যদি বক্তৃতা দিতাম - অপ্রকাশিত কবিতাঃ ০৯৫

                                                                            

কবিতা-০৯৫ : যদি বক্তৃতা দিতাম

যদি বক্তৃতা দিতাম, তবে বলতামঃ

সংগ্রামী ভাই ও বন্ধুগণ,

আপনারা আমার সালাম ও শুভেচ্ছা নিন।

আমি জানি, আপনাদের ওপর দিয়ে কী ভয়াবহ ঝড় বয়ে যাচ্ছে। কারণ আমি আপনাদের থেকে বিচ্ছিন্ন কেউ নই। আমি আপনাদের সাথেই ছিলাম, আছি এবং থাকবো ইনশাআল্লাহ।

 

আপনাদের কি মনে আছে, প্রিয় নবী সা. যখন কতিপয় সাহাবী নিয়ে হজ্জ করতে গিয়েছিলেন মক্কায়, তখন প্রতিপক্ষ পথ আটকে দাঁড়ায়। সে বছর নবী ও তার সঙ্গীরা হজ্জ করতে পারেননি বরং হুদায়বিয়া নামক স্থানে এক অপমানজনক শর্তে সন্ধি করে নবী সা.ফিরে আসতে বাধ্য হন।

 

চিন্তা করুন, দুনিয়ার শ্রেষ্ঠতম মানুষ, আল্লাহর প্রিয়তম হাবীব সাথে থাকার পরও এ ন্যাক্কারজনক চুক্তিতে যখন নবী সাক্ষর করেন, তখন সাহাবীদের অবস্থা কি হয়েছিল?

মুসলমানরা যখন অপমানিত, বিপর্যস্ত, হতাশায় মুষড়ে পড়েছিল, তখন আল্লাহর পক্ষ থেকে এ চুক্তিকে প্রকাশ্য বিজয় বলে ঘোষণা দেয়া হয়।

 

দৃশ্যতঃ এ বিজয় তো ছিল শত্রুর, প্রতিপক্ষের। কিন্তু আল্লাহ যা জানেন, কোন মানুষ তা জানে না।

তাই সেদিন সাহাবীরা নিজের মন মনন ও বিবেকের রায়ের বিরুদ্ধে আল্লাহর ফয়সালাকেই মেনে নিয়েছিল।

এখানেই মুসলমানদের বিজয়ের মূলমন্ত্র লুকিয়ে আছে। মুসলমান কখনো নিজের শক্তির ওপর নির্ভর করে না। তারা নির্ভর করে আল্লাহর ক্ষমতা, শ্রেষ্ঠত্ব ও মহিমার ওপর।

 

তারপরের ইতিহাস আপনারা জানেন। আমি শুধু এ প্রসঙ্গে একটা কথাই বলতে চাইঃ

মনে রাখবেন, মহত্ব বুঝাতে মানুষ মানবতা শব্দটি ব্যবহার করে। কিন্তু মানবতাবাদের চাইতেও ইসলাম যে ব্যাপক ও বিস্তৃত এটা অনেকেই জানেন না।

এ ধরনের কথা শুনলে অনেকেই চমকে ওঠেন। কিন্তু, না। এখানে চমকানোর কিছু নেই। সত্যি, মানবতার চেয়ে ইসলাম অনেক অনেক বেশী প্রয়োজন মানুষের।

 

মানুষের স্বভাবসুলভ আচরণকেই মানবতাবাদ বলে। মানুষের স্বভাবে যেমন মায়া মমতা আছে, তেমনি আছে রাগ, ক্ষোভ, ঘৃণা।

আছে প্রতিশোধপরায়নতা। এটাই মানুষের প্রকৃতি। মানবতাবাদের দৃষ্টিতে যুদ্ধে কিছু অনিয়ম হয়েই থাকেতাই বিজয়ী দলের হত্যা, ধর্ষণ ও অরাজকতাকে অন্যায় মনে করা হয় না।

 

কিন্তু ইসলামে?

না, ইসলামে ব্যক্তিগত কারণে প্রতিশোধ গ্রহণের এ ধরণের সুযোগ নেই। নির্বিচার হত্যাযজ্ঞের কোন সুযোগ নেই। সম্মুখ সমর ছাড়া কারো ওপর হাতিয়ার তোলারও সুযোগ নেই।

ইসলাম কোন জনপদের শিশু, বৃদ্ধ ও নারীর ওপর হাত তোলার অনুমতি দেয় না।

 

প্রিয় বন্ধুগণ

আমি আপনাদের মক্কা বিজয়ের কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। ইতিহাস মক্কা বিজয়কে অভিহিত করেছে রক্তপাতহীন যুদ্ধ বলে।

 

কে না জানে, বছরের পর বছর কি অকথ্য নির্যাতন করা হয়েছিল মুসলিমদের ওপর!

