স্মৃতিকথাঃ একটি স্মরণীয় দিন - আসাদ বিন হাফিজ

 


এক রমজানের কথা বলছি। সে রমজানে এমন একটি ঘটনা ঘটে যা আমি চিন্তাও করিনি। একদিন কয়েকজন আলেম প্রীতি প্রকাশনীতে আমার সাথে দেখা করতে এলেন।আমি যথেষ্ট সম্মান ও শ্রদ্ধার সাথে তাদের বসতে দেই। জানতে চাই, তারা কি জন্য এসেছেন। তারা তাদের পরিচয় দিলেন। তারা সবাই খেলাফত আন্দোলনের সাথে জড়িত এবং কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। কে কোন দায়িত্বে আছেন বিস্তারিত জানালেন। বললেন, আমরা খেলাফতের পক্ষ থেকে একটা দাওয়াত নিয়ে এসেছি।

জানতে চাইলাম কি দাওয়াত? তারা জানালো,খেলাফতের পক্ষ থেকে আমরা লালবাগ মাদ্রাসায় একটা ইফতার মাহফিলের আয়োজন করেছি। খেলাফতের বর্তমান আমীর মাওলানা আহমদ উল্লাহ আশরাফ এতে সভাপতিত্ব করবেন। আমরা আপনাকে এ মাহফিলে আলোচক হিসাবে পেতে চাই।

এটি ছিল আমার কাছে এক আকস্মিক ও অভাবিত প্রস্তাব। কারণ, লালবাগ মাদ্রাসা ও হাফেজ্জী হুজুর এদেশের মুসলমানদের একটা বড় স্তম্ভ। আমার বক্তব্য ছিল, আপনারা এত আলেম থাকতে সেখানে আমি কি বলবো? তাও রোযার মাসে ইফতারির ওপর? কিন্তু উনারা নাছোরবান্দা। জানালেন, কেন্দ্রীয় কমিটিতে আলোচনা করেই এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। অগত্যা কি আর করা, ভয়ে ভয়ে রাজি হলাম। ভয় এ জন্য যে, আগে কখনো খেলাফতের কোন আয়োজনে আমার যাবার সৌভাগ্য হয়নি। সেখানকার কর্মীরা আমাকে কিভাবে নেবে তাও জানি না।

নির্দিষ্ট দিনে আমাকে যথাযথ সম্মানের সাথে নিয়ে যাওয়া হলো। মসজিদ ভরা আলেম ওলামা। বিভিন্ন ইসলামী দলের অনেক নেতৃবৃন্দ সেখানে উপস্থিত। আছেন সম্মানিত অনেক পীর মাশায়েখগণ।

মাহফিল শুরু হলো। মোহতারাম পীর সাহেবান ও বিভিন্ন দলের নেতৃবৃন্দকে পরিচয় করিয়ে দেয়া হলো। পরিচয় করিয়ে দিলেন দলের মহাসচিব মাওলানা জাফরুল্লাহ খান। কয়েকজন বিজ্ঞ আলেম ও পীর নামকাওয়াস্তে কথা রাখলেন। ওনাদের যে কাউকে মাইক দিলেই কয়েক ঘন্টা আলোচনা রাখতে পারেন। কিন্তু তাদেরকে সে সুযোগ না দিয়ে কেবল সালাম দেয়ার সুযোগটুকু দেয়া হলো। আলোচনা রাখলেন সে সময় খেলাফতে আন্দোলনের মহাসচিব জাফরুল্লাহ খান সাহেব। সময় স্বল্প। আমি সভাপতির জন্য সময় রেখে দুচার কথা বললাম। সভাপতি আমীরে খেলাফত,হাফেজ্জী হুজুরের বড় ছেলে জনাব মাওলানা আহমদ উল্লাহ আশরাফ সংক্ষিপ্ত কথা ও মোনাজাতের মাধ্যমে সভা শেষ করলেন।

আজান হলো, নামাজ পড়লাম। মাওলানা জাফরুল্লাহ সাহেব বললেন, আমাদের কেন্দ্রীয় কমিটি আপনার সাথে একটু ঘরোয়াভাবে বসতে চায়।

