ফিরিয়ে দাও স্বাধীনতা - অপ্রকাশিত কবিতাঃ ১৭৮
কবিতা-১৭৮ :
ফিরিয়ে দাও স্বাধীনতা
আমি স্বাধীনতার কথা বলছি।
একাত্তুর সালে আমার বাবা কাঁধে
রাইফেল, মাথায় সেক্টর কমান্ডার মেজর জলিলের মত ঝাকড়া চুল নিয়ে বিজয়ীর বেশে ফিরে এসে
বলেছিল, এই নে খোকা,
তোর জন্য স্বাধীনতা নিয়ে এসেছি।
আমি বাবার কোলে ওঠে তাঁর দাড়ির
জঙ্গলে হাত বুলাতে বুলাতে বলেছিলাম,
বাবা, স্বাধীনতা
কি?
বাবা অনেকক্ষণ চুপ থেকে বললো,
স্বাধীনতা, স্বাধীনতা
হচ্ছে অভাব না থাকা।
আমি দাঁত বের করে হেসেছিলাম।
বলেছিলাম, প্রতিদিন
ঘরে ফেরার সময় আমার জন্য চকলেট নিয়ে আসবে? খেলনা গাড়ি, প্লেন?
বাবাও আমার মত দাঁত বের করে
হেসেছিল। বলেছিল,
হ্যারে বাবা, হ্যা।
কদিন কী আনন্দ, কী
ফুর্তি।
তারপর একদিন শেখ সাহেব
পাকিস্তানের জেল থেকে ফিরে এলেন। বাবা বললেন, যাক, এইবার
আর কেউ আমাদের মুখের গ্রাস কেড়ে নিতে পারবে না। আর কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না
আমাদের।
আমাদের কষ্টের কান্না মুছে দিতে
রাজপুত্র চলে এসেছেন।
বাবার সেকি উল্লাস।
মা বললো, এখন
ক্ষেতে যাও।
কাজ করো। নইলে খাবো কি?
শেখ সাব কি আমাদের জন্য
পাকিস্তান থেকে চাল নিয়ে এসেছে?
তারপর শোনলাম, মুক্তিযোদ্ধারা
দুই ভাগ হয়ে গেছে। একদল মুজিববাদ, আরেকদল বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র।
মা হায় হায় করে উঠলো। বাবাকে
বললো, শোন, তোমার রাজপুত্র মুজিবকে বাদ দেয়ার জন্য ছেলেরা শ্লোগান দিচ্ছে "মুজিব বাদ, মুজিব
বাদ" বলে। বাবা মাকে ধমক দিয়ে বললো, যা বোঝ না তা নিয়ে কথা বলোনাতো।
তারপর রসু কাকা, অনিল
বাবু এদের সাথে কি কথা হলো। বাবা বললো, বুঝলি, সর্বহারার
রাজ না হলে আমাদের অভাব যাবে না।
স্কুলের বন্ধুরা কয়, বুর্জোয়া
নিধন কিরে? তোর বাপ নাকি বুর্জোয়া নিধনের জন্য গণবাহিনীতে নাম দিয়েছে?
তারও কয়েকদিন পরের কথা।
একদল যুবকের সাথে বাবাও বাইরে
গেল। সেই যে গেল আর বাবা ফিরে আসেনি। রসু
কাকুকে বললাম, বাবা কই?
কাকু বললো, চুপ, কথা
বলবি না। দেশজুড়ে লালঘোড়া দৌড়াচ্ছে। তোর বাপ লালঘোড়ার পায়ের তলে পিষে গেছে। টের
পেলে তোরেও পিষে ফেলবে।
তারপর এলো সর্বনাশা চুয়াত্তুর।
সারাদেশে দুর্ভিক্ষ। অভাব আর অনটন। মা আমাকে নিয়ে লঙ্করখানায় ঠাঁই নিল। আমি বেঁচে
গেলেও মা কমান্ডারের ডেরা থেকে আর ফেরেনি।
না। বাবার আনা স্বাধীনতার সাথে
আমার আর দেখা হয়নি।
আমি স্বাধীনতার কথা বলছি।
একাত্তুর সালে আমার বাবার
স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনার কথা বলছি।
স্বাধীনতা, আমার
বাবা ও মায়ের মরা লাশটা দেখার সুযোগটাও দেয়নি।
মাঝে মাঝে আমার ইচ্ছে করে কোন
বিরাণ মাঠে গিয়ে চিৎকার করে ডাকিঃ
মা, তুমি
ফিরে আসো,
বাবা, তুমি
ফিরে আসো।
তোমাদের স্বাধীনতা কোথায় গেছে
জানি না।
আমি ভয়ে চিৎকার করি না। রসু কাকা
বলেছে, খবরদার, যদি আওয়াজ করিস তাহলে কখন যে গুম হবি বা গুলি খাবি টেরও পাবি না।
হে বাংলার বীর মুক্তিযোদ্ধা, তোমরা
আমার বাবাকে ফিরিয়ে দাও
নইলে স্বাধীনতা ফিরিয়ে দাও।
ফিরিয়ে দাও। ফিরিয়ে দাও। ফিরিয়ে
দাও।
০১/০১/২০২১ ২টা
অপ্রকাশিত অন্যান্য কবিতার জন্য এখানে ক্লিক করুন।
No comments