তাদের সহায় সম্পদ দখল করে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছিল মক্কা থেকে। সামাজিকভাবে বয়কট করে তাদের রাখা হয়েছিল শিবে আবু তালিবের বিষাদময় কারাগারে।

সেকি দুঃসহ দুর্দিন। খাদ্য নেই, পানি নেই। ক্ষুধার যন্ত্রণায় অবশেষে গাছের পাতা চিবিয়ে খেয়েছে মুসলিমরা, তবু আপোষ করেনি।

যাদের ওপর এ অত্যাচার করা হয়েছিল তারাই আজ বিজয়ীর বেশে ঢুকতে যাচ্ছে মক্কায়। মক্কার কোরেশরা আতঙ্কিত, না জানি আজ কী হয়।

কিন্তু না, কিছুই হলো না। কোরেশদের বলে দেয়া হলো, তারা কে কোথায় আশ্রয় নেবে।

(না, রানী ইসাবেলার মতো আশ্বাস দিয়ে মুসলমানদেরকে মসজিদে ঢুকিয়ে তাদের সেদিন বাইরে থেকে তালা দিয়ে পুড়িয়ে মারা হয়নি।)

যে মক্কায় রক্তের স্রোত বয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করেছিল মক্কাবাসী, সেখানে একজন শিশুরও রক্ত ঝরলো না। একজন নারীও হলো না লাঞ্ছিত।কী অবাক কান্ড!

 

মুসলমানরা মক্কায় প্রবেশ করছে, তাদের দৃষ্টিতে নেই রাগ, ক্ষোভ বা ক্রোধের কোন চিহ্ন। সে দৃষ্টিতে খেলা করছে হরিণীর মত অদ্ভুত মমতাময় চাহনী ও করুণার ঐশ্বর্য।

যদিও সে চোখে আছে ঈগলের সতর্কতা, কিন্তু নেই নির্মমতার কোন অদৃশ্য ক্রোধ। এরই নাম ইসলাম।

 

প্রিয় ভাই ও বন্ধুগণ!

যদি ইসলামই মানেন, তবে মুসলিম হোন।

 

আপনারা সমাজ ও রাষ্ট্রে ইসলাম প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেন। যদি তাই চান তবেআপনার জিম্মায় রাখা যে সাড়ে তিন হাত দেহ আছে, সেই দেহে ইসলাম কায়েম করুন।

 

প্রিয় ভাইয়েরা, মহান আল্লাহ কালামে পাকে আমাদেরকে ডেকে বলেছেন, "হে মুমীনরা, তোমরা মুসলমান না হয়ে মরো না।"

আমিও আপনাদের বলতে চাই, আসুন, আমরা সবাই মুসলমান হয়ে যাই।

আমাদের  হাতগুলো হোক মুসলমান।

পা চোখ নাক হোক মুসলমান।

আমাদের মন মানসিকতা হোক মুসলমান।

আমাদের আচরণ ও ব্যবহার হোক মুসলমান।

 

মুসলমান কে?

মুসলমান হচ্ছে আল্লাহর খলিফা। আল্লাহরই প্রতিনিধি। আল্লাহর সৃষ্ট এ জগতকে সুন্দর রাখার দায়িত্ব তাদের। শান্তিময় রাখার দায়িত্ব তাদের।

আপনাদের মনে থাকার কথা সেই অমূল্য বানী, " যদি ফোরাত কুলে কোন কুকুরও না খেয়ে মরে তবে আমি ওমরকে সে জন্য জবাবদিহি করতে হবে।"

এটা কেবল একজন ইসলামী রাষ্ট্রের খলিফার কন্ঠ থেকেই উচ্চারিত হতে পারে।

 

আমি মুসলমান বললেই কেউ মুসলমান হয়ে যায় না। কর্মের মধ্য দিয়ে তাকে প্রমাণ করতে হয় সে মুসলমান।

আকাশের চাইতেও বড় করতে হয় তার মন।

আল্লাহর খলিফারা কেবল নিজেদেরই দায়িত্বশীল নয়, তাদেরকে হতে হয় সমাজ ও সভ্যতার দায়িত্বশীল।

 

নিজেকে সুন্দর রাখার দায়িত্ব তার।

সমাজকে সুন্দর রাখার দায়িত্ব তার।

সভ্যতাকে সুন্দর রাখার দায়িত্বও তার।

আত্মীয়দের সুন্দর রাখার দায়িত্বও তার।

প্রতিবেশীকে সুন্দর রাখার দায়িত্ব তার।

 