মসজিদের পাশেই এক রুমে বসলাম আমরা। আমীরে খেলাফত ছাড়া কেন্দ্রীয় কমিটির প্রায় সবাই উপস্থিত বলে আমাকে জানানো হলো।

শুরু হলো ঘরোয়া আলাপ। আমার পারিবারিক খোঁজখবর নেয়ার পর শুরু হলো মূল আলোচনা। সব প্রশ্ন এ মুহূর্তে আমার মনে নেই। যে প্রশ্নটি আমাকে বিব্রত অবস্থায় ফেললো সেটা ছিল এরকম: আপনার সব লেখাতেই ইসলামী চেতনা আমরা লক্ষ্য করছি। কিন্তু আপনার আকিদাগত কিছু সমস্যা আমাদেরকে ভাবনায় ফেলে দেয়। আপনার লেখা জামাতের আকিদার সাথে অনেকটা মিলে যায় কিন্তু আমাদের আকিদার সাথে সেভাবে মিল খায় না। এদেশের অধিকাংশ আলেম ওলামার চেতনা আমরা আপনার লেখায় খুঁজে পাই না। কারণ কি?

আমি এ প্রশ্নকে স্বাগত জানিয়ে বললাম, আপনারা ঠিকই বলেছেন। তবে কার আকিদার সাথে আমার মিলে আর কার আকিদার সাথে মিলে না, এটা আমি সেভাবে ভেবে দেখিনি।

আমি ব্যক্তিগত উদ্যোগ কোরআন অধ্যয়ন করেছি, হাদীস পাঠ করেছি, এর ফলে ইসলাম আমি যতটা বুঝেছি সেটাই আমার লেখায় তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।

আজকেই প্রথম আপনাদের সাথে মিলিত হলাম। ফলে, আপনাদের ব্যাপারে আমি জানি কম। না জেনে আমি আপনাদের ব্যাপারে কিভাবে আলোচনা করবো বলুন।

আর আকিদার কথা বলছেন? আমি আল্লাহর কালাম এ ছহি হাদীসের বাইরে আর কোন আকিদা চিনি না।মুসলমানের আকিদাতো একটাই। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ। আমরা আল্লাহর গোলাম ও রাসূলের উম্মত। এটাই যদি মুসলমানের আকিদা হয় তবে আপনাদের আর আমার আকিদা ভিন্ন হবে কি করে।আমরাতো একই নবীর উম্মত। তাঁর দেখানো পথই আমাদের পথ।

হ্যাঁ, এক্ষেত্রে  কখনো কখনো কোন বক্তব্যের একাধিক ব্যাখ্যা করা যেতে পারে, তাতে আকিদা একটু এদিক সেদিক হতে পারে। সে ভিন্নতাকে মেনে নেয়াটা ইসলামেরই দাবী। এজন্য ইজতিহাদের অবকাশ ইসলাম রেখেছে। আপনার মত আপনার আমার মত আমার। আমি যদি ভুল করি ইজতিহাদে পাবো এক নেকী, আপনি ঠিক করলে পাবেন দুই নেকী।তার মানে কারো মতকে ইসলাম অস্বীকার করছে না, অথচ এ নিয়ে আমরা ঝগড়াও করছি।

ছোট্ট একটা উদাহরণ দেই। আমরা সবাই জানি, রাসূল তলোয়ার দিয়ে যুদ্ধ করেছেন। একদল বললো, তলোয়ার দিয়ে যুদ্ধ করা সুন্নত। অন্যদল এর ব্যাখ্যা করলো, রাসূল তাঁর জামানার প্রচলিত অস্ত্র দিয়ে যুদ্ধ করেছেন, তাই প্রতিটি যুগে সে সময়কার অস্ত্র দিয়ে যুদ্ধ করা সুন্নত।আপনি এর একটা বা অন্য কোন ব্যাখ্যাও দিতে পারেন। আপনি যদি ভুল ব্যাখ্যাও দেন সওয়াব আপনি পাবেন কিন্তু দুনিয়াতে এক রকম ফল পাবেন না। শত্রু যদি বন্দুক নিয়ে হামলা করে তবে তলোয়ার নিয়ে আপনি তার ধারেকাছেও যেতে পারবেন না। এক ব্যাখ্যা নিলে জেতারও সম্ভাবনা আছে আর এক ব্যাখ্যা নিলে পরাজিতই শুধু হবেন না, নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবেন। পার্থক্য শুধু এতটুকু।

