ঠীর ভাষায়
তা পাঠিয়েছেন। এভাবেই তিনি মানবমন্ডলীকে মাতৃভাষা চর্চা শিখিয়েছেন। যেমন হযরত দাউদ
(আঃ) এর ওপর যবুর নাজিল হয়েছিল তাঁর জনগোষ্ঠীর ইউনানী ভাষায়, হযরত মুসা
(আঃ) এর প্রতি তওরাত নাজিল হয়েছিল তার মাতৃভাষা হিব্রু ভাষায়। একইভাবে হযরত ঈসা (আঃ)
এর প্রতি ইনজিল নাজিল হয়েছিল তাঁর মাতৃভাষা সুরিয়ানী (সিরীয়) ভাষায়। সর্বশেষ নবী মুহাম্মদ
(সঃ) এর উপর কোরআন নাজিল হয়েছে তাঁর মাতৃভাষা আরবীতে। ফলে, সহজ, স্বাভাবিক
মাতৃভাষাতে ইসলাম প্রচার করতে হবে, কোন রূপ দ্বিধা সংকোচ ছাড়াই এ নীতি
গ্রহণ করা মুসলমানদের জন্য অত্যাবশ্যক।
এক্ষেত্রে ছোট্ট একটি উদাহরণের
মাধ্যমে বিষয়টি ক্লিয়ার করতে চাই। আমাদের দেশে যেমন ভাটিয়ালী, ভাওয়াইয়া, পল্লীগীতি
এরকম নানান ফর্মে গান গাওয়া হয়, তেমনি আরবীতে মর্সিয়া, হুদা, নাশিদ এমন
নানা ফর্মের গান আছে। হঠাৎ করেই দেখলাম গানের বদলে একশ্রেণীর ইসলামিস্ট গানকে নাশিদ
বলা শুরু করেছে। এটা ইসলামী নীতিমালার সুস্পষ্ট বিরোধী। আমরা এদেশে আরবী প্রমোট করতে
চাচ্ছি না, ইসলাম প্রচার করতে চাচ্ছি। ফলে, গণমানুষের বোধগম্য ভাষাতেই তা করতে
হবে। আমরা আজানে ইকামতে আল্লাহু আকবার বলি, আল্লাহু আকবারের গগনবিদারী শ্লোগানে
প্রতিপক্ষ প্রকম্পিত হয়,
সেখানে নতুন করে লিল্লাহি তাকবীর আল্লাহু আকবার চালু করার প্রয়াস
রীতিমত একটা বেহুদা কাজ। কারণ, এতে করে ভাষার স্বাভাবিকতা বিনষ্ট হয়। ভাষার স্বাভাবিক গতি রুদ্ধ
করলে তা ফারাক্কা বাঁধের মতই মানুষের জীবন নষ্টের কারণ হয়। প্রয়োজনের সময় আমাদের খাল, নদী শুকিয়ে
যায়, আর বন্যার সময় বাঁধ খুলে দিয়ে আমাদের ভাসিয়ে মারার করুণ ইতিহাস সৃষ্টি হয়। সে জন্য, কোথাও স্বাভাবিক
অগ্রগতি রুদ্ধ করার প্রবনতা সভ্যতার জন্য ক্ষতিকর।
হ্যাঁ, ভাষা নদীর
মতই প্রবহমান। চেয়ার,
টেবিল, আদালত যেমন অন্যভাষা থেকে আত্মীকরন করা হয়েছে, দরকার হলে
সেভাবে আরো নতুন নতুন শব্দ আসবে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায়। সেসব শব্দ জনগ্রাহ্য হওয়ার পর
দায়ীগণ দাওয়াতের জন্য তা ব্যবহার করতে পারেন। কিন্তু প্রতিক্রিয়াশীলদের মত বেহুদা কোন
শব্দকে মার্কেটাইজ করার প্রবণতা হবে আত্মঘাতি। এ আত্মঘাতি কাজ দাওয়াতে দ্বীনের জন্য
কখনোই সুফল বয়ে আনবে না। আপনারাই বলুন, বাংলার জনগণ গানের সাথে বেশি পরিচিত
নাকি নাশিদের সাথে। এ আঁতেলগিরি করে আপনি বরং প্রবহমান বাংলার গানের সাথে অযথা এক বাকযুদ্ধে
জড়িয়ে পড়লেন এবং নিজেকে বাংলার গণমানুষ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে নিলেন। এই দূরত্ব
তৈরী করে আপনি কি হাসিল করতে চান? যেখানে দাওয়াত পৌঁছানোর জন্য আপনার দরকার নৈকট্য লাভ সেখানে
আপনি দূরত্ব তৈরী করে দূরে সরে গেলেন। নতুন করে এমন কিছু শব্দ দেখছি যার কোন প্রয়োজন
নেই। এগুলো আমদানী করে আপনি নিজেকে পন্ডিত জাহির করতে পারবেন, ইসলামের
কোন কল্যাণ করতে পারবেন না। আল্লাহু আকবর না বলে লিল্লাহি তাকবীর বললে ইসলামের কি উপকার
হবে? তাহলে কেন এ অপচেষ্টা?