মুসলমানদের সুন্দর রাখার দায়িত্ব তার।

হিন্দুদের সুন্দর রাখার দায়িত্বও তার।

পশুকে সুন্দর রাখার দায়িত্ব তার।

পাখিকে সুন্দর রাখার দায়িত্বও তার।

 

সে বৃক্ষকে সুন্দর রাখবে।

নদীকে সুন্দর রাখবে।

পুষ্পকে সুন্দর রাখবে।

পরিবেশকে সুন্দর রাখবে।

মোট কথা, আল্লাহর যত সৃষ্টি আছে সবাইকে সে ভালোবাসবে, আদর করবে এবং তাদের মধ্যে কখনো কোন বিরোধ দেখা দিলে ইনসাফের সাথে সমন্বয় ও সম্প্রীতি সৃষ্টি করবে।

 

সমাজ ও সভ্যতায় ইসলামের চারা রোপন করা মানে শান্তি রোপন করা।

ইসলামের চারা রোপন করা মানে স্বস্তি রোপন করা।

ইসলামের চারা রোপন করা মানে গড়ে তোলা সুখের বাগান।

ইসলামের চারা রোপন করা মানে তৃপ্তির অথৈ জলে ডুব দেয়া।

 

মানুষকে শুধু একটি সুন্দর জীবনের জন্যই মুসলিম হতে হবে।

যদি তা না পারেন তবে আর যাই হোন আপনি মুসলিম হতে পারবেন না।

 

হে আল্লাহর প্রিয় সৈনিকগণ,

আমাদের কাফেলায় যারা শরীক হয়েছেনতাদের কারো কারো চোখে আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি জিঘাংসার নদী। এ নদী নিয়ে আমরা আর সামনে অগ্রসর হবো না।

আগে জিঘাংসা পরিহার করুন

রাগ, ক্ষোভ, ঘৃণাকে কবর দিন।

হত্যা করুন নিজের অন্তরপশুকে।

আগ্নেয়গিরির লাভা যেমন চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে, তেমনি ছড়িয়ে পড়ুক আপনাদের ভালোবাসার লাভা।

সে লাভায় ভেসে যাক পৃথিবী থেকে সব পঙ্কিলতা, সব শোক ও কান্নার মাতম।

 

প্রিয় বন্ধুগণ!

আমরা যদি প্রকৃত মুসলিম হতে পারি,

আমি আপনাদের কথা দিচ্ছিঃ

এ পৃথিবী আমাদেরই হবে।

যে আল্লাহ আবাবিল পাখি পাঠিয়ে

কাবাঘর রক্ষা করেছিলেন

যে আল্লাহ নবী ইব্রাহিমকে আগুনের কুন্ড থেকে রক্ষা করেছিলেন

যে আল্লাহ নবী মুসাকে বাঁচিয়ে ছিলেন ফেরাউনের প্রতিহিংসা থেকে,

সে আল্লাহ এখনো সব দেখছেন।

 

তিনি আমাদের নিষেধ করেছেন নিরাশ হতে।

অতএব, আমরা নিরাশ হবো না।

আমরা নিরব ও নিথর হবো না।

আমরা এগিয়ে যাবো দৃপ্ত পদভারে। হাতে হাত ধরে। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে।

আমরা আল্লাহর রজ্জুকে এমনভাবে আঁকড়ে ধরবো, যেন আমরাই সেই শীসাঢালা প্রাচীর।

 

অন্তরের চক্ষু খুলে তাকিয়ে দেখুন, আমাদের যেসব সাথীরা শাহাদাতের পেয়ালা পান করেছিল, তারা বেহেশতের আবাস ছেড়ে চলে এসেছে পয়লা আসমানে।

তাদের প্রত্যেককেই ঘিরে রেখেছে ঝাঁক ঝাঁক কবুতর।

আর এসব শান্তির পায়রাদের ঠোঁটে রাঙা গোলাপ।

পাখনায় বেলীফুলের শুভ্রতা। নিঃশ্বাসে পুষ্পময় পবিত্র সুঘ্রাণ।

 

আসুন, মুসলমান হই এবং

এ নশ্বর দুনিয়ায় খেলাফতের দায়িত্ব

গ্রহণ করি।

সবাই সমস্বরে বলে উঠি, আল্লাহু আকবার। আল্লাহু আকবার।

১৭/০৫/২০২০

অপ্রকাশিত অন্যান্য কবিতার জন্য এখানে ক্লিক করুন।

No comments

Powered by Blogger.