ভাল প্রশ্ন তুলেছেন, জামায়াতের সাথে আমার মত মিলে যায় কেন? আপনাদের সব ব্যাপারেই যে আমার অমিল হয়, এমনও নয়। কখনো কখনো মিলেও যায়।

দেখুন, আপনারা একসময় ফতোয়া দিয়েছেন, মাইকে আজান দেয়া নাজায়েজ। এখন কিন্তু আজান, মাহফিল সর্বত্র আপনারা মাইক ব্যবহার করছেন। তার মানে, আপনারাই আপনাদের আকিদা থেকে সরে এসেছেন। আপনাদের আকিদা স্থির নয়, পরিবর্তনশীল। ফলে, আপনার আমার বুঝ নাও মিলতে পারে। কোন অসুবিধা নেই, আপনি আপনার আকিদা মত চলুন, আমাকে আমার আকিদায় চলতে দিন। মৌলিক ব্যাপারে তো আমাদের মধ্যে কোন বিরোধ নেই। যিনি আপনার নবী তিনি আমারও নবী। ফলে, ব্যাখ্যার কারণে কেউ ভিন্ন মতালম্বী হলে তাকে খারিজ করে দেয়াটা ইসলাম সম্মত নয়।

আমি হাফেজ্জী হুজুরকে এদেশের মুসলমানদের জন্য এক বড় নেয়ামত মনে করি। এক সময় এদেশের আলেমরা রাজনীতিকে হারাম মনে করতেন। হাফেজ্জী হুজুর রাজনীতিতে নামায় আপনারা সেখান থেকে সরে এসেছেন। এখন রাজনীতি হালাল এ ফতোয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় আপনাদের আকিদা, আপনারা এখন নিজেরাই রাজনীতি করছেন। হাফেজ্জী হুজুর যদি রাজনীতিতে না আসতেন তবে আরো কত শত বৎসর আপনাদের কাছে রাজনীতি হারাম থাকতো তা আল্লাহই জানেন। তার মানে, আপনারা আপনাদের আকিদা পাল্টান। প্রয়োজনে আমিও আমার মত পাল্টাতে পারি। কিন্তু এজন্য আমরা পরষ্পর শত্রু হয়ে যায়নি। আপনি যেটা আজকে বুঝেছেন আমি সেটা তিনদিন পরেও বুঝতে পারি। এজন্য দরকার মহব্বতের সাথে পরষ্পর বিরোধপূর্ণ বিষয়ে মতবিনিময়।

আমার লেখায় রাজনীতি আসে, সমাজনীতি আসে, অর্থনীতি আসে এবং এমন নানা প্রসঙ্গ আসে। হতে পারে অধিকাংশ সময় তা জামায়াতের আকিদার সাথে মিলে যায়। কারণ,জামায়াত যা পঞ্চাশ বছর আগে বুঝেছে, পঞ্চাশ বছর পরে আপনারা তা মেনে নিচ্ছেন। আজ যা জামায়াত বলছে, পঞ্চাশ বছর পর আপনারা তা সঠিক বলবেন না, এমন কোন নিশ্চয়তা আছে?