আপনারা সবাই জানেন রাসূলের
সেই মশহুর হাদিসগুলো। রাসূল (সাঃ) বলেছেন, "নিশ্চয় মুমীন তরবারী দিয়ে ও মুখের
ভাষা দিয়ে জেহাদ করে। যার হাতে আমার প্রাণ, সেই মহান সত্ত্বার কসম, তোমরা যে
কবিতা দিয়ে ওদের আঘাত করছো,
তা তীরের আঘাতের চেয়েও প্রচন্ড।" (মেশকাত)।
কী সাংঘাতিক কথা। আল্লাহর কসম খেয়ে রাসূল (সাঃ) বলছেন, কবিদের কবিতা
তীরের চেয়েও শক্তিশালী। সাহাবী কবিগণ এ কবিতা চর্চা করতেন মাতৃভাষাতেই। রাসূল (সাঃ)
আরো বলেছেন,
" আল্লাহর রাসূল (সাঃ) আরো বলেছেন, "এ তো অনস্বীকার্য,
রাসূলের হেফাযতের জন্য অস্ত্র হাতে নিয়ে তোমরা অতন্দ্র প্রহরী
হয়ে কাজ করছো, কলমের ভাষা দিয়ে তাঁকে আজ হেফাজত করার সময় এসে গেছে। কে আছো তীক্ষ্ণ কালির টান
নিয়ে এগিয়ে আসবে?"
রাসূলের এ আকুতি ছিল, কাফেরদের আরবী নিন্দাকাব্যের বিপরীতে
মাতৃভাষায় এর বলিষ্ঠ জবাব দানের জন্য। এর পরও ইসলামে মাতৃভাষা চর্চার গুরুত্ব না বুঝার
কোন কারণ থাকতে পারে না। বস্তুতঃ দ্বীন প্রচারে দায়ীর ভাষা হতে হবে মাতৃভাষা, যাতে সে
অঞ্চলের মানুষ তা সহজে বুঝতে পারে। এটাই কোরআনের নির্দেশ, এটাই রাসূলের
কামনা।
মাতৃভাষা চর্চার এ গুরুত্ব
উপলব্ধির পর সন্দেহাতীতভাবেই বলা যায়, বাংলা আমাদের মাতৃভাষা, এই ভাষায়
ইসলামের প্রচার ও প্রসার করা আমাদেরই দায়িত্ব।
এবার একটু ভাষার ইতিহাস নিয়ে
কথা বলি। ব্রাম্মণ্য নিষ্পেষণের মধ্য দিয়ে বাংলাভাষার জন্ম। ব্রাম্মণরা ঘোষণা করেছিল, যারা মুখের
ভাষায়, মায়ের ভাষায়,
অর্থাৎ বাংলা ভাষায় শাস্ত্র চর্চা করবে তাদের শাস্তি হলো, তারা জঘন্যতম
রৌরব নরকে নিক্ষিপ্ত হবে। কোন হিন্দুর তখন অধিকার ছিলনা বাংলায় শাস্ত্র করার। এসময়
বৌদ্ধরা প্রথম সহজিয়া গানের মাধ্যমে বাংলা চর্চা শুরু করে। হিন্দু ব্রাম্মণরা এ অপরাধে
বৌদ্ধদের দেশ ছাড়া করে। নেপালের জঙ্গল থেকে উদ্ধারকৃত কয়েকটি গান বাংলাভাষার আদি নিদর্শন
হিসাবে এখনো টিকে আছে। লক্ষণসেনকে পরাজিত করে বাংলায় মুসলিম শাসন শুরু হওয়ার পর মুসলিম
শাসকরা বাংলার পৃষ্ঠপোষকতা শুরু করায় বাংলাভাষা নতুন রূপে উদ্ভাসিত হয়। এ ইতিহাস সবাই
জানেন। বাংলাভাষার ইতিহাস লিখতে গিয়ে একথাই বলেছেন ড. দীনেশচন্দ্র সেন ও মশহুর ইতিহাসকাররা।
বৌদ্ধদের পলায়নের পর দীর্ঘদিন সেন রাজারা দেশ চালায়। তাদের ভাষা ছিল সংস্কৃত। বাংলার
প্রতি ছিল তাদের চরম বিদ্বেষ। এই সেনরা ছিল বহিরাগত এবং হিন্দু। ফলে, হিন্দুদের
অত্যাচারে বাংলা চর্চা একরকম বন্ধ হয়ে যায়। ব্রাম্মণরা নিম্নশ্রণীর হিন্দু ও অব্রাম্মণদের
মানুষই মনে করতো না। বাংলাভাষার স্বর্ণযুগ শুরু হয় মুসলিম শাসকদের হাতে। সুলতানী আমল
ও মোঘল আমলে প্রায় ছয়শত বছর মুসলিম শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় যে বাংলাভাষা নতুন করে বিকাশ
লাভ করলো, সেই ভাষাকে অজ্ঞতাবশত: এখন অনেক আলেম ও মুসলমান হিন্দুদের ভাষা মনে করে। একসময়
সংস্কৃত আমাদের ওপর আগ্রাসন চালাতো, এর বিরোধিতা করতে যেয়ে মুসলমানরা
বাংলাকে আরবীকরণ শুরু করে। যতদিন যাচ্ছে এ আগ্রাসন কেবল বাড়ছে। সংস্কৃতের আগ্রাসন
যেমন কাম্য ছিল না, তেমনি আরবী
আগ্রাসনও কাম্য নয়। স্বতস্ফুর্তভাবে ফারসীর মত আরবী শব্দও বাংলা ভাষায় প্রবিষ্ট হতে
পারে, কিন্তু জোর করে আরবী চাপিয়ে দেয়ার প্রচেষ্ঠাকে ইসলামাইজেশন বলা যায় না। এটা প্রতিক্রিয়াশীলতা।
এটা আল্লাহর ফয়সালার বিরুদ্ধে এক অনাকাঙ্খিত প্রচেষ্টা। যেখানে আল্লাহ নিজে ঘোষণা করেছেন
সকল ভাষার স্রষ্টা তিনি এবং তিনিই আমাকে বাংলায় পাঠিয়েছেন তখন বাংলাই আমার মাতৃভাষা।
ইংরেজরা থেংকু বললে যেমন ইসলাম বিরোধীতা করা হয় না তেমনি আমরাও ধন্যবাদ বললে তা অনৈসলামিক
নয়। বরং এটাই ইসলাম চায়। আপনি যে ভাষার লোক সে ভাষাই আপনি চর্চা করুন এবং সে ভাষার
সহজ ও সর্বজনগ্রাহ্য রূপে ইসলামের প্রচার ও প্রসার করুন আপনি মুসলিম হলে আপনার কাছে শুধু এতটুকুই ইসলামের
দাবী। মুসলমানরা মধ্যপন্থী জাতি। প্রতিক্রিয়াশীলতা বা একদেশদর্শিতা বা কোন প্রান্তিকতা
তাদের জন্য প্রযোজ্য নয়। আসুন, আবেগ বা ভাবাবেগ নয়, ইসলামের মূল স্পিরিট অনুধাবনের চেষ্টা
করি। ইসলাম যে উদারতা ও মহানুভবতার বিস্তার ঘটাতে চায় সেই রঙে নিজেকে রাঙিয়ে তুলি।
আমরা আপোষহীন থাকবো নীতি ও নৈতিকতার ব্যাপারে কিন্তু আল্লাহর খলিফা হিসাবে আমরা হবো
মহৎ ও উদার। পিতা যেমন পুরো পরিবারকে আগলে রাখে, আমরাও তেমনি এ বিশ্বকে আগলে রাখবো
আমাদের ভালবাসা দিয়ে। আমরা বিশ্বাস করি, মানুষ বানর নয়, এক আদমের
সন্তান। অতএব মানুষ মাত্রই আমার আত্মীয়, আমার ভাইবোন। আমরা কারো অধিকার হরণ
করবো না, কারো অনৈতিক পক্ষাবলম্বন করবো না। হোক সেটা সামাজিক ক্ষেত্রে, হোক ভাষার
ক্ষেত্রে। আমরা ইসলামের নীতিমালা মেনেই মাতৃভাষার চর্চা করবো। প্রতিটি মুহূর্তে মনে
রাখবো ইসলামে মাতৃভাষা চর্চার অপরিসীম গুরুত্বের কথা।
২১/২/২৩। বাদ যোহর।
No comments