সম্মানিত আলেম সমাজ, আজ বিশ্বব্যাপী মুসলমানরা বড় দুর্দশাগ্রস্ত। এদের সঠিক দিকনির্দেশনা দেয়া আপনাদের দায়িত্ব। ছোটখাট বিষয় নিয়ে ভাইয়ে ভাইয়েও দ্বন্দ্ব হয়। কিন্তু ঘরে আগুন লাগলে সে কথা ভুলে যেতে হয়। নানা ফেরকা, দল, গ্রুপ আছে থাকুক, সৈয়দ, শেখ, খান সবাই মিলে আমরা যেমন মুসলমান তেমনি কে কোন টুপি মাথায় দিলাম, কে কোন দল করলাম সেদিকে না তাকিয়ে বিশ্ব মুসলমানকে দুর্দশামুক্ত করার জন্য এগিয়ে আসুন। একজন কবি হিসাবে আমি এই আর্জি আপনাদের কাছে রাখছি।

আসুন, কোরআন ও সুন্নাহর ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হই। সবাই কোরানের কাছে ফিরে যাই। জামায়াত জামায়াতের মত থাকুক, খেলাফত থাকুক খেলাফতের মত।

মনে রাখবেন, ইসলাম তাবিজ বিতরণ ও পানি পড়া দেয়ার জন্য আসেনি। ইসলাম এসেছে সমাজ পরিবর্তনের জন্য। অসহায় মানুষের পেটে খাবার দেয়ার জন্য। বদ রসম রেওয়াজ বাদ দিয়ে সভ্যতার কল্যাণের জন্য। চারিত্রিক শুদ্ধতা আনয়নের জন্য। হিংসা বিদ্ধেষ বাদ দিয়ে সবার মধ্যে সাম্য ও ইনসাফ কায়েমের জন্য।

আল্লাহ কারো মামা খালু লাগে না, ফলে পক্ষপাতিত্ব করার কোন প্রয়োজন হয় না আল্লাহর। উদার হোন, মানবিক হোন, সবাইকে সম্মান ও আদর করুন। কারণ আপনি কোন সাধারণ মানুষ নন, আপনি আল্লাহর খলিফা, আল্লাহর প্রতিনিধি। আর এ দুনিয়া জাহান আল্লাহর। অতএব আল্লাহর এ দুনিয়াকে দেখভাল করার সমুদয় দায়িত্ব আপনার। হিংসা, বিদ্ধেষ আপনাকে এ কাজে বাঁধা দিবে। প্লিজ, উদার হোন, মহত হোন। কোরআন ও হাদীসের ভিত্তিতে জাতিকে গড়ে তুলুন।

তখন তারা আরেকটি প্রশ্ন আমাকে করলো, দেশে অসংখ্য ইসলামী দল কাজ করছে। আপনার মতে কাকে আমরা যথার্থ ইসলামী দল বলতে পারি।

এ প্রশ্নের জবাবে আমি বললাম, সামনে নির্বাচন হবে। এ নির্বাচনে যারা অংশ নেবে সবাই মুসলমান। কিন্তু কোনো মুসলমান ধর্ম নিরপেক্ষ থাকতে পারে না। কারণ তাদের একটা ধর্ম আছে। তার নাম ইসলাম।এ নির্বাচনে যারা ধর্মনিরপেক্ষ দল করবে বা ধর্মনিরপেক্ষ দলকে সমর্থন দেবে, বুঝে নেবেন তাদের মধ্যে কিছু সমস্যা আছে। আপনি কি ধর্ম নিরপেক্ষ, না ইসলামের পক্ষ তার আলোকে নির্ধারিত হবে আপনি কোন দলকে সমর্থন দেবেন।

তাদের শেষ প্রশ্ন ছিল, আপনি কি খেলাফতকে ইসলামী দল মনে করেন না?

আমি বললাম, দেখুন আমি মনে করা বা না করাতে কিছু যায় আসে না। হিসাবটা পরিষ্কার, আপনি বা আপনার দল যদি ধর্ম নিরপেক্ষতাকে সাপোর্ট করে তবে বুঝবেন এটা ইসলামী দল নয়। আর যদি বিরোধীতা করে তবে তাকে ইসলামী দল মনে না করার কোন কারণ নেই।


শব্দচয়ন হুবহু এক না থাকলেও এরকমই ছিল আমার বক্তব্য।

এটি ছিল আমার জীবনের একটি স্মরণীয় দিন।

১২/৪/২৩।

 

No comments

Powered by Blogger.